ফয়সাল আতিক : তিন বছর আগে যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন শুরুর পর গণজাগরণের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারকে ‘সরকারের এজেন্ট’ আখ্যায়িত করেছিল বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকরা।
শাহবাগ আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক’ আখ্যায়িত করে গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিল হেফাজতে ইসলামের পক্ষে অবস্থান নেওয়া বিএনপি। শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে ইমরানের এক স্ট্যাটাস নিয়ে তিন বছর পর এখন উল্টে গেছে চিত্র।
ইমরানকে ‘সুবিধাবাদী’ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের স্ট্যাটাসের পর এখন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রের সমালোচনায় মুখর আওয়ামী লীগ সমর্থকরা।
বিপরীতে গণজাগরণবিরোধী এবং বিএনপি সমর্থকদের মধ্য থেকে এখন দেখা যাচ্ছে ইমরানের পক্ষে দাঁড়াতে। হেফাজতের পক্ষে দাঁড়িয়ে গণজাগরণ আন্দোলনের বিরোধিতাকারী ফরহাদ মজহারও তার পক্ষে লিখেছেন।
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার পাশে থাকা হেফাজত নেতারা এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইসলামের পক্ষে ‘জোরাল অবস্থানের’ প্রশংসা করছেন।
শেখ হাসিনার প্রশংসা করছেন গণজাগরণবিরোধী হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীও।
রংপুর মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগ নেতা ইমরান ২০১৩ সালে ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক হিসেবে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রের দায়িত্বে আসেন।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ঝড়তোলা আন্দোলনের কারণে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে সারাদেশেই পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে জয়কে অপহরণের ষড়যন্ত্রের মামলায় বিএনপিঘনিষ্ঠ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গত শনিবার গ্রেপ্তারের পর ইমরান ফেইসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, “শফিক রেহমানের রাজনৈতিক আদর্শের সাথে আমি একমত নই। ভিন্নমতের হলেই তাকে দমন করার যে নোংরা রাজনৈতিক অপকৌশল, এর একটা অবসান চাই।”
জয় তখন ইমরানকে ‘মিথ্যাবাদী ও সুবিধাবাদী’ আখ্যায়িত করে তাকে বর্জনের আহ্বান জানালে একে ‘স্বাধীন মত প্রকাশের হুমকি’ বলে প্রতিক্রিয়া জানান গণজাগরণের মুখপাত্র।
শফিক রেহমানের পক্ষে ইমরানের প্রতিক্রিয়াকে ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ আখ্যায়িত করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন ফেইসবুকে লিখেছেন- “পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে।”
তিনি লিখেছেন, “ইমরান এখন যুদ্ধাপরাধী ও খালেদা জিয়ার ভাষায় বর্তমান সরকারকে আক্রমণ করে নিজের স্বরূপ উন্মোচন করেননি; কার সুতার টানে পুতুল নাচ হচ্ছে, তা-ও কিন্তু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।”
এককালের ছাত্রলীগকর্মী ডা. ইমরানের উপর ভরসা করেছিলেন জানিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে আসা লেনিন বলেন, “কিন্তু অচিরেই আমরা দেখতে পেলাম, ইমরান প্রথমে গণবিচ্ছিন্ন বামদের খপ্পরে পড়ে। পরে মানুষের ঢল দেখে নিজেকে অতিমূল্যায়ন করতে শুরু করে।
“তার ‘আমি কি হনুরে ভাব’ পরীক্ষিত সহকর্মীদের কাছ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে। সবশেষে সর্বসম্মত আন্দোলনকে মহল বিশেষের এজেন্ডা বাস্তবায়নের ফাঁদে টেনে নেয়। ইমরান ও বামদের হঠকারী কর্মকাণ্ডের ফলে মূলধারার ছাত্র সংগঠনসমূহ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি গণজাগরণ মঞ্চ থেকে দূরে সরে আসে।”
২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির সমাবেশে ইমরান ‘সকল রাখঢাক খুলে ফেলে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসে’ বলেও মন্তব্য করেন লেনিন।
ইমরানের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, “গণজাগরণ মঞ্চকে সরকারবিরোধী মঞ্চে পরিণত করে ইমরান ও তার সহযোগীরা যে ইতোমধ্যে সার্কাসের ক্লাউনে পরিণত হয়েছে, সম্ভবত এই কাণ্ডজ্ঞানটুকুও তারা হারিয়ে ফেলেছে।
“ইমরানের এককালের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের কাছ থেকেই শুনেছি, ইমরান কেবল বামদের নয়, দেশি-বিদেশি নানা সন্দেহভাজন শক্তি, সংস্থা ও ব্যক্তির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছেন। তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাই তার লক্ষ্য।”
লেনিনের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইমরানের পক্ষে দাঁড়িয়ে কলামনিস্ট ফরহাদ মজাহার তার ফেইসবুক পাতায় লিখেছেন, “যে পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্তব্য (পিপীলিকার...) তাতে নূহ আলম লেনিন আসলে বলছেন, ইমরান এখন নিছকই একটি তুচ্ছ ‘পিপীলিকা’।
“শফিক রেহমান প্রসঙ্গে ইমরানের স্টেটাসের কারণে একদা বীর ইমরান হঠাৎ পিপীলিকা বনে গেলো!হায় ফ্রানৎজ কাফকা!!! হায় মেটামরফসিস! হায় নূহ আলম লেনিন।”
“ভীতি ও আতংকের দিকটা হল, আসলে নূহ আলম লেনিন ইমরানকে মরবার জন্য প্রস্তুত থাকবার হুমকিই কি দিলেন না? হে ইমরান তোমার পাখা গজিয়েছে, তুমি এবার মরার জন্য প্রস্তুত হও! সাব্বাশ নূহ আলম।”
গণজাগরণ আন্দোলনকে ‘শেখ হাসিনার শাহবাগী তামাশা’ যিনি বলেছিলেন, সেই ফরহাদ মজহার এখন ইমরানের পক্ষে দাঁড়ানোর যুক্তি দিয়েছেন এভাবে- “গণজাগরণ আন্দোলনকে যখন ভুল ও ক্ষতিকর মনে করেছি, তখন আমরা ইমরান এইচ সরকারের বিরোধিতা করেছি। দেশকে বিভক্তি হানাহানির দিকে ঠেলে দেওয়া এবং একটি দানবীয় শক্তিকে ক্রমাগত শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে ইমরান এইচ সরকারের অবদান অপরিসীম।
“কিন্তু শফিক রেহমান সম্পর্কে ইমরান এইচ সরকারের বর্তমান অবস্থান ভুল নয়, সঠিক। অতএব তাকে সমর্থন করাই কাজ। আমরা তাকে সমর্থন করি বিশেষত এখন যখন তার ‘পাখা ওঠার কারণে’ তাকে মরবার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন মানবাধিকারকর্মী হিসাবে আমাদের চুপ থাকা কঠিন।”
জয় যেখানে ইমরানকে বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন, তখন ফরহাদ মজহার লিখেছেন- ‘ইমরান এইচ সরকারকে সমর্থন করুন। তার পাতায় আরও বেশি বেশি করে লাইক দিন।”
ইমরানের অবস্থানকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্রে শফিক রেহমানের মুক্তি দাবিতে এক কর্মসূচিতে বক্তব্য এসেছে ‘তারেক পরিষদ আন্তর্জাতিক কমিটি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আকতার হোসেন বাদলের কাছ থেকেও।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল তার ফেইসবুক পাতায় লিখেছেন- “ইমরান সরকারকে আমরা কয়েকজন আনফ্রেন্ড করেছিলাম গণজাগরণ মঞ্চ শুরু হওয়ার দুই/তিন মাসের মধ্যেই। সেদিনই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম রাজনৈতিক ও নৈতিক মানদন্ডে এই লোক কতটা অসৎ!”
“শেখ হাসিনার সরকার রাজাকারের পাহারাদার- এই স্লোগান দেওয়ার পরেও আমাদের কতিপয় হেভিওয়েট তার সাথে সুসম্পর্ক রেখেছেন, তাকে চে গুয়েভারা বানাতে চেয়েছেন। আজ জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়ের স্ট্যাটাসের পর সেইসব বিজ্ঞদের টনক নড়েছে,” লিখেছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাকিল।
গণজাগরণ আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ লিখেছেন- “আমি আশ্চর্য হয়েছি ইমরান সরকারের বিষয়ে। সম্ভবত শেষ পর্যন্ত তার আসল চেহারাটা উন্মোচিত হল। এটা দেখে মনে হচ্ছে সে আমাদের বেশিরভাগ সুশীলের মতোই, আরেকটা সুবিধাবাদী এবং মিথ্যাবাদী। হয়ত বিএনপি তাকে পয়সা দিয়েছে।”
যাকে নিয়ে এখন এত আলোচনা, সেই ইমরান কী ভাবছেন?
বিএনপি সমর্থকদের পক্ষে দাঁড়ানোর বিষয়ে ইমরানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ইমরান বলেন, “নিজেদের পক্ষে গেলে সমর্থন, আর বিরুদ্ধে গেলে বিরোধিতা- এটা আমাদের রাজনীতির পুরনো সংস্কৃতি। আমরা সব ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি সবার সমর্থন থাকবে, এটাই আমি আশা করি। কেবল নিজেদের পক্ষের বিষয়গুলোতে নয়।”
নূহ আলম লেনিনের স্ট্যাটাস সম্পর্কে তিনি বলেন, “হ্যাঁ এটা রীতিমতো হুমকি। কারও মত পছন্দ না হলে সেটার বিরোধিতা করা যেতে পারে। কিন্তু সেজন্য হুমকি-ধমকি কাম্য নয়।
“জয় সাহেব আনফ্রেন্ড করতে বলেছেন কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্রলীগ কর্মীরা রীতিমতো জবাইয়ের হুমকি দিচ্ছে। আসলে আনফ্রেন্ড করা মানে তো জবাই করা না। বিষয়টি হুমকিদাতাদের বুঝতে হবে। জয় ভাইয়ের মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির এই বিরোধিতার সুযোগ কে কীভাবে নেবে, সেটাই হল উদ্বেগের ব্যাপার।”
শফিক রেহমানের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে ইমরান বলেন, “আমি তো তার রাজনৈতিক অবস্থানকে সমর্থন করিনি। তিনি একজন সাংবাদিক, এক সময় একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। সেকারণে তার গ্রেপ্তার নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু বিচারাধীন এই বিষয়ে যদি রায় তার বিরুদ্ধে যায়, তাহলে আর সাংবাদিক হিসেবে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি প্রযোজ্য হবে না।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির আন্দোলন থেকে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, পাশবিক নির্যাতন, রিজার্ভ চুরি নিয়েও কথা বলছেন ইমরান, যা থেকে তার রাজনীতিতে নামার আভাস পাচ্ছেন অনেকে।
কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করছেন কি না- জানতে চাইলে ইমরান বলেন, সেরকম কোনো ভাবনা এখনও তার নেই। যদি সে রকম কিছু ভাবনায় আসে, তবে তো সাংবাদিকদের জানাবই। -বিডিনিউজ
২০ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএস