সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৬, ০২:৪০:৫৭

‘জানি আমার ভাগ্য লেখা হয়ে গেছে’

‘জানি আমার ভাগ্য লেখা হয়ে গেছে’

মতিউর রহমান চৌধুরী : চারু মজুমদার আর সিরাজ সিকদার। এই দুই বিপ্লবীর মত ও পথ ছিল একই। নিয়তি এক হবে কেউ কি ভেবেছিল? দুজনের জন্মও পূর্ববঙ্গেই। জমিদার পরিবারের সন্তান চারু মজুমদারের জন্ম রাজশাহী জেলার হাগুরিয়া গ্রামে। আর সিরাজ সিকদারের জন্ম শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জে। দুজনই বিশ্বাস করতেন ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’।

চারু মজুমদার পশ্চিমবঙ্গে নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু করে শাসকদের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। সিরাজ সিকদার পূর্ব পাকিস্তানে রেডগার্ড গঠন করে একই স্লোগান দেন। ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে চিকা দেখে সেদিন অনেকেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন। পাকিস্তানি শাসকেরা তো বটেই। এই রেডগার্ড কোথা থেকে এলো। এরা কারা? ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে লাগলো।

পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি থেকে পদত্যাগ করে সিরাজ সিকদার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন চারু মজুমদারের সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের তত্ত্ব সঠিক। এটাকে হঠকারী বলার সুযোগ নেই। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন সিরাজ। স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম হয়ে গেল সিরাজুল হক সিকদার। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়ার পর সিরাজ সিকদার নামেই পরিচিতি পেলেন। শ্রমিক আন্দোলন থেকে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি। মাঝখানে অনেক কিছু। চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ঘাঁটি তৈরি করে বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন।

সহকর্মীদের বিরোধিতার কারণে বিফলে যায় তার সে প্রচেষ্টা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তবে ভিন্ন অবস্থান থেকে। বরিশালের পেয়ারা বাগান থেকে সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দেন। বলেন, আওয়ামী লীগ ‘ছয় পাহাড়ের দালাল’। ওদের দিয়ে যুদ্ধ হবে না। ওরা মাঝপথে আপোষ করবে। তার এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকেই তখন দ্বিমত পোষণ করেন। সিরাজ সিকদার রোমান্টিজমে বিশ্বাস করতেন। কখনও একটি নীতির প্রতি অবিচল থাকেননি। তবে মাও সেতুং ছিলেন তার আদর্শ। চারু মজুমদার পথপরিদর্শক। স্বাধীনতার পর সব পার্টি তাদের নাম বদলালেও সিরাজ সিকদার শেষ অবধি পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টিই রাখেন। এ নিয়ে বহুবার তিনি সতীর্থদের মুখোমুখি হয়েছেন। হাজির করেছেন নতুন থিসিস।

এতে তিনি বলেন, পূর্ববাংলার বীর জনগণ আমাদের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। পূর্ববাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার জন্য বিপ্লব চালিয়ে যেতে হবে। এরপর ‘শ্রেণী শত্রু’ খতমে নেমে পড়ে সর্বহারা পার্টি। ভূস্বামী, জোতদারকে খুন করতে থাকে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সক্রিয় নেতা ছিলেন সিরাজ সিকদার। বহু বিষয়ে তিনি দ্বিমত পোষণ করতেন। শ্রমিক আন্দোলন, রেডগার্ড, সর্বহারা পার্টিতেই তার কাজ সীমাবদ্ধ ছিল না।

তিনি গঠন করেছিলেন ইস্টবেঙ্গল ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট, ইস্টবেঙ্গল রেভ্যুলেশনারী আর্মি যা পূর্ববাংলার বিপ্লবী সেনাবাহিনী নামেও পরিচিতি পেয়েছিল ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে। সিরাজ সিকদারকে নানাভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে ইতিহাসে। তার পার্টির কৌশল, গ্রেপ্তার ও মৃত্যু নিয়ে নানা কথাই চাউর হয়ে আছে। ১৯৭৫ সালের ১লা জানুয়ারি সিরাজ সিকদারের গ্রেপ্তারের খবর সংবাদপত্রে আসে। সবাই তখন নড়েচড়ে বসেন। পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর মধ্যে একধরনের স্বস্তি।

কারণ তারা মাসের পর মাস ধরে দিনে-রাতে অভিযান শুরু করে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। সিরাজ সিকদার তার দলে নানা কিসিমের লোকদের ঠাঁই দিয়েছিলেন। বলা চলে এরাই একপর্যায়ে তার শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এরা গুপ্ত হত্যা, থানা লুট, ব্যাংক লুট, হাটবাজার লুট করতো। লঞ্চ, ট্রেনে ডাকাতি শুধু নয়, এরা ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলতো। থানা লুট আর ফাঁড়ি লুটের কারণে পুলিশ অনেকটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। অনেক স্থানে পুলিশি কার্যক্রম ভেঙে পড়েছিল।

রাজনৈতিক নেতারা ভীত হয়ে পালিয়ে বেড়াতেন। একাধিক সংসদ সদস্য খুন হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থায় তার গ্রেপ্তার রাজনীতিতে ছিল এক আলোচিত ঘটনা। এর আগে ১৪ই ডিসেম্বর সিরাজ সিকদার দেশব্যাপী হরতাল ডেকে প্রশাসনের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ নিপাত যাক’ এই স্লোগানেই হরতাল ডাকা হয়। মওলানা ভাসানী এই হরতালের প্রতি অনুসমর্থন দেন। বিবিসি তখন রিপোর্ট করেছিলো এক অদৃশ্য মানবের ডাকে বাংলাদেশে হরতাল পালিত হয়ে গেল।

অন্তত ৯টি জেলায় সর্বাত্মক হরতাল হয়েছে। সে দিনের হরতাল আর আজকের হরতালের মধ্যে দিন-রাত তফাৎ। ঢাকার সংবাদপত্রের শিরোনামে বলা হলো, চট্টগ্রামে সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশেষ কিছুই জানা গেল না। অবশ্য লেখক, ইতিহাসবিদরা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন তার গ্রেপ্তারের ঘটনাটি। সাপ্তাহিক বিচিত্রা ১৯৭৮ সালের ১৯শে মে সিরাজ সিকদারকে নিয়ে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন তৈরি করে।

‘সিরাজ সিকদার হত্যার নেপথ্য কাহিনী’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে কিভাবে তাকে গ্রেপ্তার এবং হত্যা করা হয় তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, সিরাজ সিকদার তার গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। এ জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ১৫ই জানুয়ারি ’৭৫-এর পর থেকে অবস্থান বদল করবেন অন্য এক কৌশলে। তার কাছে খবর ছিল পার্টির ভেতরে বিপুলসংখ্যক অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। এদের বেশির ভাগই পুলিশের লোক বা সোর্স। ১৯৭৪ সালে জনৈক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার ভাগনে এই দলের সদস্যপদ পেয়েছে। তার মাধ্যমেই সিরাজ সিকদারকে পাঠানো একটি চিঠি ধরা পড়ে যায়।

চট্টগ্রাম হালিশহর বৈঠকে সিরাজ সিকদার উপস্থিত। বৈঠক চলছে, এর মধ্যে একজন সদস্য হঠাৎ করে বৈঠক ত্যাগ করলেন। পরে আর ফিরে আসেননি। পূর্ব সিদ্ধান্ত ও কৌশল অনুযায়ী সিরাজ সিকদার আগেই বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে সহকর্মী মহসিন। কিছু দূর যাওয়ার পর একটি বেবিট্যাক্সি ভাড়া করেন। এ সময় তার পরনে ছিল ঘিয়ে রংয়ের প্যান্ট, টেট্রনের লাল ফুলশার্ট। চোখে চশমা। হাতে কালো রংয়ের একটি ব্রিফকেস।

বেবিট্যাক্সি স্টার্ট দিতেই এক ব্যক্তি তাদের থামায়। বলে আমাকে একটু নিয়ে যাবে। সামনেই নেমে যাবো। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর তাকে বেবিতে তোলা হয়। বেবিট্যাক্সি যখন চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের কাছে পৌঁছে তখনই সেই অনাহূত সহযাত্রী ট্যাক্সি থামাতে বলেন। সিরাজ সিকদার কোনো অবস্থাতেই থামবেন না। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সেই আগন্তুক লাফ দিয়ে বেবিট্যাক্সির সামনে গিয়ে পিস্তল উঁচিয়ে ড্রাইভারকে থামাতে বলে। ভয়ে ড্রাইভার রোধ করে গতি।

সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে স্টেনগান হাতে সাদা পোশাকের পুলিশ ঘেরাও করে বেবিট্যাক্সি। এভাবেই গ্রেপ্তার হন সিরাজ সিকদার। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডাবলমুরিং থানায়। ঢাকায় নিয়ে আসা নিয়ে মতভেদ দেখা দেয় পুলিশের মধ্যে। একদল বলছে, সড়ক পথে নেয়া যাবে না। ট্রেনে তো সুযোগই নেই। খবর পেলে ট্রেন উড়িয়ে দেবে। পরে সিদ্ধান্ত হয় বিমানে আনার।

কক্সবাজার থেকে আসা বিমানে করে বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে পুরনো বিমানবন্দরে আনা হয়। যদিও হাত বাঁধা অবস্থায় কাউকে বিমানে তুলতে মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলেন পাইলট। হ্যাঙ্গারের পেছনে তাকে নামানো হয়। পুলিশ পুরো এলাকা তখন ঘিরে রেখেছে। বিমান থেকে অবতরণের পর অনেকটা আকস্মিকভাবে পুলিশের জনৈক ইন্সপেক্টর দৌড়ে গিয়ে সিরাজ সিকদারের বুকে লাথি মেরে চিৎকার করে বলে ওঠেন ‘হারামজাদা তোর বিপ্লব কোথায় গেল?’ রক্ষীবাহিনীর উপ-পরিচালক আনোয়ারুল আলম ‘রক্ষীবাহিনীর সত্যমিথ্যা’ বইতে সিরাজ সিকদারের গ্রেপ্তারের কাহিনী অন্যভাবে তুলে ধরেছেন।

তিনি লিখেছেন, পুলিশ সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রামে। সেখান থেকে নেয়া হয় পুলিশ হেফাজতে। এরপর শেরেবাংলা নগরস্থ রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে। ১লা জানুয়ারি ১৯৭৫ সালের সকালে আনোয়ারুল আলম অফিসে গিয়ে জানতে পারেন সিরাজ সিকদার তাদের অফিসে। সহকর্মী সারোয়ার হোসেন মোল্লাকে সঙ্গে নিয়ে রক্ষীবাহিনীর পরিচালক এএনএম নূরুজ্জামানের সাক্ষাৎ প্রার্থী হন। বলেন, আমরা যেহেতু গ্রেপ্তার করিনি। তাই আমাদের এখানে রাখা ঠিক হবে না।

জবাবে পরিচালক বলেন, স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের ডিআইজি ই.এন চৌধুরীর অনুরোধেই এখানে রাখা হয়েছে। তারা পুলিশের হোয়াইট হলে রাখাটা নিরাপদ মনে করেন না। রক্ষীবাহিনীর দুই কর্মকর্তা সিরাজ সিকদারের সঙ্গে দেখা করতে যান। কয়েক মিনিট তার সঙ্গে কাটান। এ সময় নাকি সিরাজ সিকদার তাদেরকে ইংরেজিতে বলেন, ‘জানি আমার ভাগ্য লেখা হয়ে গেছে।’ আনোয়ারুল আলম পুলিশ কর্মকর্তা ই.এন চৌধুরীর বরাত দিয়ে লিখেছেন- পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কিছুটা নারীঘটিত কারণে সিরাজ সিকদার গ্রেপ্তার হন। আনোয়ারুল আলম তার বইতে মৃত্যুর খবরটি দেন এভাবে। দুদিন পর সকালে পত্রিকা খুলেই দেখি সিরাজ সিকদার নিহত।

সরকারি এক প্রেস নোটে বলা হয়, মানিকগঞ্জের দিকে তার এক ‘হাইড আউট’ দেখিয়ে দেবেন সে কারণে পুলিশ তাকে নিয়ে সেদিকেই যাচ্ছিলো। কিন্তু পথে সাভারের কাছে তিনি পালাতে চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। অ্যান্থনী মাসকারেনহাস ‘বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে লিখেছেন, সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তারের পর একটি আপোষ রফার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সিরাজ তাতে সায় দেননি।

সংসদেও সিরাজ সিকদারের মৃত্যু ও গ্রেপ্তার নিয়ে যে আলোচনা হয় তা আজও ঘুরে ফিরে আসে। চারু মজুমদার গ্রেপ্তার হন ১৯৭২ সালের ১৬ই জুলাই। এন্টালি রোডের এক বাড়িতে তিনি তখন আত্মগোপনে ছিলেন। ২৮শে জুলাই লালবাজারে কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তরে তাকে লকআপে রাখা হয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তবে সরকারিভাবে জানানো হয়, ভোর ৪টার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন। চলবে.... এমজমিন

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক মানজমিন।

১৮ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে