বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১৬, ০৩:৫৫:২১

মুকুল রানা সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন

মুকুল রানা সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন

শেখ সাবিহা আলম: অভিজিৎ হত্যায় জড়িত সন্দেহভাজন জঙ্গি শরিফুলের আসল পরিচয় তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পুলিশ জানত না বলে পুলিশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন। তবে, তাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, বন্দুকযুদ্ধে নিহত শরিফুলের প্রকৃত নাম মুকুল রানা হলেও অভিজিৎ হত্যায় তাঁর জড়িত থাকার বিষয়ে তাঁদের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে। কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার আগে এ ধরনের কথিত বন্দুকযুদ্ধের বিষয় কতটা স্বাভাবিক জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বলেন, পুলিশ প্রকৃত পরিচয় না-ও জানতে পারে। নিষিদ্ধ বা গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের অসংখ্য নাম থাকে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, খিলগাঁওয়ে ১৮ জুন দিবাগত রাতে তিনজন মোটরসাইকেল আরোহীকে সন্দেহ করে চ্যালেঞ্জ করলে গুলিবিনিময়ের ঘটনায় শরিফুল (মুকুল রানা) নিহত হন। মুকুলের দেহে ১০টি ছিদ্র (গুলির চিহ্ন) পাওয়া যায়। তবে মোটরসাইকেল আরোহী অপর দুজনের কোনো সন্ধান মেলেনি।


এদিকে, মুকুল রানার স্ত্রী, বাবা, শ্বশুরসহ আত্মীয়দের অনেকেই বলেছেন, এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি খুলনা-যশোর মহাসড়কের বসুন্দিয়া এলাকা থেকে মুকুল রানাকে হাতকড়া পরিয়ে গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার আগে ওই ব্যক্তির নাম মুকুল রানা বলে তাঁরা জানতেন না। তবে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তি যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার শীর্ষ নেতা, সে সম্পর্কে তাঁরা সুনিশ্চিত। পুলিশ পাল্টা প্রশ্ন তুলছে, ১৯ মে ‘জননিরাপত্তার স্বার্থে এদের ধরিয়ে দিন’ শিরোনামে বিজ্ঞপ্তি সব গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারের পরও কেন তাঁর পরিবারের তরফ থেকে কোনো খোঁজখবর করা হয়নি?


সাতক্ষীরার ধুলিহর ইউনিয়ন পরিষদের বালুইগাছা গ্রামে মুকুল রানার পৈতৃক বাড়ি ও যশোরের বসুন্দিয়ায় শ্বশুরবাড়িতে খোঁজখবর নিয়ে মুকুল রানার জীবন সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া গেছে। মুকুল রানাকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন উঠছে, যার উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। গতকাল বুধবার যশোরের বসুন্দিয়ায় মুকুল রানার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর স্ত্রী মহুয়া আক্তার ও ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁরা যে ভ্যানে করে বাড়ি থেকে বসুন্দিয়া বাজারে আসছিলেন, সেই ভ্যানচালক শেখ জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। মহুয়া আক্তার বলেন, ‘বসুন্দিয়া মোড়ে পৌঁছালে ১০-১২ জন হঠাৎ করে তাঁদের রিকশাভ্যানের সামনে এসে মুকুলকে জাপটে ধরে। এ সময় আমি দৌড়ে পাশের দোকান থেকে বাড়িতে ফোন করি।’ ভ্যানচালক জাহিদও বলেন, ‘বসুন্দিয়া মোড়ে পৌঁছালে কয়েকজন লোক মুকুলকে ধরে দুই হাতে হাতকড়া পরায়। কোনো কথা বলার আগেই তারা মুকুলকে মাইক্রোবাসে তুলে দ্রুত বেগে চলে যায়।’ ওই ঘটনার দুদিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি মুকুল রানার শ্যালক আমির হোসেন যশোর কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর থেকে তাঁরা মুকুল কোথায়, কীভাবে আছেন, সে সম্পর্কে কিছু জানতে পারেননি।


এদিকে, সাতক্ষীরার বালুইগাছায় গিয়ে মুকুলের বাবা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর ছেলে বিয়ে করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি বউভাতের পর ছেলে এবং ছেলের বউয়ের সঙ্গে তিনিও যশোরের বসুন্দিয়ার জগন্নাথপুরে যান। ঘটনার দিন মুকুল তাঁকে আগেই রওনা দিয়ে দিতে বলেন। আবুল কালাম আজাদ যখন বসুন্দিয়া থেকে যশোরের কেশবপুরে পৌঁছান, তখন তাঁকে জানানো হয়, ছেলেকে কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে। তিনি মুকুলের শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে মামলা করার পরামর্শ দেন। ছেলের খোঁজে তাঁর শ্যালক মুজিবুর রহমান বিশ্বাস ঢাকায় গেছেন বলে জানতে পারেন। পরে শোনেন, মুজিবুরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।


১৯ মে ছবি প্রকাশের পর আবুল কালাম আজাদ কেন খোঁজখবর করেননি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ছেলের নাম তো শরিফুল নয়। আর আমি জানি, তাকে ডিবি তুলে নিয়ে গেছে। তাহলে আবার কেন ধরিয়ে দিতে ছবি ছাপা হবে এ নিয়ে ধন্দে পড়ে যাই।’ তিনি পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন কি না, কেন ডিবি ছেলেকে তুলে নিয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু জানেন কি না জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, তিনি সাতক্ষীরার প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তবে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। প্রভাবশালীদের নাম জানতে চাইলে তিনি তাঁদের স্থানীয় উল্লেখ করে আর বিস্তারিত জানাতে চাননি।


বন্দুকযুদ্ধে ছেলে নিহত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ছেলে যদি খুনি হয়ে থাকে, তবে তাঁর বিচার হওয়া দরকার ছিল। তাহলে মানুষ জানত, জঙ্গি হামলার পেছনে কারা আছে। পুলিশ যা বলছে জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে যুক্ত ডিবির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত বৃহস্পতিবার শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুল হত্যাচেষ্টায় আটক শিহাবের একাধিক নাম আছে। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত বাবা-মায়ের রাখা সুমন হোসেন পাটোয়ারী নামটি পুলিশ বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কেউ জানত না। এ ছাড়া নিহত শরিফুল যে অভিজিৎ রায় হত্যায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই ভিডিও ফুটেজ পুলিশের কাছে আছে। তিনি বলেন, ভিডিও ফুটেজের অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার অংশগুলো তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করা হচ্ছে না। তাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত আরও যে খুনিরা আছেন, তাঁরা পালিয়ে যেতে পারেন।


মুকুল সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন:
মুকুল রানা যে সাতক্ষীরা কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন, সেই কলেজের কমপক্ষে পাঁচজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের কেউ মুকুল রানাকে চিনতে পারেননি। ইংরেজি সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান মো. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ফরম মুকুল রানা পূরণ করেননি। শুধু ওই প্রতিষ্ঠানের চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারী জানিয়েছেন, তিনি মুকুল রানাকে চিনতেন। পাঁচ-সাত মাস কলেজে এসেছেন, তবে অনিয়মিত। মুকুল রানা কী করতেন, সে বিষয়ে তাঁর বাবা আবুল কালাম আজাদ বা তাঁর শ্বশুর মোবারক বিশ্বাস কেউই সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। আবুল কালাম আজাদ জানতেন, ছেলে ঢাকায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) হিসাবরক্ষকের কাজ করেন। বছরে দু-তিনবার বাড়ি আসতেন, দু-তিন দিনের বেশি থাকতেন না। কারও সঙ্গে মেলামেশাও করতেন না।
শ্বশুর বলেন, ‘বিয়ের আগে আমরা মুকুল রানার বাড়িতে গিয়েছিলাম। ছেলেটা কী কাজ করে, ততটা ভালো করে খোঁজখবর করা হয়নি। ওই বাড়ির লোকজন বলল, মুকুল ঢাকায় একটি প্লাস্টিক কারখানায় ছোটখাটো কাজ করে। তবে ওদের আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো। তাই বাড়ির সামনে প্যান্ডেল করে বড় অনুষ্ঠান করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।’ আত্মীয়স্বজন এবং এলাকার লোকজন কেউই কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে মুকুলের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।


মুকুল রানার মা সিনা খাতুন বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসেই মুকুল বিয়ে করার কথা বলেন। মুকুলের বাবা পাশের গ্রামের একটি মেয়েকে পছন্দ করেন। ছেলে রাজি হননি। তিনি নিজেই তাঁকে যশোরের জগন্নাথপুরের একটি মেয়েকে বিয়ে করবেন বলে জানান। তাঁরা ছেলের সিদ্ধান্ত মেনে নেন। ডিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, শরিফুলের সঙ্গে মহুয়ার বিয়ের সম্বন্ধ করেন মহুয়ার ভাই মুজিবুর রহমান বিশ্বাস। তিনি জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এখন কারাগারে আছেন। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে এই মুজিবুর দাওয়াতি শাখার সদস্য। ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, মুজিবুর রহমান বিশ্বাস পেশায় একজন ইউনানি চিকিৎসক। যেসব রাসায়নিক সবাই কিনতে পারেন না, সরকারের নিবন্ধনভুক্ত ইউনানি চিকিৎসকেরা সেগুলোও কিনতে পারেন। এসব রাসায়নিক দিয়ে বিস্ফোরক বানানো সম্ভব।


পুলিশ বলছে, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনটিতে এমন ইউনানি চিকিৎসক আরও আছেন। এঁরা এসব উপকরণের জোগান দিয়ে থাকেন। পুলিশ বলছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার সদস্যরা দলের সিদ্ধান্তে বিয়ে করেন এবং জানিয়ে রাখেন, তাঁদের যেকোনো সময় মরতে হতে পারে। তাঁরা যেমন প্রতি মাসে দল থেকে মাসোহারা পান, তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানেরাও পেয়ে থাকে।-প্রথম আলো

২৩ জুন, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে