শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৬, ০৩:০৯:১৯

ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুর মিছিল

ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুর মিছিল

মিজানুর রহমান ও তরিকুর রহমান সজীব: ভূমধ্যসাগরে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। অভিবাসীরা মারা যাচ্ছেন। উন্নত জীবন-জীবিকার আশায় সাগরপথে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ পাড়ি দিতেই প্রাণ হারাচ্ছেন তারা। যাদের লাশ মিলছে কিংবা পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে কেবল তাদের নামই হিসাবের খাতায় উঠছে। বাকিদের সলিল সমাধি ঘটছে। ওই মৃত্যুর মিছিলে উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক বাংলাদেশি থাকায় উদ্বেগ বাড়ছে ঢাকার। ভূমধ্যসাগর পাড়ের দেশগুলোর বিভিন্ন মিশন থেকে পাওয়া তথ্যে টনক নড়েছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। এ নিয়ে শঙ্কিত নীতিনির্ধারকরা। দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপে সেই শঙ্কার কথা জানান। বলেন, এটি খুবই উদ্বেগের বিষয় যে সাগরে আমাদের লোক মারা যাচ্ছে। তা-ও অবৈধভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার পথে। তাদের প্রকৃত হিসাবও পাওয়া যাচ্ছে না। একজন প্রবাসীরও এমন মৃত্যু কাম্য নয় মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা তো অসহায়! আমাদের কোনো উদ্যোগই তাদের ঠেকাতে পারছে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়া থেকেই এমন মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, নিশ্চিত বিপদ জানা সত্ত্বেও অনেকে স্ত্রী, সন্তান, পরিবার-পরিজন নিয়ে নৌকায় সাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের সামনে স্বপ্নের দেশ ইউরোপে পাড়ি দেয়ার হাতছানি। এ প্রবণতাই সর্বনাশ ডেকে আনছে। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনার করুণচিত্র উঠে এসেছে এক বাংলাদেশির বর্ণনায়। চলতি সপ্তাহের শুরুর একটি দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে গেছেন ওই বাংলাদেশী। ওই ঘটনায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। বিবিসির রিপোর্ট মতে নৌকার ৮০০ অভিবাসী সাগারে মারা গেছেন। জাতিসংঘের বরাত দিয়ে সিএনএন অবশ্য বলেছে, তারা ৫ শতাধিক মৃত্যুর আশঙ্কা করছে। সিএনএনের রিপোর্টেই বেঁচে যাওয়া এক বাংলাদেশির বর্ণনা স্থান পেয়েছে। সেখানে তিনি বলছেন, নৌকাডুবির সময় অনেককেই নৌকার মধ্যেই বদ্ধ কুঠুরিতে থাকতে হয়েছে। ইতালির কাতানিয়ায় এক সরকারি কৌঁসুলিও এমন বিবৃতি দিয়েছেন। বাংলাদেশি এই শরণার্থীর বর্ণনা থেকে উঠে এসেছে সমুদ্রের মধ্যে ভাসমান অবস্থায় কীভাবে দিনযাপন করতে হয়েছে অসহায় শরণার্থীদের। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উদ্ধারকারী দল শরণার্থীবাহী নৌকার নিকটবর্তী হলে শরণার্থীরা উদ্ধার পাওয়ার আশায় নৌকার একপাশে জড়ো হতে থাকেন। আর সে কারণেই নৌকাটি লিবিয়ার প্রায় ১১০ কিলোমিটার উত্তরে উলটে যায়। পরে নৌকা ডুবে যেতে থাকলে কয়েকজনকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন উদ্ধারকর্মীরা। উদ্ধার পাওয়াদের একজন হলেন ওই বাংলাদেশি। তিনি তদন্তকারীদের জানান, ওই নৌকায় প্রায় সাড়ে নয় শ শরণার্থী ছিলেন। এর আগে ইতালিয়ান উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে কাজ করা মালটা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, তারা ওই নৌকার ৭০০ শরণার্থীর মধ্যে ৫০ জনকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে। বাংলাদেশি ওই শরণার্থীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে সরকারি কৌঁসুলি বলেন, নৌকার নিচের দিকে অনেকেই বন্দিদশায় ছিলেন। কারণ পাচারকারীরা তাদের দরজাবদ্ধ অবস্থায় রেখেছিল। তিনি জানান, উদ্ধার পাওয়া অন্যদের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করছেন কোস্টগার্ডের সদস্যরা। লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে এই নৌকার যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ, আলজেরিয়া, মিশর, সোমালিয়া, নাইজার, সেনেগাল, মালি, জাম্বিয়া ও ঘানার নাগরিকরা। নৌকাডুবির এ ঘটনার পর মালটার প্রধানমন্ত্রী জোসেফ মুসক্যাট মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কড়া মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘অপরাধীচক্র কখনও কখনও মানুষদের বন্দুকের মুখে নৌকায় তুলছে। প্রকৃতপক্ষে তারা মানুষদের মৃত্যুর পথে ধাবিত করছে। এটা গণহত্যা, প্রকৃত অর্থেই গণহত্যার চেয়ে কম নয় এটা।’
মৃত্যুযাত্রা লিবিয়া টু ইতালি: এদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়া থেকে সরকারি উদ্যোগে কয়েক হাজার বাংলাদেশিকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে উল্লেখ করে এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে ফিরতে আগ্রহ দেখিয়েছেন এমন কাউকে ফেলে আসা হয়নি। আগ্রহী প্রায় সবাইকে নিয়ে আসা হয়েছে। এখনও দেশটিতে প্রায় ৩০ হাজারের মতো বাংলাদেশি রয়েছেন এবং প্রায় ৩-৪ হাজার বাংলাদেশি দেশটিতে যাওয়ার চেষ্টা করছেন জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, লিবিয়া টু ইতালি অবৈধ অভিবাসীদের একটি প্রতিষ্ঠিত নৌ-রুট হয়ে গেছে। ওই রুটে গত বছরে প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার অভিবাসী ইউরোপে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেছেন, যাদের এক-তৃতীয়াংশকে সাগর থেকে উদ্ধার করেছে ইইউ প্যাট্রল টিম। লিবিয়া উপকূলের ২৪ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে ইইউ ওই প্যাট্রলিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। আইওএমের তথ্য মতে, গত বছর ভূমধ্যসাগর থেকে বিশেষ করে অভিবাসী পারাপারের রুট থেকে ৩৭৭১ অভিবাসীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে প্রায় ১ লাখ ৭৯ হাজার অভিবাসী সাগরপথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢুকেছে। অপর এক কর্মকর্তা বলেন, দালালদের প্রলোভনে পড়েই বেশির ভাগ অভিবাসী এ পথে পা বাড়াচ্ছেন। তারা নিশ্চিত বিপদ জেনেও ওই পথে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম, বিসিসি, রয়টার্সের বিভিন্ন রিপোর্ট উদ্ধৃত করে এ নিয়ে কাজ করা সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাকা অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনাকে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। যুক্তরাজ্য, ইতালি, গ্রিস, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ চাপ দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়াও এখন আর কোনো বাংলাদেশিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিচ্ছে না। কেউ আবেদন করলে দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই যখন অবস্থা তখন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টাকারী বাংলাদেশিদের নিয়ে আমরা খুবই বিপদে আছি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বিশেষ করে ইইউর সঙ্গে আলোচনায় বিষয়গুলো আসছে। যদিও সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। লিবিয়ায় থাকা বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা অভিবাসীদের সাগরযাত্রাকে আত্মহত্যার সঙ্গে তুলনা করেন। ভয়ঙ্কর সেই যাত্রার বর্ণনা দিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, লিবিয়ার তবরুক শহর থেকে অনেকে যাত্রা করেন। ৯০ থেকে ১০০ ফুট দীর্ঘ একটি নৌকায় দেড় থেকে ২০০ লোক ওঠেন। ওই নৌকা কয়েক ঘণ্টা সাগরে চলার পর বড় জাহাজের সন্ধান পান। গাদাগাদি করে তাতে তোলা হয় অভিবাসীদের। বেশির ভাগ সময় মিশর থেকে আসা জাহাজকেই টার্গেট করে দালালরা। যদিও আগে থেকেই ওই জাহাজ লোকে ভর্তি থাকে। তার পরও ছোট নৌকা থেকে অভিবাসীদের ওঠানো হয়। এমন পরিস্থিতিতেই বেশি দুর্ঘটনা হয় বলে জানান ওই কর্মকর্র্তা। ইতালি মিশনে থাকা বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা বলেন, ইতালির কোস্টগার্ড অভিবাসীদের ঠেকাতে তৎপর রয়েছে। তার পরও অভিবাসীরা ঢুকছেন। সেখানে আরেক বাংলাদেশিও উদ্ধার হচ্ছেন। অনেকের মারা যাওয়ার খবরও পাওয়া যায় বলে জানান ওই কর্মকর্তা। অতিরিক্ত লোক ওঠা, প্যাট্রলিংয়ে নিযুক্ত ইইউর বিভিন্ন দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়া এবং জাহাজের সঙ্গে ছোট নৌকাগুলোর ধাক্কায় নির্মম মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটে বলে তিনি জানান।-মানবজমিন

২২ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সবুজ/এসএ

 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে