জিন্নাতুন নূর: মেগাসিটি ঢাকায় জীবিকার তাগিদে দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন ছুটে আসছেন অসংখ্য নিম্নআয়ের মানুষ। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী এই মানুষের অনেকেরই নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে খোলা আকাশের নিচেই কাটছে তাদের দিন-রাত। এদের কেউ পলিথিন, প্লাস্টিক বা শক্ত কাগজ দিয়ে কোনো মতে পথের পাশে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকছেন। আবার কেউ থাকছেন নগরীর যাত্রী ছাউনিগুলোতে। কেউ কেউ সারা দিন কাজ করে তরকারির ঝুপড়ি ও খাবারের ভ্যানে রাত পার করে দিচ্ছেন। কাজের আশায় দিন দিন ঢাকায় আসা ভাসমান মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আশ্রয়হীনদের অনেকেই আছেন যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে ভিটেমাটি হারিয়ে ঢাকামুখী হচ্ছেন। ছিন্নমূল এই মানুষের মধ্যে যাদের সামর্থ্যে কুলায় তারা হয়তো এক সময় ঢাকার কোনো বস্তিতে উঠছেন। কিন্তু বস্তিতে থাকার সামর্থ্য যাদের নেই তারা থাকার জন্য বেছে নিচ্ছেন সড়কের আইল্যান্ড, বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব বলছে, ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তারা বলছেন, ভাসমান এই মানুষগুলোর থাকার জন্য যেমন কোনো জায়গা নেই তেমনি তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত। ভাসমান মানুষের কারণে দিনের কর্মব্যস্ত কারওয়ান বাজার এলাকায় দৃশ্য রাতে অন্যরকম হয়ে যায়। ভাসমান যেসব মানুষ দিনভর কারওয়ান বাজারে সবজি ব্যবসাসহ ছোটখাটো কাজ করেন তাদের অনেকেই রাতে এই এলাকার প্রধান সড়কের পাশের আইল্যান্ডের উপর নিজেদের সবজির ঝুড়িতে ঘুমিয়ে কাটান। জানতে চাইলে এক ক্ষুদ্র সবজি ব্যবসায়ী মনির মিয়া বলেন, ঢাকায় দুই সপ্তাহ সবজি বেইচ্যা আবার গ্রামের বাড়ি যাই। টাকা কম দেইখ্যা কোনো বস্তিতে উঠি নাই। দিনে ঝুড়িতে সবজি বেচি। আর রাতে এর মধ্যেই গুটিসুটি মাইরা ঘুমাই। নাইলে ঝুড়ি চুরি হইয়া যাইব।
কারওয়ান বাজার ছাড়াও রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় রাতে সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, অনেক ভাসমান মানুষ বস্তা বা প্লাস্টিক বিছিয়ে শুয়ে আছেন। এদের মধ্যে কিশোর ও তরুণদের সংখ্যাই বেশি। তাদের একজন জসিম বলেন, দিনে কাগজ টোকাই। আর রাতে এইখানে ঘুমাই। মা-বাবা নাই। পুলিশ মাঝে মাঝে আইস্যা উঠায় দেয়। চইল্যা গেলে আবার আইস্যা পড়ি। রাজধানীর বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ও সদরঘাটেও ভাসমান মানুষকে রাতযাপন করতে দেখা যায়। একইভাবে নগরীর বিভিন্ন যাত্রী ছাউনি, ফুটওভার ব্রিজ, রাস্তার আইল্যান্ডেও তাদের ঘুমাতে দেখা যায়। মিরপুর শাহ আলী মাজার, হাইকোর্ট মাজার, পীরেরবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান মানুষ থাকছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বস্তি উন্নয়ন বিভাগের তথ্যে, ভাসমান মানুষের জন্য পাঁচটি পথবাসী কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই মধ্যে ঢাকার ধলপুরে দুই কাঠা জমি বরাদ্দ নিয়ে তার নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, সেই কেন্দ্রে মতিঝিল, কমলাপুর, বাসাবো, যাত্রাবাড়ী এলাকার দুই হাজারের মতো ভাসমান মানুষকে সেবা দেওয়া হবে। এছাড়া রাজধানীর মানিকনগরে আরেকটি পাঁচতলা কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে যেখানে বর্তমানে তিনশ ভাসমান মানুষ থাকছে। নাগরিক সুবিধার আওতায় আনার জন্য তাদের জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্যও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কাজ করা হচ্ছে। এতে তারা নাগরিক সুযোগ-সুবিধার আওতায় আসবেন। মূলত সিটি করপোরেশনের প্রতিটি জোনেই এই ধরনের কেন্দ্র নির্মাণের কথা রয়েছে।
এছাড়া বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ১০ লাখ ভিক্ষুকের জন্য ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় মানুষের আশ্রয়ের জন্য ছয়টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। যার ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার ৯শ’। যার প্রধানটি ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত। এছাড়া বাকিগুলো নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল, গাজীপুরের কাশিমপুর ও পুবাইল, ময়মনসিংহের ধলা ও মানিকগঞ্জের বেতি এলাকায়। বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদে দুই হাজার ভিক্ষুককে এসব আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতায় এই কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক মানুষকে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি।-বিডি প্রতিদিন
২৪ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ