বুধবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৬, ০২:৪৫:৩০

শফিক রেহমানের বাসায় তল্লাশি করে যা যা জব্দ করেছে ডিবি

শফিক রেহমানের বাসায় তল্লাশি করে যা যা জব্দ করেছে ডিবি

নিউজ ডেস্ক : রিমান্ডে থাকা প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে সঙ্গে নিয়ে তার বাসায় তল্লাশি চালিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রমনা থানার ইস্কাটন গার্ডেন রোডের ১৫ নম্বর বাসায় তার পড়ার কক্ষ ও ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তল্লাশি চালান ডিবি পুলিশ সদস্যরা।

এ সময় বাংলাদেশ ও বৃটেনের দ্বৈত নাগরিক শফিক রেহমানের দু’দেশের দু’টি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। তার আরও দু’টি ব্যক্তিগত ফাইলও পুলিশ নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। গত শনিবার সকালে ওই বাসা থেকে সাংবাদিক পরিচয়ে তাকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়ার চতুর্থ দিন এই তল্লাশি চালানো হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় গ্রেপ্তারের পর তিনি পাঁচ দিনের পুলিশি রিমান্ডে রয়েছেন।  

শফিক রেহমানের স্ত্রী তালেয়া রেহমান বলেন, ডিবি পুলিশ সদস্যরা তাকে নিয়ে বাসার তৃতীয় তলায় তার পড়ার কক্ষে যান। দশ-বারোজন ভেতরে ঢুকেন। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতেও তল্লাশি চালান। সেখানে তারা তার কিছু ফাইল বেশ সময় নিয়ে পড়ে দেখেন। এরপর দু’টি ফাইল নিয়ে যান। শফিকের বাংলাদেশ ও বৃটিশ পাসপোর্ট দু’টিও নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশি পাসপোর্টটি মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গতকাল বেলা সাড়ে ১২টার দিকে একটি পুলিশ ভ্যান ও দু’টি মাইক্রোবাস শফিক রেহমানের বাসার সামনে এসে থামে। এর একটিতে ছিলেন শফিক রেহমান। তাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামেন ডিবি ও রমনা থানার পুলিশ সদস্যরা। এরপর তারা প্রথমে বাসার এক দারোয়ানের কাছে তালেয়া রেহমান বাসায় আছেন কিনা জানতে চান। ওই দারোয়ান তালেয়া বাসায় নেই বলে জানালে শফিক রেহমানকে নিয়ে তারা বাসায় না ঢুকে আবার গাড়ির দিকে এগিয়ে যান। কেউ কেউ গাড়িতে চড়েও বসেন। এ সময় তাদের একজন বাসার অন্য লোকের কাছে জানতে পারেন যে তালেয়া রেহমান বাসাতেই আছেন। তখন তারা আবার বাসার দিকে এগিয়ে যান। সরাসরি তৃতীয় তলায় শফিক রেহমানের পড়ার কক্ষে উঠে যান। সেখানে তালেয়া রেহমানের সঙ্গে তাদের দেখা হয়। এরপর শুরু হয় তল্লাশি। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতেও তল্লাশি চালানো হয়। ব্যক্তিগত আর্কাইভ, বইপত্র উলট-পালট করে চলে তল্লাশি। সময় নিয়ে ঘেঁটেঘুঁটে দেখেন। তার একাধিক ফাইল পড়েও দেখেন ডিবি কর্মকর্তারা।

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম তল্লাশির পর সাংবাদিকদের বলেন, শফিক রেহমানের বাসায় তল্লাশি করা হয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজ জব্দ করার জন্য এই অভিযান চালানো হয়েছে। তিনি দাবি করেন, জয় সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সংরক্ষিত তথ্য পেতে ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় দণ্ডিতদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের কথা শফিক রেহমান স্বীকার করেছেন।

তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে ডিবি : ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, মামলার তদন্তের জন্য ডিবির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডিবির উপ-কমশিনার মাশরুকুর রহমান খালেদ। অপর দুই সদস্য অতিরিক্ত উপ-কমশিনার রাজীব আল মাসুদ ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী কমিশনার হাসান আরাফাত।

এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের নিন্দা : স্বাধীন মতপ্রকাশ স্তব্ধ করে দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানের গ্রেপ্তারে তীব্র নিন্দা জানিয়ে দেয়া এক যৌথ বিবৃতিতে একথা বলেছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস (এফআইডিএইচ) ও ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন এগেইন্সট টর্চার (ওএমসিটি)।

বিবৃতিতে বলা হয়, কর্তৃপক্ষের সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য বেশ ক’জন সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক বানোয়াট অভিযোগে স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তারের সম্মুখীন। ৮১ বছর বয়সী লেখক শফিক রেহমান একজন মৃত্যুদণ্ডবিরোধী প্রচারণাকারী, টিভি উপস্থাপক এবং সাংবাদিক। বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমন করতে বিচারিক ব্যবস্থার নিয়মতান্ত্রিক অপব্যবহারের সাম্প্রতিক ভুক্তোভোগী তিনি। ১৬ই এপ্রিল ভোরে সাদা পোশাকের পুলিশ নিজেদের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক বলে মিথ্যা দাবি করে তার বাড়িতে ঢোকে এবং প্রবীণ এই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে। শফিক রেহমান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন বৃটিশ নাগরিক।

ওই পুলিশ সদস্যদের কাছে তাকে গ্রেপ্তারের কোনো পরোয়ানা ছিল না। রেহমানকে ডিবি পুলিশ সদরদপ্তরে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ তাকে ২০১৫ সালের আগস্টে নিবন্ধিত একটি অপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। ওই মামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্র’ করার অভিযোগ রয়েছে। জয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ইমিগ্র্যান্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রেহমানকে ৫ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর শঙ্কা রিমান্ডে তাকে নির্যাতন করা হতে পারে।  
 
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সরকারের সমালোচক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার আর বানোয়াট অভিযোগ আনার সাম্প্রতিক নানা ঘটনার মধ্যে সর্বশেষ ঘটনা হলো রেহমানের গ্রেপ্তার। প্রথিতযশা সাংবাদিকসহ আরও অনেক ব্যক্তি বর্তমানে আটক রয়েছেন। তারা কয়েক ডজন বানোয়াট ও মিথ্যা অপরাধ মামলার মুখোমুখি।

বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৩ সালের ১১ই এপ্রিল সরকার দৈনিক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাকে জড়িয়ে একটি দুর্নীতি কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়। স্বেচ্ছাচারীভাবে ইতিমধ্যে মাহমুদুর রহমান ৩ বছরের বেশি সময় ধরে আটক রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বর্তমানে ফৌজধারি মামলা রয়েছে ৭৭টি। বিগত বছরগুলোতে আদালত মাহমুদুর রহমানের জামিন মঞ্জুর করেছেন কয়েক বার। তবে প্রতিবারই পুলিশ তার মুক্তি ঠেকাতে নতুন ফৌজধারি মামলা উপস্থাপন করেছে।    

এতে বলা হয়, একুশে টিভি’র চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে পর্নোগ্রাফির অভিযোগে ৬ই জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়। তার মালিকানাধীন বেসরকারি টিভি চ্যানেলটিতে বিএনপির নির্বাসিত সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারের পর তার বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়।

সাপ্তাহিক ইকোনমিকস টাইমস-এর সমপাদক শওকত মাহমুদকে ১৮ই আগস্টে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে এখন ২৪টি বানোয়াট মামলা করা হয়েছে। তিনি বিরোধী দলের সঙ্গে সমপৃক্ত। সরকারের সমালোচক হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। মাহমুদুর রহমানের মতো শওকত মাহমুদের বেলায়ও আদালত জামিন প্রদান করা মাত্রই নতুন মামলা করে তাকে আটক করে পুলিশ।

এতে বলা হয়, ২০০৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে ডেইলি স্টারের সমপাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির ৭৯টি মামলা করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনগুলো করা হয়েছিল যাচাইহীন তথ্যের ভিত্তিতে। মাহফুজ আনাম পরে বলেন, ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করাটা ভুল ছিল। কিন্তু এরপরও তার বিরুদ্ধে ১৭টি রাষ্ট্রদ্রোহ ও ৬২টি মানহানির মামলা করা হয়। ১১ই এপ্রিল, হাইকোর্ট ওই ৭২টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। কিন্তু এখনও ওই মামলাগুলোতে তাকে দণ্ড দেয়া হলে, ১৭৫ বছর সাজা ভোগ করতে হবে।

বিচার কাঠামোকে অপব্যবহার করে সাংবাদিকদের স্তব্ধ ও হয়রানি করার ফলে ভয়ের ও ‘সেলফ-সেন্সরশিপে’র পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ ও তাদের বাছবিচারহীনভাবে আটক করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন। বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসও এসব আইনের অন্যতম। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সেপশাল প্রসিউডিউরসকে অবশ্যই বাংলাদেশে মুক্ত মতপ্রকাশের ওপর নিপীড়ন বন্ধে সক্রিয় হতে হবে। শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমান, আবদুস সালাম, শওকত মাহমুদসহ মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকার চর্চার ফলে আটককৃত সব সাংবাদিক ও ব্যক্তিবিশেষকে অবশ্যই অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।  সূত্র : মানবজমিন

২০ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে