শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৬, ১০:২৮:০০

ব্লগারদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে যা বলল মার্কিন টেলিভিশন সিএনএন

ব্লগারদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে যা বলল মার্কিন টেলিভিশন সিএনএন

রেজাউল করিম : মুক্তচিন্তার মানুষদের খুনের ঘটনায় বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া লজ্জাজনক বলে উল্লেখ করেছে প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন। এর অনলাইন সংস্করণে ‘ধর্ম সমালোচকদের হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের লজ্জাজনক প্রতিক্রিয়া (Bangladesh's shameful response to religion critic killings)’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, ‘একজন নিরাপরাধ যুবককে প্রকাশ্য রাস্তায় নির্মমভাবে রামদা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার পর সরকারের প্রতিক্রিয়ায় সেই ভুক্তভোগীকেই দায়ী করা হয়। বাংলাদেশের মতো ‘তথাকথিত’ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটি ভয়ানক ও অযৌক্তিক অবস্থা, যেখানে ইসলামের সমালোচনার জন্য উগ্রবাদীদের দ্বারা ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিকদের  বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের রক্তাক্ত অভিযান চলছে। কিন্তু জনগণের অধিকার ও নিরাপত্তার বদলে বাংলাদেশের নেতারা হত্যাকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আর নিহতদের তিরস্কার করছেন।’

ওই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন ‘সেন্টার ফর ইনকুয়েরি’র কমিউনিকেশন ডিরেক্টর পল ফিড্যালগো এবং জাতিসংঘের ধর্মীয় স্বাধীনতা, জননীতি ও এনজিও কমিটির সভাপতি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মাইকেল ডি ডোরা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘গত সপ্তাহে ঢাকায় ২৮ বছর বয়সী আইনের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ ইসলামী চরমপন্থীদের শিকার হন। জনশ্রুতি রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে আল-কায়েদার সাথে সংশ্লিষ্টরা তাকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাকে গুলি করে। কারণ তিনি ফেসবুকে পোষ্ট দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে ধরতেন এবং উগ্র ইসলামের সমালোচনা করতেন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ‘সভ্য বিশ্বের আশা সরকার তার দেশের মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলবে। আর এই ধরনের ধর্মভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করবে। কিন্তু যা ঘটেছে এটা তা নয়। বরং খুনিদেরকে নিন্দা করার চেয়ে নিহতের প্রতি বেশি বিরক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।’

তিনি (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) সিএনএনকে বলেন, লেখালেখির ব্যাপারে ব্লগারদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমাদের দেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। আমি বলতে চাই কোনো কিছু লিখে কেউ যেন কারো ধর্ম এবং বিশ্বাসে আঘাত না করেন। সেজন্য সবাই সতর্ক থাকতে হবে।’

এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সরকারের জন্য একমাত্র লজ্জাজনক উদাহরণ হলো তারা সেটাই করছে যেটা সন্ত্রাসীরা চায়। ধর্মের সমালোচনার ব্যাপারে মানুষকে এমনভাবে আতঙ্কগ্রস্ত রাখা হয়েছে যে, এজন্য তাদের জীবন পর্যন্ত দিতে হতে পারে।’

ব্লগার হত্যার শুরু সময় উল্লেখ করে আরো বলা হয়, ‘দুঃখের বিষয় ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ এবং অন্যান্য ভিন্নমতাবলম্বীদের জীবন দিয়ে মূল্য পরিশোধের শুরু। আর বর্তমান যে সন্ত্রাস তা পুরোপুরি শুরু হয় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় বাংলাদেশী-আমেরিকান নাগরিক লেখক অভিজিত রায়কে হত্যার মধ্যদিয়ে। ওই হামলায় অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা নিজেও গুরুত্বর আহত হন। এর ধারাবাহিকতায় একই কায়দায় পরে আরো চারজন ব্লগার ও লেখককে হত্যা করা হয়। আর হত্যার হাত থেকে বেঁচে গেলেও আহত হয়েছেন আরেকজন।

‘অভিজিৎ রায় হত্যার পর অনেক বিস্ময়ের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে অকথ্য নিষ্ঠুরতা ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এটাকে পরিস্কারভাবে রাজনীকিকরণ করে ফেলে বলেন, ‘বিরোধী দল নিরলসভাবে সরকারের বিরুদ্ধে যে ধর্ম কার্ড খেলছে, যাতে আমরা শক্তিশালী না হতে পারি। কিন্তু তা তাদের উপলব্ধি, বাস্তব না।’

প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বিষয়ে একটি বক্তব্যকে তুলে ধরে বলা হয়, ‘এরপরের কয়েক মাসে আরো বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই মুক্তমত প্রকাশের অধিকারকে সমর্থন করতে অস্বীকার করেছেন। নিহত একজনকে তিরস্কারও করে তিনি বলেন, আপনি কোনোভাবেই অন্য ধর্মে আঘাত করতে পারেন না। আপনাকে এটা করা থেকে বিরত থাকতেই হবে। যদি কেউ কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে সেটা সহ্য করা হবে না।’

নাজিমুদ্দিন নিহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যও তুলে ধরে সিএনএনের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রাস্তায় সামাদের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, তদন্তের অংশ হিসেবে এটাও দেখতে হবে ব্লগে সে আপত্তিকর কিছু লিখতো কি না। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিরাপরাধ বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর এই রকম প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত নয়।’

এসব ঘটনার নিয়ে ‘সেন্টার ফর ইনকুয়ের’ কাজ করছে উল্লেখ করে বলা হয়, ‘এই রকম অবস্থার শুরু থেকেই আমাদের সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, মার্কিন ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশন এবং অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা যেসব ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের জীবন হুমকির সম্মুখীন তাদের মানবাধিকার ও নিরাপত্তার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার রাস্তা খোঁজার আহ্বান জানিয়েছে।

নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ তার সকল নাগরিকের ধর্ম, বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়,  ‘হামলার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের তিরস্কার এবং কিছু সংখ্যক খুনীকে বিচারের সম্মুখীন করা বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকার বিসর্জনের সামিল। এর ফলে পরোক্ষভাবে খুনোখুনি চলতেই থাকবে। এটা আরো উৎসাহিত করে। তারা এখন তাই করছে। এটা চলতে থাকলে একটি বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের দেশের ভবিষ্যত সমাধির ঝুঁকিতে পড়বে।’

সিএনএনের প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘মানুষের স্বাধীনতা থাকবে, তার মতামত জানানো অধিকার থাকবে। সেই সাথে তার দায়িত্বশীলতাও থাকতে হবে। স্বাধীনতার নামে যা খুশি তাই বলবে বা লিখবে তা নয়।’

তিনি বলেন, স্বধীন মত প্রকাশ করতে গিয়ে সেটা যেন অন্যকে আঘাত না করে এবং কারো কোনো অনুভূতিতে আঘাত না দেয়। সেটা হোক ধর্মীয় বা ব্যক্তিগত।

সিএনএনের প্রতিবেদনের শেষ অংশের সাথে একমত প্রকাশ করে রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘সমাজে বহুমত থাকবে। মানুষের স্বাধীনতা থাকবে। স্বাধীনতার নামে সে যেমন যা খুশি তা লিখতে পারে না। তেমনি কেউ কিছু লিখলেই তাকে হত্যা করতে পারে না। আর কেউ খুন হলে তো বিচারের প্রসঙ্গটা আসেই।’ -চ্যানেল আই অনলাইন
২২ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে