মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০১৬, ০১:৪০:১২

ঢাকার ভিক্ষুকদের অন্যরকম রাত!

ঢাকার ভিক্ষুকদের অন্যরকম রাত!

নিউজ ডেস্ক: আবুল বাশার (৪৫)। একযুগ আগে সড়ক দুর্ঘটনায় দু’পা হারান। সেই থেকে ভরসা হুইল চেয়ার। পটুয়াখালীর কইলতাপুর এলাকা থেকে শবেবরাতের দুদিন আগেই চলে আসেন রাজধানীতে। শবেবরাতের পর পুরো রমজান থাকবেন ঢাকায়। আলাপকালে জানান, সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন শবেবরাত ও রমজানের। বিগত বছরের এই দুই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে প্রায় ২০ হাজারের বেশি টাকা ভিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। এবারও তেমনই হবে বলে আশা করছেন আবুল বাশার। নরসিংদীর মনোহরদী থেকে প্রতিবন্ধী কন্যা সুমাকে (১৬) নিয়ে  রোববার আজিমপুর কবরস্থানে এসেছিলেন আবদুল কুদ্দুস (৬০)।

শবেবরাতে ঢাকায় প্রতিবছর ভিক্ষার জন্য এলে আজিমপুরকেই বেছে নেন তিনি। আবদুল কুদ্দুস জানান, একজন ভিক্ষা দিতে এলে অনেকেই এসে ভিড় করে। ভিড় ঠেলে কারও কাছে কিছু চাইতে ইচ্ছে করে না। তার মেয়ে জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। খর্বকায়। তিনি জানান, গেল বছর ২ হাজারের বেশি টাকা পেয়েছিলেন। এরপর পুরো রমজান মিলিয়ে যে টাকা পেয়েছিলেন তা দিয়ে ঈদুল-ফিতর উদযাপন করেছেন। একই উদ্দেশ্যে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি থেকে এসেছিলেন সিরাজুল ইসলাম (৩০)। তিনিও সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকবছর আগে এক পা হারিয়েছেন। হাঁটেন স্ক্র্যাচে ভর করে। আলাপকালে তিনি জানান, শবেবরাত শেষ করে পুরো রমজান  রাজধানীতেই থাকবেন তিনি। এতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার মতো আয় হবে তার। তা দিয়ে পুরো পরিবারের ঈদ আনন্দ হবে বলে জানান সিরাজুল ইসলাম। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের হিসেবে এমনিতে রাজধানীতে প্রায় ৫০ হাজার নিয়মিত ভিক্ষুকের আনাগোনা থাকে।

এদের বেশির ভাগ শারীরিক, মানসিক প্রতিবন্ধী ও বিকলাঙ্গ। এদের সঙ্গে সুস্থ শরীরের ভিক্ষুকরাও ভিক্ষা করেন সমানতালে। তবে, পবিত্র শবেবরাত ও রমজান মাস এলেই এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ সময় নিয়মিত ভিক্ষুকের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা অনিয়মিত ‘মৌসুমি’ ভিক্ষুককেরাও ভিক্ষার জন্য রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদ, মাজার, কবরস্থানসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অবস্থান নেয়। নিয়মিত ও মৌসুমি ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলে ও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে। এই সময়ে একেকজন গড়ে প্রতিদিন ৫শ’ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত তারা পান। রোববার শবেবরাতে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থান, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, সুপ্রিম কোর্ট মাজার, মিরপুরের বিভিন্ন মসজিদ ঘুরে দেখা গেছে, সন্ধ্যা থেকে প্রায় সব সড়কেই অবস্থান নিয়েছেন বিভিন্ন বয়সের ফকির ও ভিক্ষুকরা।

সংশ্লিষ্ট এলাকার মসজিদ ও কবরস্থান এলাকার দুপাশের ফুটপাতসহ আশপাশ দুপুর থেকেই দখলে নিয়েছিলেন তারা। অনেকেই বসে পড়েন সড়কের মাঝখানে। নির্দিষ্ট স্থানে জায়গা পেতে অনেক ভিক্ষুককে স্থানীয় বখাটে ও সন্ত্রাসীদের অনেককেই দিতে হয়েছে টাকা-এমন অভিযোগ করেছেন অসংখ্য ভিক্ষুক। একই সঙ্গে বিকলাঙ্গ, শিশু ও হাত-পা কাটা বিভিন্ন বয়সী ভিক্ষুকদের ভাড়ায় এনে ভিক্ষায় নামানো হয়েছে- এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মসজিদ ও কবরস্থান ঘুরে দেখা গেছে, ফকির আর ভিক্ষুকদের অনেকেই শারীরিক ও মানিসক প্রতিবন্ধী। কারও হাত নেই, পা নেই। কারও দুই হাত কিংবা দু পা নেই। শবেবরাতকে কেন্দ্র করে একেকজন অন্তত ৫শ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করবেন শবেবরাতে। আবার এদের অনেকেই রাজধানীতে অবস্থান করবেন রমজানজুড়ে। সে সময় প্রতিদিন আয় হবে ৩শ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত।

আজিমপুর কবরস্থান ও আজিমপুর বায়তুল করিম মসজিদ কমিটির নেতৃবৃন্দ জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ফকির ও ভিক্ষুকের সংখ্যা কিছুটা কম। তারা জানান, শবেবরাতকে কেন্দ্র করে এই এলাকায় কতসংখ্যক ফকির ও ভিক্ষুক এসেছেন তার কোনো সঠিক হিসাব তাদের কাছে নেই। তবে, এ সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ হাজারের কম হবে না বলে জানান তারা। পবিত্র শবেবরাতকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম ও তার আশপাশ এলাকায় ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আনাগোনা এমনিতেই বেড়ে যায়। একই সঙ্গে এই এলাকায় বাড়ে নিয়মিত ও মৌসুমি ভিক্ষুকদের আনাগোনা। রোববার শবেবরাতেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। মহিমান্বিত এই রাতকে কেন্দ্র করে বিকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শ শ ভিক্ষুক ও ফকির এসে ভিড়  করেছেন বায়তুল মোকাররম উত্তর ও দক্ষিণ গেটসহ পল্টন, প্রেস ক্লাব, জিপিও মোড়, গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় বায়তুল মোকাররম এলাকার চিত্র। মুসল্লিদের আনাগোনা যেমন বাড়ে তেমনি বেড়ে যায় নিয়মিত ও মৌসুমি ভিক্ষুকদের তৎপরতা।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ গুলিস্তান চত্বর অভিমুখী মাঝ সড়কে গোল হয়ে বসেছেন ১২ জন। এদের সবাই শারীরিক প্রতিবন্ধী। কারও এক পা কিংবা দু পা নেই। কারও নেই হাত-পা উভয়ই। কেউ খর্বকায়। এদের একজন সুর করে জিকির তুলছেন অন্য এগারজন আল্লাহ আল্লাহ বলে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাচ্ছেন। একটু ক্লান্ত হলে পরক্ষণে আরেকজন সুর ধরছেন অন্যরা সেই সুরে তার মিলিয়ে যাচ্ছেন। তাদের ঘিরে শ শ উৎসুক মানুষের ভিড়। প্রতিবন্ধী এই ভিক্ষুকদের নেতৃত্ব (তাদের ভাষায় সর্দার) দেয়া শহীদুল ইসলাম জানান, এমনিতে রাজধানীসহ এর বাইরে একেকজন একেক জায়গায় অবস্থান করে ভিক্ষা করেন তারা। তবে, শবেবরাতকে কেন্দ্র করে সবাই চলে এসেছেন ঢাকায়। ১২ জনের দল গড়ে বায়তুল মোকাররম ও তার আশপাশ এলাকায় ফজরের আজান পর্যন্ত এভাবেই গোল হয়ে জিকির তুলে ভিক্ষা করবেন তারা। এতে পাওয়া যাবে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। জনপ্রতি পাওয়া যাবে দেড় থেকে ২ হাজার টাকার মতো।

এদিকে পবিত্র শবেবরাতকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্ট এলাকার মাজার প্রাঙ্গণ (হজরত শাহখাজা শরফুদ্দিন চিশতী (র.) ও তার আশপাশ এলাকায় নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিগত বছরগুলোতে মাজারের প্রবেশপথের দুপাশের সড়কে ভিক্ষুকদের বসার অনুমতি দিলেও এবার সে সুযোগ মেলেননি। এ কারণে ভিক্ষুকদের অবস্থান করতে হয়েছে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানের সামনের ফুটপাত, সচিবালয় অভিমুখী সড়ক, দোয়েল চত্বর এলাকা অভিমুখী সড়ক ও প্রেস ক্লাবের ফুটপাতে। মাজারের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারা ভিক্ষুকদের কয়েকজন জানান, এতে করে তারা বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অনেকেই আশা নিয়ে এলেও ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি।-এমজমিন

২৪ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে