প্রকাশ বিশ্বাস: নারী আসামি ও হাজতিদের জন্য ঢাকার আদালতপাড়ার হাজতখানায় আলাদা সুযোগ-সুবিধা না থাকায় প্রতিনিয়ত তাদের নানা নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। হাজতে ঢোকা থেকে শুরু করে ভেতরে অবস্থান করা পর্যন্ত সময়ে পুরুষ আসামিদের অশ্লীল বাক্য, গালাগাল, বিশ্রী অঙ্গভঙ্গী প্রদর্শন, এমনকি গায়ে হাত দেওয়া- কোনো কিছু থেকেই রেহাই মেলে না নারীদের। আদালত হাজতখানার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া যায় ‘নিপীড়নের’ এই চিত্র। সমস্যার কথা স্বীকার করে পুলিশের অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আমিনুর রহমান জানিয়েছেন, নারীদের জন্য আলাদা ভবন করার পরিকল্পনা আপাতত না থাকলেও মহানগর দায়রা জজ আদালতের সিঁড়ির নিচে একটা জায়গা পাওয়া গেছে। “সমস্যা সমাধানে আমরা একটু একটু করে এগোচ্ছি,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ঢাকার আদালতপাড়ার প্রধান হাজত ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের প্রধান ভবনের ডান পাশে। পাশাপাশি রয়েছে মহানগর দায়রা জজ আদালত, ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতের হাজত। পুলিশের তথ্যমতে, প্রতিদিন মহানগর দায়রা জজ, মুখ্য বিচারিক হাকিম, জেলা ও দায়রা জজ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ জজ আদালতে এক থেকে দেড়শ আসামি আনা হয়। এছাড়া ৫/৬ শ আসামিকে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের হাজতে আনা হয়, যাদের মধ্যে ৩০/৪০ জন নারী। আর মহাগর দায়রা জজ আদালতে প্রতিদিন ২০/২৫ জন নারী আসামি নিয়ে আসা হয়। মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন মামলার আসামিদের জন্য হাজতে তিনটি সেল রয়েছে। মাঝখানে চলাচলের পথ। এখানে নারীদের জন্য আলাদা কক্ষ নেই। এই হাজতখানার দায়িত্বে থাকা এসআই মোফাখখারুল ইসলাম জানান প্রতিদিন নারী আসামি ও হাজতিদের নিয়ে বিব্রতকর অভিজ্ঞতার কথা।
তিনি বলেন, “বদলাবদলি করে আমরা নারীদের এখানে বসাই। বিচারকের সঙ্গে কথা বলে তাদের অনুমতি নিয়ে পুরুষ আসামি, বিশেষত দাগী আসামিরা এজলাসে চলে যাওয়ার পর নারীদের নিয়ে আসি এখানে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হাজতের বাইরে বারান্দাতেই তাদের দাঁড় করিয়ে রাখতে বাধ্য হই। বসতে দিতে পারি না। “বিষয়টি আমাদের জন্য তো বটেই, নারীদের জন্যও বিব্রতকর। আর অভিজাত পরিবারের নারীদের নিয়ে আমরা খুবই সমস্যায় থাকি।” নারীদের জন্য আলাদা হাজতখানার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের কেন্দ্রীয় কোর্ট হাজত ভবনটি ছয় তলা। এর মধ্যে উপরের দুই তলায় থাকেন পুলিশ সদস্যরা। বাকি চার তলা ব্যবহৃত হয় আসামি ও হাজতিদের জন্য। এই ভবনের তৃতীয় তলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হ্যান্ড রাইটিং এক্সপার্টদের জন্যও কক্ষ রয়েছে। এ হাজতখানায় ঢুকতেই ডানে প্রথম সেলটি নারীদের জন্য। পরের ডান-বামের তিনটি সেল পুরুষদের। এখানকার শৌচাগারের দেওয়াল ছাদের সঙ্গে যুক্ত নয়, ৫ ফুটের মতো উঁচু, যা প্রায়ই বিব্রতকর ঘটনার জন্ম দেয়। তবে প্রধান হাজতখানার সাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই মুরাদ হোসেন ও বর্তমান কর্মকর্তা এসআই রুহুল আমিন নারীদের জন্য পৃথক হাজতের দরকার নেই বলে মত দিয়েছেন। তারা দুজনই দাবি করেন, নারীদের নিরাপত্তা ও সম্মান এখনকার হাজতে অক্ষুণ্ন থাকে। কিন্তু নারী আসামি ও হাজতিদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন আইনজীবীরাও। নারী আসামি ও ভিকটিমরা নানাভাবে থানা হাজত থেকে শুরু করে কোর্ট হাজত পর্যন্ত হেনস্থার শিকার হন বলে জানান জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ফাহমিদা আক্তার রিংকি।
তিনি বলেন, “সম্প্রতি আহসানউল্লাহ বিশ্ববদ্যালয়ের শিক্ষকের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার ৫ ছাত্রী হাকিমের কাছে জবানবন্দি দিতে আসেন। আমরা তাদের কোর্ট হাজতে না পাঠিয়ে পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তার কার্যালয়ে বসিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু বারান্দায় পুরুষ আসামিদের মধ্যে অনেকেই বাজে দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। আর হাজতে এই ছাত্রীরা থাকলে কী অবস্থা হতো তা সহজেই অনুমেয়।” সমিতির প্রধান সালমা আলী উচ্চশিক্ষিত এক নারী আসামির মুখে শোনা অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন।
“প্রভাবশালী স্বামীর দায়ের করা চুরির মামলায় গ্রেপ্তার ওই নারীকে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের হাজতখানায় নিয়ে আসা হয়। তিনি আমাকে বলেন- হাজতে নারীদের অবস্থান করার মতো পরিবেশ নেই। সঙ্কীর্ণ কক্ষ, নোংরা বাথরুম, নোংরা মেঝে, শোরগোল, চিৎকার, পুরুষদের অশ্রাব্য কথা- এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। আমাদের সংগঠন থেকে যেন আলাদা নারী হাজতখানার দাবিতে আন্দোলন করা হয়, তিনি সেই অনুরোধ করেন।”ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ নারী আইনজীবী তাহমিনা আক্তার হাসেমীর মতে, আদালতপাড়ায় নারী আসামি, ভিকটিমদের পাশাপাশি শিশুদের জন্যও পৃথক হাজত রাখা উচিৎ। আদালতপাড়ায় নারীদের নিরাপত্তাহীনতার কথা বলতে গিয়ে দেড় যুগের বেশি আগে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের এজলাস এবং পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাঝখানের বারান্দায় পাঁচ বছরের শিশু তানিয়া ধর্ষণের ঘটনা স্মরণ করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী দুলাল মিত্র। তিনি বলেন, “নারী আসামিদের লাঞ্ছনার হাত থেকে রেহাই দিতে তাদের জন্য স্বতন্ত্র হাজত হওয়া খুবই জরুরি।-বিডিনিউজ
২৪ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ