মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৬, ০১:৫৬:০৭

‌‘আমরা ভালো নেই, ফিরে যেতে ইচ্ছে করে প্রিয় বাংলাদেশে’

‌‘আমরা ভালো নেই, ফিরে যেতে ইচ্ছে করে প্রিয় বাংলাদেশে’

রতন বালো : বদলে গেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি। গুরুজনের সম্মান নেই। প্রকাশ্যে বসে মদের হাট। যেখানে-সেখানে বসে জুয়ার আসর। মানুষ খুন, অন্যের জমি দখল, হুমকি-ধামকি আর টাউট-বাটপারদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবন। বিশেষ করে ভারতের শিলিগুড়ি, জরপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি, ফালাকাটা, আলিপুর, কোচবিহার, রায়গঞ্জ, গাজোল, মালদা, বালুরঘাটসহ পশ্চিমবঙ্গের শহর ঘেঁষা জেলাগুলোতে এসব অত্যাচার একটু বেশি। আর এসব এলাকায় বাস বাংলাদেশ ত্যাগী হিন্দুদের।
 
সন্ত্রাসীদের হামলা, হুমকি-ধামকি, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ থেকে রক্ষা পেতেই তারা বাংলাদেশ ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন একটু শান্তির আশায়। কিন্তু প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে এসেও শান্তিতে নেই ৯০ ভাগ দেশত্যাগী। গত ১৮ মার্চ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত এসব এলাকা সরজমিনে ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

ভারতের রায়গঞ্জের রূপহারের ইটভাটা এলাকায় ১৬ বছর বয়সী অনিমা সরকারকে নিয়ে বিধবা রিনা রানী ১৬ বছর ধরে বসবাস করছেন। স্বামী সুভাষ সরকার, দর্জির কাজ ছিল একমাত্র পেশা। ভারতে গিয়ে ভালো থাকবেন এই আশায় ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে দেশত্যাগ করেন তারা। বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের কৃষ্ণপুর ইউনিয়য়ের কৃষ্ণপুর গ্রামে ছিল সুভাষদের জন্মস্থান।

আগেই ভারতে পাড়ি জমানো শ্বশুড়ের জায়গায় ঘর তুলে মোটামুটি ভালোই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু প্রতিবাদী সুভাষ সরকারকে ভালো থাকতে দেয়নি আশপাশের লোকজন। অন্যায় কাজের জন্য মাঝে মধ্যেই প্রতিবাদ করাটাকে মেনে নেয়নি প্রতিপক্ষরা। আর তাই আজ থেকে ৩ বছর আগে রাত ৮টার দিকে কাজের কথা বলে সুভাষকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় চিহ্নিত কয়েকজন সন্ত্রাসী। এর দু’ঘণ্টা পরই খবর পাওয়া যায়, ইটভাটার কাছের একটি ডোবার মধ্যে সুভাষ পড়ে রয়েছে। এরপরই এলাকাবাসী ছুটে এসে সুভাষকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে।

জানা যায়, পরিকল্পতিভাবে সুভাষকে খুন করে ডোবার মধ্যে ফেলে মোটরসাইকেলে চাপা দিয়ে রাখা হয়। মোটরসাইকেলের মালিক প্রচার করতে থাকে সুভাষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কিন্তু তিনি পলাতক থাকায় অনেকের সন্দেহ হয়। অবশেষে ১ বিঘা জমি ও নগদ এক লাখ টাকার বিনিময়ে ওই মোটরসাইকেল মালিকের সঙ্গে আপোষ রফা হয়। কিন্তু এ দিয়ে আর কয়দিন।

স্বামীকে হারিয়ে এখন অথৈ সাগরে ভাসছেন রিনা রানী। দু’বেলা দু’মুটো ভাত জোগানো খুব কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মনে নতুন শঙ্কা, মেয়ে এখন বিবাহযোগ্য, শত্রুদের নজর যেন না লাগে। বিবাহযোগ্য মেয়েকে নিয়ে মানসম্মানের ভয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে রিনা রানীকে।

অপরদিকে নব্বই দশকে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন পঞ্চাশোর্ধ সাধুচরণ সরকার। তিনি বলেন, ‘মানসম্মানের ভয়ে অঢেল ধন-সম্পদ ফেলে ভারতে এসেও শেষ সম্মানটুকু ধরে রাখতে পারলাম না। দু’বেলা দু’মুটো ভাতের জন্য জন দিয়ে (কামলা খেটে) চলতে হচ্ছে। এরচেয়ে বড় অসম্মান আর কী হতে পারে? অভাবের কষাঘাতে আমাদের সংসার থেকে সুখ দূরে সরে গেছে। এ কারণে বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে আসা অনেক প্রিয়জন আমাদের সঙ্গে দেখা করেন না। ভিন্ন পথ দিয়ে চলে যান। এর চেয়ে আমাদের মরে যাওয়া অনেক ভালো।’

ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুশমন্ডি থানার সুকান্ত পল্লীতে স্ত্রী ইতি রানী সরকার, বড় ছেলে মানিকচাঁদ সরকার ও ছোট ছেলে সুজন সরকারকে নিয়েই বাস করছেন সাধুচরণ। তাদের ঠিকানা এখন ১০ বাই ১৬ ফুটের একটি ঘর। চারজনে গাদাগাদি করে থাকেন। ওই ঘরে যাওয়া-আসার জন্য কোনো রাস্তাও নেই। অন্যের জায়গার ওপর দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। এ নিয়েও পড়শীদের গালমন্দ শুনতে হয় নিয়মিত।

বাংলাদেশের দক্ষিণ মানিকগঞ্জের কৃষ্ণপুর গ্রামের মৃত কানাইলাল সরকারের ছোট ছেলে সাধুচরণ। গোলা ভরা ধান আর সব সময় গোয়ালে থাকতো দুগ্ধবতী গাভী। সবকিছু মিলে তাদের সংসার সুখেরই ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে তাদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। মামলা-হামলা পর্যন্ত করা হয় তাদের বিরুদ্ধে। নানা যন্ত্রণা-গঞ্জনা সহ্য করে থাকতে হয় তাদের। পরবর্তী সেই অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে নব্বই দশকের শেষ দিকে বাধ্য হয়ে তারা ভারত চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, ভারতে গিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারবেন।

নামমাত্র দামে পৈতৃক বাড়ি ও জমি বিক্রি করে প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা শহরঘেঁষা একটি পল্লীতে বাড়ি করেন সাধুচরণ। প্রথমদিকে ভালোই ছিলেন। কিন্তু বছর তিনেক যেতে না যেতেই স্থানীয়দের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। অবশেষে বাধ্য হয় বাড়িটি বিক্রি করে দিতে হয়। কিন্তু বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অন্যস্থানে জায়গা-জমি কিনতে পারেননি। গচ্ছিত টাকা চলে যায় সংসারের পেছনে।

পরে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুশমন্ডি থানার সুকান্ত পল্লীতে মাত্র ১৭ শতাংশ জায়গা কেনেন তিনি। এ জায়গা কিনতেই অবশিষ্ট টাকাও শেষ হয়ে যায়। মাথা গোঁজার মত ১০ ফুট বাই ১৬ ফুট সাইজের একটি খড়ের ঘর তোলেন। এক সময়ের বিত্তশালী পরিবারটি হয়ে যায় ছিন্নমূল।

গত ২২ মার্চ বিকেল ৪টায় ছিন্নমূল এ পরিবারের সঙ্গে আলাপকালে সাধুচরণ সরকার বলেন, ‘বাংলাদেশের সোনার সংসার ফেলে এখন হয়েছি কাঙাল। ছেলে দু’টোকে ঠিকমত লেখাপড়া করাতে পারি নাই। অন্যের বাড়িতে কাজ করতে পাঠিয়েছি। আর আমরা স্বামী-স্ত্রী কেরালা, আন্দামান প্রদেশ, মধ্য প্রদেশে চলে যাই কাজের সন্ধানে। এভাবেই চলছে আমাদের সংসার।’

শুধু সাধুচরণ নয়। তার মতো যারা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের শতকরা ৯০ ভাগেরই এ অবস্থা। মূলত ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই হিন্দুরা বাংলাদেশ ত্যাগ করতে শুরু করেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, ভারতে গিয়ে অন্তত খেয়ে পরে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবেন। কিন্তু বিধি বাম। বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর, বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, গাজোল, মালদা, নদীয়াসহ জেলাগুলোতে দেশত্যাগী যে হিন্দুরা বাস করছেন তাদের মধ্যে এখন শুধুই হতাশা। আর তাই বর্তমান প্রজন্মের ছেলেরা নানা অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

উত্তর দিনাজপুরের কুশমন্ডি থানার বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ড ঘেঁষা বুনিয়াদপুরের বাসিন্দা নব্বইঊর্ধ্ব ভাষাণ সরকার (ভাষাণ মাস্টার)। পেশার ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হামলার ভয়ে শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে ১৯৮৫ সালে চলে যান ভারতে। তিনি এখনও অবসর ভাতা তুলতে পারেননি। আদৌ তুলতে পারবেন কি না তাও জানেন না।

ভাষাণ সরকার বলেন, ‘মাতৃভূমির জন্য এখনও মন কাঁদে। যে দেশে আমার জন্ম হয়েছে। শিশু, শৈশব, যৌবন- বলতে গেলে জীবনের বেশির ভাগ সময় প্রিয় দেশ বাংলাদেশে কাটিয়েছি। এখনও ঘুমের ঘরে স্বপ্ন দেখি আমাদের ফেলে আসা গ্রামটিকে।’

রায়গঞ্জ শহড়ঘেঁষা রূপহারের বাসিন্দা কিরণ চন্দ্র মন্ডল জানান, উত্তরবঙ্গের পশ্চিমবঙ্গ এলাকায় শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ প্রকাশ্যে মদ্য পান করে। প্রকাশ্যে বসে মদের হাট। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার মোড়ে বসে জুয়ার আসর। সব মিলিয়ে আমরা মানসম্মান বজায় রেখে সামনের দিনগুলো ভালোভাবে চলতে পারবো কি না এ নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছি।

গাজোল শহরের নেতাজী সুভাষ পল্লীতে কথা হয় প্রবীণ শিক্ষক জ্ঞানরঞ্জন রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখানে একজন প্রবীণ ব্যক্তির সম্মান নেই। একজন ভালো শিক্ষকের সম্মান নেই। মাতৃভূমির প্রতি যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ছিল, সেটা এখানে আর পাওয়া যাবে না। শুধু মানসম্মানের ভয়ে গত ৩০ বছর হয় বাংলাদেশের পাবনা থেকে এসেছি। পাবনায় আমাদের বেশ প্রভাব ছিল। সে প্রভাবটা এখানে এসে হারিয়েছি। সামনের দিনগুলো ভালোভাবে কাটিয়ে যেতে পারলেই শান্তি।’

গাজোলের অপর বাসিন্দা দুলাল মণ্ডল বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা অনেকেই এখানে কিছু করতে না পেরে আবার বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছেন। মানিকগঞ্জের খাবারপুর গ্রাম থেকে আসা ক্ষেত্র মাস্টার এখানে কিছু করতে না পেরে বর্তমানে মেয়ের বাড়িতে অবস্থান করছেন।’

গাজোলে বাড়ি করেছিলেন মানিকগঞ্জের বালিরটেক গ্রামের নিতাই চন্দ্র রায়। তিনি কোনো অবস্থান তৈরি করতে না পারায় গাজোলের বাড়ি বিক্রি করে ফিরে এসেছেন বাংলাদেশে। তার মতো অনেকেই বিক্রি করতে চাচ্ছেন। তবে ভোটার আইডি, রেশন কার্ডসহ নানা আইনি জটিলতার কারণে ঠিকঠাকমত বাড়িও বিক্রি করতে পারছেন না।

রায়গঞ্জের রূপহার এলাকার বাসিন্দা দুলাল সরকার। অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে ছেলেকে রক্ষা করতে পারেননি। অভাবের কারণে ডাকাতি, চুরিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে তার ছেলে। অতিসম্প্রতি রায়গঞ্জ শহরে ডাকাতি করতে গিয়ে জনতার হাতের গণপিটুনিতে সে মারা যায়।

দক্ষিণ-দিনাজপুর জেলার বুনিয়াদপুর থানার নকশাল হাট এলাকার বাসিন্দা গৌরাঙ্গ সরকার বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জের কৃষ্ণপুর বারারচর গ্রামে। পাঁচটা পুকুর ছিল। সারাবছর পুকুরে মাছ খেয়েও বিক্রি করে প্রচুর আয় করা যেতো। এখানে এসে একটা পুকুরও করতে পারি নাই। মন কাঁদে জন্মভূমির জন্য।’

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা যখন বাংলাদেশ থেকে আসি, তখন ওই দেশের ভিন্ন ধর্মের মানুষরা এদেশে আসতো। তারা সহযোগিতাও করেছে। তাদের জন্য মন এখনও কাঁদে।’
প্রকাশ্যে বসে মদের হাট

বুনিয়াদপুর এলাকার তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ভক্ত সরকার বাংলামেইলকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা এখানে এসে তেমন কিছুই করতে পারেনি। শুধু খেয়ে পরে বেঁচে আছেন। এখানে দেশপ্রেম নেই কারও মনে। যার যার মত নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে সবাই।’

তবে ভারত সরকার ভারতীয় নাগরিকদের জন্য সারাবছর রেশনিং ব্যবস্থা করেছে। বেকার ভাতা, অসহায়দের বাড়ি করে দেয়া, হাউস লোনসহ নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করেছে বলে তিনি জানান। -বাংলামেইল
১৯ এপ্রিল ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে