বুধবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৬, ০৪:৩৭:৪৩

কমিটি নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে বিএনপিতে

কমিটি নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে বিএনপিতে

মাহমুদ আজহার : বিএনপির সদ্য ঘোষিত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব হারুন অর রশীদ। বিগত আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে দেখা যায়নি তাকে। প্রায় সারা বছরই থাকতেন ঢাকায়। বিগত সাত বছরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে তার বিরুদ্ধে নেই কোনো মামলাও। তারপরও সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন যুগ্ম মহাসচিব।

চট্টগ্রাম উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরী। ২০০৮ সালে বিএনপিতে যোগ দেন তিনি। এর আগে তিনি অন্য একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে নেতা-কর্মীদের মুখে মুখে। চট্টগ্রাম জেলা উত্তর শাখার কমিটিও দিতে পারেননি। তারপরও পদোন্নতি পেয়ে সরাসরি বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হয়েছেন।

এ নিয়ে চট্টগ্রাম বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিক্ষোভ বিরাজ করছে। চট্টগ্রামে বিএনপি নেতৃত্বে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। শুধু এই দুই নেতাই নন—সদ্য ঘোষিত নির্বাহী কমিটির ৪২ জনের (আংশিক) নাম ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে একটি অংশই বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন না। তাদের পদোন্নতিতে হতবাক সবাই। দলের ভিতরে-বাইরে চলছে নানা সমালোচনা।

অবশ্য একটি অংশকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা বিবেচনায় কমিটিতে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। তারা লন্ডন ও ঢাকায় গুডবুকে ছিলেন। বড় অংশই অনেকটা লবিং ও তদবির করেই কমিটিতে পদোন্নতি পেয়েছেন। সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলার অভিযোগও আছে পদোন্নতি পাওয়া কোনো নেতার বিরুদ্ধে। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড কিংবা আন্দোলনে কোনোটাতেই ভূমিকা ছিল না—তারাও প্রমোশন পেয়েছেন। এতে দলের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন নেতা-কর্মীরা।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কমিটি ঘোষণার আগে একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বিগত আন্দোলনে ত্যাগী ও যোগ্যদের কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে দেওয়া হবে। নিষ্ক্রিয়দের পদাবনতি করা হবে। বিএনপির নেতারা বলছেন, অনেকাংশে উল্টোপথেই ঘোষিত হচ্ছে কমিটি। ম্যাডামকে চাপে রেখে ক্ষুদ্র একটি মহল নিজেদের মতো করে কমিটি বাগিয়ে নিচ্ছেন। ঘোষিত কমিটি নিয়ে মন্তব্য করতেও চান না বিএনপির সিনিয়র নেতারা। এ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন তারাও।

কারণ, এখনো স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ ঘোষণা করা হয়নি। তাই নিম্ন সারির কোনো নেতা সম্পর্কে জোরালো কোনো মতামতও দিতে পারছেন না স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। নিজেদের পদ নিয়েই টেনশনে সময় কাটছে তাদের। তবে ঘোষিত কমিটিতে তারাও কিছুটা হতাশ হয়েছেন।

জানা যায়, ধাপে ধাপে কমিটি ঘোষণার পরও অসন্তোষ বাড়ছে বিএনপিতে। ঘোষিত আংশিক কমিটিতে বিগত আন্দোলনে থাকা ত্যাগী ও মামলায় জর্জরিত নেতারা অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছেন বলেও দলের ভিতরে-বাইরে আলোচনা হচ্ছে। অবশ্য প্রকাশ্যে এ নিয়ে কেউই মুখ খুলছেন না। অনেকেই কেন্দ্রীয় পদ ছেড়ে রাগে ক্ষোভে জেলা নেতৃত্বেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ রাজনীতি ছাড়ারও চিন্তাভাবনা করছেন।

বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, ‘যেভাবে কমিটি ঘোষণা করা হচ্ছে, তাতে বিএনপির একজন প্রাথমিক সদস্য হিসেবেই থাকতে চাই। এটা নিয়েই আমরা গর্বিত থাকবো। স্থায়ী কমিটি ও ভাইস চেয়ারম্যান পদেও চেইন অব কমান্ড থাকবে বলে মনে হয় না। এই কমিটি দিয়ে ভবিষ্যতে আন্দোলন সংগ্রাম করে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিএনপির একাধিক নেতা জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচনে হারুন অর রশীদ ৩ নম্বর হয়েছেন। পৌরসভা নির্বাচনে তার মনোনীত প্রার্থীও হয়েছে ৩ নম্বর। ‘বিএনপির ঘাঁটি’ বলে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ তাদের কারণেই ক্ষত-বিক্ষত। জেলা এতটাই অগোছালো যে, সদরে ইউপি নির্বাচনে ১৩টির মধ্যে ৪টিতে প্রার্থীই দিতে পারেনি।

এ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নেতা-কর্মীদের বড় অংশই ক্ষোভে ফুঁসছে। তারপরও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এটা নেতা-কর্মীদের কাছে স্পষ্ট যে, রাজশাহী বিভাগের রাজনৈতিক মেরুকরণে প্রভাবশালী দু-একজন নেতার কারণেই হারুন অর রশীদের ভাগ্য খুলে গেছে। তবে নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে হারুন অর রশীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তার বিরুদ্ধে মামলা নেই—এটা ঠিক না। তার বিরুদ্ধে তিন মামলা রয়েছে। দুটিতে জামিন পেয়েছেন।

যুগ্ম মহাসচিব পদে পদোন্নতি প্রসঙ্গে বলেন, ‘আন্দোলন সংগ্রামে না থাকলে কি ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) আমাকে যুগ্ম মহাসচিব করতেন? চেয়ারপারসন যোগ্যদেরই যুগ্ম মহাসচিব বানিয়েছেন। দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে অতীতের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যারা বলছেন, তারা হয়তো না পাওয়ার বেদনা থেকেই বলছেন।’

দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম। বিএনপির সদ্য ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটির রংপুর বিভাগের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক। জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক। আন্দোলন সংগ্রামে তার উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকাই ছিল না। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে অনেকটা ‘ম্যানেজ’ করে চলতেন। জেলার যুগ্ম সম্পাদক থেকে পদোন্নতি পেয়ে দলের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন। রংপুর বিভাগের নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশই এ নিয়ে অখুশি। সাবেক এমপি আবদুল মমিন তালুকদার। রাজশাহীতে নেতা-কর্মীদের কাছেও তিনি অপরিচিত মুখ। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামেও দেখা যায়নি তাকে। তিনিও আগের পদেই রয়েছেন।

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কমিটি ঘোষণার ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতাও লঙ্ঘন করা হয়েছে। একজন সাংগঠনিক সম্পাদকের অধীনে দুজন সহসাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে, তারা দুজনই সিনিয়র। আন্দোলন সংগ্রামেও ত্যাগ ছিল বেশি। তাই ওই সাংগঠনিক সম্পাদকের অধীনে কাজ করারও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এমন একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে অভিযোগ করেছেন, পদ পেলেও তারা নিষ্ক্রিয় থাকবেন।

চেয়ারপারসন বলেছেন, ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হবে। হয়তো নানা চাপে শেষ পর্যন্ত ম্যাডাম সেই অবস্থানে থাকতে পারেননি।

আন্দোলন সংগ্রামে থাকা একজন সহসাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, এখনো র‌্যাব-পুলিশের তালিকায় নাম রয়েছে। এলাকায় যেতে পারি না। এত মামলা-হামলা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করার পরও আমি সহসাংগঠনিক সম্পাদক। আর যারা ঝুঁকিমুক্ত ছিলেন, ম্যানেজ করে চলেছেন, তাদেরই যোগ্য পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

ঘোষিত কমিটিতে ফজলুল হক মিলন ও আসাদুল হাবিব দুলুকে আগের পদেই রাখা হয়েছে। খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মশিউর রহমানকে কোনো পদেই রাখা হয়নি। এ নিয়েও নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশই অসন্তুষ্ট। বিগত আন্দোলনে ফজলুল হক মিলনের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা সমালোচনা রয়েছে। এমনটা কমিটিতে পদোন্নতি পাওয়া বড় অংশের বিরুদ্ধেও আছে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিএনপির নানা দুঃসময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সাবেক এই ছাত্রনেতা।

আসাদুল হাবিব দুলুও একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে রংপুর বিভাগের নেতা-কর্মীদের কাছে জনপ্রিয়। তাকেও পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। মশিউর রহমানকে কোথাও রাখা হয়নি। দলের ভাইস চেয়ারম্যান পদে থাকবেন কি না তাও নিশ্চিত নয়। ব্যক্তি প্রতিহিংসার শিকারে এই তিন নেতা গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ছিটকে পড়ছেন বলেও নেতা-কর্মীরা মনে করছেন।

রাজশাহী বিভাগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অ্যাডভোটেক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু যুগ্ম মহাসচিব হচ্ছেন—দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এমনটাই আলোচনায় ছিল। গণমাধ্যমেও এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। তিনি অনেকটা নিশ্চিতও ছিলেন। কিন্তু ব্যক্তি প্রতিহিংসার কাছে হেরে গেছেন দুলু। নাটোর জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, ২৫ বছর ধরে জেলা বিএনপির সভাপতিও অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। তার বিরুদ্ধে ৮০টি মামলাও রয়েছে। এর বড় অংশই ঢাকায়। যদি ত্যাগ তিতিক্ষা ও দলের সাংগঠনিক দিক বিবেচনা করা হতো তাহলে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু যুগ্ম মহাসচিব পদ পেতেন।

বিএনপির মধ্য সারির একাধিক নেতা অভিযোগ করেন, কমিটি ঘোষণায় দলের সিনিয়র নেতাদের মতামত তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। দু-একজন ব্যক্তি ম্যাডামকে নানাভাবে প্রভাবিত করছেন। যারা দলের সাংগঠনিক রাজনীতি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই। এমনভাবে পদোন্নতি নেতাদের উপস্থাপন করা হচ্ছে, যা তাদের পদের সঙ্গেও এক ধরনের প্রতারণার শামিল। এক্ষেত্রে লন্ডনে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মতামতও তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন ওই নেতারা। -বিডি প্রতিদিন
২০ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে