মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০২:৪০:২৫

‘তিনি ছিলেন কংগ্রেসের বড় মাপের নেতা’

‘তিনি ছিলেন কংগ্রেসের বড় মাপের নেতা’

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত : নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এপার বাংলা-ওপার বাংলা, দুই বাংলাতেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন। এখনো আছেন। নেতাজি সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের নানা তদন্তের ৬৪টি ফাইল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গোয়েন্দাদের হাতে ছিল। আরও শতাধিক ফাইল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আছে বলে খবর। গত শুক্রবার ঘটা করে পুলিশের সদর দফতরে পশ্চিমবঙ্গে থাকা ফাইলগুলো প্রকাশ্যে আনা হয়। এ পর্যন্ত ফাইল ঘেঁটে ইতিহাসবিদ নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের ব্যাপারে খুব একটা বেশি তথ্য পাননি। নেতাজি স্বাধীনতা সংগ্রামের নিশ্চয়ই একজন বড় মাপের কংগ্রেস নেতা ছিলেন। কংগ্রেসের সঙ্গে তার নীতিগত বিরোধ দেখা দিলে তিনি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন।

স্বাধীনতার পর ভারত কোন পথে যাবে, গণতন্ত্রে না একনায়কতন্ত্রে- নেতাজির সঙ্গে তাই নিয়ে বিরোধ বাধে কংগ্রেসের। নেতাজির প্রস্তাব ছিল, স্বাধীনতার পর ভারতে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে গান্ধীজি, জওহরলাল নেহরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলরা আপত্তি করেন।

নেহরু সুভাষকে বলেন, দেশের প্রতিটি নাগরিক স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। তাদের ভোটেই স্থির হবে ভারত কোন পথে যাবে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের শতবর্ষ উপলক্ষে কংগ্রেসের যে ইতিহাস প্রকাশ করা হয়েছিল তার সম্পাদনা করেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। সে বইতেও এ বিরোধের কারণ হিসেবে তা-ই বলা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, নেতাজি এখনো বেঁচে আছেন। তিনি নাকি কোনো ফাইলে দেখেছেন, 'তিনি এখানে বা ওখানে' আছেন। ওয়াকিবহাল সূত্রে বলা হয়, মমতা, কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল এবং পুলিশ কমিশনার- এ তিনজন মিলে নির্বাচনের আগে বাঙালিদের মন জয় করার জন্য, তাদের ভোট পাওয়ার জন্য এই চমক দিয়েছেন। কারণ এ মুহূর্তে রাজ্যের যা পরিস্থিতি, তাতে ভোটে জিতে আসা তার পক্ষে একটু কঠিন।  

নেতাজি ১৯৪৫ সালে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, তা জার্মানি থেকে একটি সাক্ষাৎকারে নেতাজির কন্যা অনিতা পাক বলেছেন, তিনি মায়ের কাছ থেকে শুনেছেন যে ১৯৪৫ সালেই বিমান দুর্ঘটনায় তার বাবা সুভাষ চন্দ্র বসু মারা গেছেন। অন্যদিকে নেতাজি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কৃষ্ণ বসু জানিয়েছেন, কাকিমা (নেতাজির স্ত্রী এমিলি শেঙ্কেল) তার রান্নাঘরের রেডিওর খবরে শুনেছিলেন, ইন্ডিয়ান কুইসলিং সুভাষ বসুর বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার আইরিশ বান্ধবী মিসেস উডস সান্ত্বনা দিয়ে লিখেছিলেন, হয়তো এ খবর সত্যি নয়। এরা অল্প সময়ের মধ্যেই ভাবতে শুরু করেছিলেন এ খবর সত্যি নয় হয়তো। নেতাজি এবারও ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়েছেন। নেতাজির মৃত্যু ও তার অন্তর্ধান সম্পর্কে আমি দুজনের মুখে যা শুনেছি সেটাই জানাচ্ছি।

নেতাজি যেদিন কলকাতা ছাড়েন সে ব্যাপারে ভারতের প্রথম বিদেশ সচিব এবং ঢাকার প্রথম রাষ্ট্রদূত সুবিমল দত্ত বলেছিলেন, 'আমরা যে কজন সচিব ছিলাম অবিভক্ত বাংলার তারা প্রতিদিন দুপুরে তৎকালীন অতিরিক্ত চিফ সেক্রেটারি জে এন তালুকদার এবং আরও কয়েকজন মিলে একসঙ্গে টিফিন করতাম। ওই দিন সবাই বসে থাকলেও জে এন তালুকদারের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় চার ঘণ্টা বাদে ঘরে ঢুকে বলেছিলেন, যাক, এবার আমি নিশ্চিন্ত। সুভাষ চন্দ্র ধানবাদ থেকে ট্রেনে উঠে পড়েছেন। সুভাষ যে ধানবাদ থেকে ট্রেনে উঠে পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তান যাবেন সে খবর কয়েকজন ভারতীয় অফিসারের কাছে ছিল। টিফিন সেরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তালুকদার বলেছিলেন, যাই গভর্নরকে খবরটা দিয়ে আসি যে সুভাষ পালিয়ে গেছেন।

সুভাষ ততক্ষণে পাঞ্জাব থেকে আফগানিস্তানের ট্রেন ধরে নিয়েছেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি আটের দশকের মাঝামাঝি জাপানের কনসাল জেনারেল ছিলেন। নেতাজি রাশিয়ায় এসে কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আবার জার্মানিতে ফিরে যান। নেতাজি জাপানে গিয়ে কুইসলিং তোজোর সঙ্গেও পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই কনসাল জেনারেল সে সময় জাপানের জুনিয়র অফিসার। তাকে সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গী হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। নেতাজিকে নিয়ে তিনি তাই হোকুর সেনাশিবিরে এসেছিলেন। সেখানে তিন-চার দিন ছিলেন সুভাষ বসু।

হঠাৎ একদিন সুভাষ বললেন, তিনি সিঙ্গাপুর যাবেন। সে সময় তাকে একটি ডাকোটা বিমানে তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে বিমানটি উড়েই পড়ে যায়। ওই কনসাল জেনারেল বলেছিলেন, নেতাজিকে মারার জন্য কেউ ষড়যন্ত্র করেনি। এটা নেহাতই দুর্ঘটনা। নেতাজি জার্মানিতে গিয়ে যে হিটলারের সঙ্গে দেখা করেছেন সে খবর ভারতে আসার পর কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সে সময় সুভাষ বলেছিলেন, 'শত্রুর শত্রু, আমার মিত্র'। আন্দোলন, তার দেশত্যাগ ইত্যাদি নিয়ে একটা মিথ হয়ে আছেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। নির্বাচনের আগে সে মিথ্যাটাকেই কাজে লাগাতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

জাতীয় কংগ্রেস এবং বামপন্থিরা বলছেন, ভারতে নেতাজিকে নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় সহস্রাধিক বই বেরিয়েছে। এ ফাইলগুলো প্রকাশ করার পর নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে নেতাজি কি এখনো জীবিত? সত্যিই বেঁচে থাকলে এখন নেতাজির বয়স হতো ১২০ বছর। নিজে ৬৪টি ফাইল প্রকাশ করে এবার কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভা ভোটের আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছিলেন, নেতাজি-সংক্রান্ত সব ফাইল প্রকাশ্যে আনবেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক খারাপ হওয়ার অজুহাত দিয়ে ফাইলগুলো আটকে রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার।-বিডিপ্রতিদিন
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে