বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০২:১৯:১৮

ঈদে ঘরে ফেরা ও সড়ক দুর্ঘটনার উৎকণ্ঠা

ঈদে ঘরে ফেরা ও সড়ক দুর্ঘটনার উৎকণ্ঠা

রোবায়েত ফেরদৌস : আমার এক পরিচিত সাংবাদিক, ভীষণ ব্যস্ত কর্মজীবনে, ফরিদপুরের গ্রামের বাড়িতে যান গুনে গুনে বছরে দুবার- রোজার ঈদ আর কোরবানিতে; কিন্তু প্রতিবারই যাওয়ার বিষয়ে দারুণ উদ্বিগ্ন থাকেন। বাড়ি যান আর যাত্রাপথের পুরো সময় কাটে তার ভয়ে। কারণ একটি পরিসংখ্যান-রোজা/ কোরবানির ঈদে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, সবচেয়ে বেশি মানুষ আহত-নিহত হন।

 তবু তিনি যান- নাড়ির টান বলে কথা! ওই সময় বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবার দেখা মেলে। দুর্ঘটনার দুরু দুরু ভয়কে তালুতে ফেলে গ্রামে ছোটেন তিনি; এবারও যাবেন! মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হলো নাড়ির টানে বাড়িতে যাওয়ার সময় মানুষকে কেন এত ভয় পেতে হবে? দুর্ঘটনা তো প্রতিদিনই হচ্ছে সড়কে-মহাসড়কে।

সড়ক দুর্ঘটনা : কিছু পরিসংখ্যান : বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৫ জন মানুষ মারা যায়। (আমার সংবাদ, মার্চ ১০, ২০১৫) বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এআরসি)-এর তথ্য মতে, প্রতি বছর দেশে গড়ে ১২ হাজার মানুষ রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। একটি মৃত্যু সারা জীবনের কান্না! সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু একটি প্রাণেরই মৃত্যু হচ্ছে না এতে ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশ। দুর্ঘটনায় মৃতের শতকরা ৬০ ভাগ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী যাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন সেন্টার ও ব্র্যাকের যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, দেশে ৬৯ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য বাস ও ট্রাক দায়ী। হতাহতদের মধ্যে বাস ও প্রাইভেটকারের যাত্রী ১৯ শতাংশ। তিন চাকার গাড়ির আরোহী ১৬ ভাগ এবং সাইকেল চালক ৩ শতাংশ। (১৬ অক্টোবর ২০১৪, বাংলাদেশ প্রতিদিন) আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হলো ড্রাইভারদের ৮১ শতাংশই গাড়ি চালানো শিখেছেন অবৈজ্ঞানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্থাৎ ওস্তাদ-সাগরেদ পদ্ধতিতে, ওস্তাদকে চা-পান খাইয়ে, বাড়তি সেবা-পরিসেবা করে! ১৯৯৩ সালে রোড অ্যাক্সিডেন্টে স্ত্রী জাহানারাকে হারানো চলচ্চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রতিষ্ঠান নিরাপদ সড়ক চাই-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৬ হাজার ৫৮২ জন।

অধিকাংশ ড্রাইভার ট্রাফিক আইন মানেন না। অতিরিক্ত গতির কারণে দেশে ৫৪ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। মোটরযান আইনানুযায়ী বাস, কোচ, ভারী ট্রাক, ট্রাক্টর লরির ও পিকআপের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। কিন্তু কেউ-ই তা মানছে না। বিআরটিএ'র হিসাব অনুযায়ী বর্তমান বছরের জুন মাস পর্যন্ত রাজধানীতে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। (১২ জুলাই ২০১৫, প্রথম আলো) রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা ২১ লাখ হলেও এর বিপরীতে বৈধ গাড়ির চালক আছে ১৩ লাখ।

যদিও যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, সারা দেশে প্রায় ৪০ লাখ মোটরযান আছে। সেই হিসেবে প্রায় ২৭ লাখ পরিবহন চলছে লাইসেন্স ছাড়া ড্রাইভার দিয়ে। আর হাস্যকর যে, গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার জন্য আছেন মাত্র একজন উপ-পরিচালক। ঢাকায় ৭৯ হাজার রিকশার বৈধ লাইসেন্স আছে। তবে লাইসেন্স ছাড়া রিকশার সংখ্যা ৫ লাখেরও বেশি। দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত শতকরা ৮৩ ভাগ আসামি থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে চালকরা বেপরোয় ভাব নিয়ে সড়কে গাড়ি চালায়।

যে সব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে : ড্রাইভারের অদক্ষতা, গাড়ি চালনায় একজনকে পেছনে ফেলে সামনে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, অতিমাত্রায় 'ওভার টেকিং টেন্ডেন্সি', ক্লান্তিকরভাবে দীর্ঘসময় গাড়ি চালানো, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, রাস্তায় অস্বাভাবিক বাঁক, বেপরোয়া-নেশাগ্রস্ত ও চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানো, নিয়ম মেনে লাইসেন্স না দেওয়া, সর্বোচ্চ গতিসীমা না মানা, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর পরও লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত না পাওয়া, মোবাইলে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালানো কিংবা মোবাইল কানে ধরে অসতর্ক হয়ে পথচারীদের রাস্তা পার হওয়া, মহাসড়কের ওপর যানবাহন থামিয়ে যাত্রী ও মালামাল ওঠা-নামা এবং সড়ক দুর্ঘটনার পর দায়ী চালকদের শাস্তি না পাওয়া দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।

মামলা ও শাস্তি : রোড অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনায় হওয়া মামলাগুলো দিনের পর দিন ঝুলে থাকে সাক্ষীর অভাবে। আইনি জটিলতা থাকায় অনেক সময় সাক্ষী আর সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ দেখায় না। ফলে, মামলা এক সময় নিস্তেজ হয়ে যায়। বাস্তব হলো অভিযুক্ত চালকদের বেশি দিন কারাগারে রাখা যায় না; বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় জড়িতরা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনিরের ঘাতক বাস ড্রাইভার জামির হোসেন দুর্ঘটনার পর পালিয়ে যায়; ঘটনার দুদিন পর মেহেরপুর থেকে গ্রেফতার করার পর ৩ মাস ২ দিন জেল খেটে সে ১৭ নভেম্বর জামিন পায়। (১৮ নভেম্বর ২০১১, সমকাল) ২৫ আগস্ট ভীষণ মন খারাপ করা খবর ছাপিয়েছে দৈনিক প্রথম আলো। পত্রিকাটির খবর বলছে, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের চাপে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি সংশোধন করা হচ্ছে।

এখন থেকে কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে গাড়ি চালকদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মামলা না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ৩০২ ধারার মামলায় সড়ক দুর্ঘটনায় 'দোষী' প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি 'মৃত্যুদণ্ডে'র বিধান ছিল। কিন্তু এই আইন সংশোধন করা হলে রোড অ্যাক্সিডেন্টে কেউ মারা গেলে মামলা হবে ৩০৪ (খ) ধারায়। ৩০৪ (খ) ধারায় সর্বোচ্চ সাজা ৩ বছর কারাদণ্ড।

দুর্ঘটনা রোধে করণীয় কী : সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব অমূল্য জীবনের হানি হয়, তা কোনো দিন ফিরে পাওয়ার নয়। তাই এটি কমিয়ে আনতে যেসব পদক্ষেপ দ্রুত নেওয়া দরকার তা হলো : সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কঠোর আইন ও শাস্তির বিধান রাখা; কারণ দোষী চালকদের উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ থাকলে চালকরা সাবধানে গাড়ি চালাতে বাধ্য।

সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে মামলা দায়েরের বিধান রাখতে হবে; তা না হলে ড্রাইভাররা সচেতন হবে না এবং অ্যাক্সিডেন্টের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। বিআরটিএর এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী টাকার বিনিময়ে অবৈধ লাইসেন্স দেয়, এটি বন্ধ করতে হবে; ১৯৮৩ সালের পুরনো মোটরযান আইনকে আধুনিক, কার্যকরী ও জনবান্ধব করতে হবে; দোষী চালকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও শ্রমিকনেতাদের প্রত্যক্ষ মদদে তাদের ছাড়িয়ে আনতে পরিবহন সেক্টর এক রকমের জিম্মি করে রাখা হয়।

এই জিম্মিদশা থেকে পরিবহন খাতকে মুক্ত করতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনেক সময় উদাসীন হতে দেখা যায়; তাদের আরও 'অ্যাকটিভ' করতে কবে। রোড অ্যাক্সিডেন্ট কমাতে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর এবং বিআরটিএর প্রতিরোধ সেলগুলোকে কার্যকর করতে হবে।

সারা দেশের ১৪৪টি মারাত্দক ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক বা কেন্দ্রের কাজ দ্রুত শুরু করে তা শেষ করতে হবে। কারণ, যত দেরিতে এই বাঁকের কাজ শেষ হবে মৃত্যুর মিছিল ততই লম্বা হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। প্রয়োজনে বাঁকগুলো তুলে দিতে হবে। সড়ক-মহাসড়কে নকশা সংক্রান্ত ত্রুটি দ্রুত সারাতে হবে। সারা দেশে গাড়ির ড্রাইভারদের ব্যবহারিক, তাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়কে একেবারে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং কেউ এটি চালালে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক জরিমানা ও শাস্তি দিতে হবে।

সড়কের পাশে কিংবা সড়কের মধ্যে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাজার, দোকানপাট, প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংগঠন ও সহযোগী সংগঠনের সাউনবোর্ড সর্বস্ব অফিস তুলে দিতে হবে। ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। পথচারীর ঝুঁকিপূর্ণ পারাপার রোধে দেশব্যাপী সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া ক্যাম্পেইনের ব্যবস্থা করতে হবে। নিষিদ্ধের পরও মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও নসিমন-করিমনের মতো বিপদজ্জনক যানবাহন এখনো চলছে; সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সড়কে এ ধরনের যানবাহন বন্ধ করা ভীষণ জরুরি। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে ভ্রাম্যমাণ পুলিশের টহল বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের প্রো-অ্যাকটিভ করতে হবে।

বিআরটিএ'র জনবল বাড়াতে হবে, প্রতিষ্ঠানটিকে আধুনিক, যুগোপযোগী ও কার্যকর করতে হবে। পুরনো, লক্কর-ঝক্কর মার্কা ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তা থেকে তুলে নিতে হবে। ফিটনেসছাড়া কোনো গাড়ি পাওয়া গেলে জরিমানাসহ কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ কমাতে সড়কে প্রয়োজন মতো 'পাবলিক ট্রান্সপোর্ট' বা 'গণপরিবহন' নামাতে হবে, প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, প্রয়োজনে প্রাইভেট কারে গ্যাস-সুবিধা বাতিল করতে হবে। সারা দেশে সড়ক-মহাসড়কগুলোতে অত্যন্ত ধীর গতিতে 'চারলেনে'র কাজ চলছে, এতে বাড়ছে যানজট ঘটছে দুর্ঘটনা; তাই দ্রুত গতিতে চারলেনের কাজ শেষ করতে হবে।

সবশেষে বলব, কোরবানির ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে সড়ক-মহাসড়ক, রেলপথ, নৌপথে যাত্রীদের চাপ ততই বাড়ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে হচ্ছে দীর্ঘতর। অনেকে আবার দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে চিরদিনের জন্য ঘরে বসে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। বাংলাদেশে বোধকরি এমন কোনো ঘর বা ফ্যামিলি পাওয়া যাবে না, যেখানে কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাননি অথবা আহত হননি।

এখনই এর রাশ টেনে ধরতে হবে, থামাতে হবে শবযাত্রার মিছিল; নিতে হবে দ্রুত রাজনৈতিক ও কঠোর আইনি পদক্ষেপ। তবেই হয়তো ঈদ, কোরবানি, পয়লা বৈশাখ, বিজু, সাংগ্রাই, পূজা-পার্বণের মতো এদেশের চিরন্তন ও শাশ্বত উৎসবে নাড়ির টানে যাত্রাকালে কেউ ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়বেন না, ভয়ে মুষড়ে পড়বেন না; কিংবা বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার সময় লাশ হয়ে ফিরবে না ! দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসুক, বাঙালির ঈদ উৎসব হোক উৎকণ্ঠাহীন, নিরাপদ, বর্ণিল, আনন্দময় ও হৃদয় নিংড়ানো; ঈদ হোক সার্বজনীন। সবার জন্য ঈদ মোবারক !

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে