মঙ্গলবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০২:০৬:১১

চুক্তির পর ইরান থেকে যেসব সুবিধা নিতে পারে বাংলাদেশ

চুক্তির পর ইরান থেকে যেসব সুবিধা নিতে পারে বাংলাদেশ

তেহরান থেকে সিরাজুল ইসলাম : ইরানের সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর পরমাণু চুক্তির পর সারা বিশ্ব যেন নড়েচড়ে বসেছে। সারা বিশ্বের সামনে খুলে গেছে ‘বিশাল সম্পদের অধিকারী’ ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যের দুয়ার। প্রতিদিনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইরানে আসছেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান অথবা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাণিজ্য প্রতিনিধিদল। এ কাতারে যেমন রয়েছে পূর্ব এশিয়ার দেশ জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, তেমনি রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান।

ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশ থেকেও আসছে প্রতিদিন নানা পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং প্রতিনিধিদল। এ কাজে পিছিয়ে নেই আফ্রিকা মহাদেশও। ইরান বলছে, বিভিন্ন খাতে বিদেশী বিনিয়োগকে স্বাগত জানাবে তারা। এর পাশাপাশি বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোকে নানা সুবিধা ও অগ্রাধিকার দিয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্কসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ভিন্নমাত্রায় নিতে চায় তেহরান।

ঠিক এ প্রেক্ষাপটে ইরান থেকে বাংলাদেশ কী ধরনের সুবিধা নিতে পারে এমন প্রশ্ন করেছিলাম তেহরানে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের বিদায়ী কমার্শিয়াল কাউন্সিলর আরিফুর রহমান অপুর কাছে। ছয় বছর দায়িত্ব পালনকারী এ কর্মকর্তা জানালেন, প্রথমেই বাংলাদেশ ইরানকে জ্বালানি তেলের জন্য বড় উৎস হিসেবে গ্রহণ করতে পারে এবং বিকল্প জ্বালানির বড় উৎস হতে পারে ইরান। বাংলাদেশ তার প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের প্রায় পুরোটাই কুয়েত থেকে নেয়। মধ্যপ্রাচ্য যথেষ্ট অস্থিতিশীল অঞ্চল। সে কারণে জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্নে উৎসের বহুমুখীকরণ করা উচিত।

এটা মূলত জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থেই করা দরকার। কখনো যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো সমস্যা দেখা দেয় তাহলে যাতে বাংলাদেশ বড় সংকটে না পড়ে। এক্ষেত্রে তিনি জাপানের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জাপান বিশ্বের যেসব দেশ থেকে তেল আমদানি করে তার প্রত্যেক দেশের কাছ থেকে মোট চাহিদার ১০ থেকে ২০ ভাগের বেশি নেয় না। এতে অনেক দেশের সঙ্গে লেনদেনের সম্পর্ক থাকে আবার সংকটকালে জ্বালানির নিরাপত্তা বা স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সহজ হয়।

বাংলাদেশের তেল শোধনাগার লাইট ক্রুড অয়েলের জন্য মানানসই। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে করণীয় কী? এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফুর রহমান অপু বলেন, ইরানের তেল যদিও ‘হ্যাভি ক্রুড’ তারপরও বাংলাদেশের শোধনাগারকে কিছু পরিবর্তন করে হ্যাভি ক্রুড শোধনের উপযুক্ত করা সম্ভব। দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে এমন পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।

নজর দিতে হবে ইরানের পোশাক খাতে: ইরানের বাজারে বাংলাদেশের গার্মন্টস পণ্য আসার সম্ভাবনা কতটা- এমন প্রশ্নে আরিফুর রহমান অপু বলেন, ইরানের গার্মেন্ট খাতের শতকরা অন্তত ২০ ভাগ দখলে নিতে পারে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি ইরানের লোকজন ব্র্যান্ড পছন্দ করেন। ইউরোপ আমেরিকায় যেহেতু বাংলাদেশী গার্মেন্ট পণ্যের বিরাট কদর রয়েছে সে কারণে ইরানের বাজারে বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্যের জায়গা করে নেয়া কোন সমস্যাই নয়। অন্তত ১৩,০০০ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশ ইরানে রয়েছে সাড়ে সাত কোটি লোক।

এ কারণে ইরানের বাজারও অনেক বড়। তাদের ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেশি এবং ব্র্যান্ডও পছন্দ করেন। এজন্য বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা ইরানের বাজারকে গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে টার্গেট করতে পারেন এবং খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে কাজটি করা দরকার। তিনি বলেন, ইরানের বাজারে বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি করতে হলে খুব শিগগির ইরানে একক প্রদর্শনীর আয়োজন করতে হবে। এখানকার ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের পণ্যের গুণগতমান সম্পর্কে ততটা জানেন না। এমন মেলা করা গেলে তা অনেক বেশি কার্যকর হবে। এমন পরামর্শ দিয়েছেন ইরানের ব্যবসায়ীরাও।

আরিফুর রহমান অপু বলেন, আমাদের দেশের অনেক ব্যবসায়ী-শিল্পপতির মধ্যে একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে, ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করতে গেলে এবং পাসপোর্টে ইরানি ভিসা লাগলে বুঝি আর আমেরিকা ইউরোপের দেশে যাওয়া যাবে না। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তিনি বলেন, খোদ ইরানের বহু ব্যবসায়ী ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশের সঙ্গে ব্যবসা করেন। এমন সমস্যা থাকলে তাদের বেলায়ও তেমনটা হতে পারত।

আরিফুর রহমান অপু বলেন, শুধু গার্মেন্ট পণ্যই নয়, এর বাইরে আরও বহুপণ্য বাংলাদেশ থেকে আসতে পারে। ইরানের জনগণ শপিং করতে পছন্দ করেন, বিউটিফিকেশন পছন্দ করেন। সেদিকে নজর দিয়ে এসব খাতের পণ্য ইরানে রপ্তানি করা সম্ভব। ইরানের বাজারে বিদেশী পণ্য প্রবেশের ওপর উচ্চহারের যে ট্যারিফ বসানো হয়, আলোচনার মাধ্যমে তাও অনেকাংশে কমানো সম্ভব বলে জানান আরিফুর রহমান অপু।

বর্তমানে ইরানের বাজারে তৃতীয় পথ হয়ে বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য কিছু কিছু আসছে। তিনি বলেন, ইরানের বাজারে গার্মেন্ট পণ্যের বড়জোর শতকরা পাঁচ ভাগ বাংলাদেশী পণ্য। এর পরিমাণ অনেক বাড়োনো সম্ভব।

ইরানে পাটের বাজার দখল করতে চায় ভারত: ইরানের বাজারে বাংলাদেশের পাটের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং বাংলাদেশ হচ্ছে ইরানে প্রধান পাট সরবরাহকারী দেশ। প্রধানত ইরানের কার্পেট শিল্পে পাটের ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া আরও নানা কাজে এখানে পাটের ব্যবহার হয়। কিন্তু পাটকেন্দ্রিক বাণিজ্যেও কিছু সমস্যা রয়েছে বলে জানা গেছে। চুক্তি ও সময় মতো পাটের সরবরাহ না করা তার মধ্যে অন্যতম।

এছাড়া, কখনও কখনও পাটের গুণগতমান নিয়ে ইরানের গ্রাহকরা প্রশ্ন তোলার সুযোগ পান। এমন অভিযোগও রয়েছে, ইরানি ব্যবসায়ীদের চুক্তি মোতাবেক পাট না দিয়ে বেশি দামে অন্য কোথাও সে পাট সরবরাহ করা হয়। তখন বিপাকে পড়েন ইরানের ব্যবসায়ীরা।

এ ধরনের চুক্তি লঙ্ঘনের ঘটনা, মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞার কারণে পাটের সরবরাহ ঠিক না রাখা ইত্যাদি কারণে ইরানের কার্পেট নির্মাতা কোম্পানিসহ অন্য ব্যবহারকারীরা বিকল্প ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। এ অবস্থায় ইরানের বাজারে পাটের সরবরাহ আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে হলে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এরই মধ্যে ভারতের ব্যবসায়ীরা ইরান সফর করেছেন এবং তারা ইরানে বাংলাদেশের পাটের বাজার দখল করতে চান। সংশ্লিষ্ট সূত্র আশংকা প্রকাশ করেছেন, এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া না হলে পাটের বাজার ভারতের দখলে চলে যেতে পারে।

সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন ডলার। তবে, অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যসহ সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার। চুক্তির পর ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে প্রয়োজনীয় এবং সঠিক পদক্ষেপ নেয়া হলে বাণিজ্যের এ পরিমাণ অনেক বাড়ানো সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।-এমজমিন
৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে