স্পোর্টস ডেস্ক: দিনের পর রাত হলেই বহুল প্রতীক্ষিত এল ক্লাসিকো। দিনের পর রাত হলেই বহুল প্রতীক্ষিত এল ক্লাসিকো। দিনের পর রাত হলেই বহুল প্রতীক্ষিত এল ক্লাসিকো, মর্যাদার লড়াইয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে নামবে লুই এনরিকে আর জিনেদিন জিদানের ছাত্ররা।
ন্যু ক্যাম্পে ৬ পয়েন্টের ব্যবধান কমিয়ে আনতে পারবে বার্সা, নাকি ব্যবধান ৯ এ নিয়ে যাবে মাদ্রিদিস্তারা, সেটা আপনি আপনার মত করে অনুমান করতে থাকুন। এর আগে নাহয় একবার পড়ে নিন ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত এল ক্লাসিকোটির কথা, যে ম্যাচ দিয়েই শুরু আজকের রিয়াল-বার্সা উত্তাপের!
২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর ঘরের মাঠে হোসে মরিনহোর রিয়ালকে যখন ৫-০ গোলে বিধ্বস্ত করল গার্দিওলার বার্সা, অনেকের চোখেই খেলা করে গিয়েছিল বিস্ময়। এল ক্লাসিকোতে রিয়াল এত বড় ব্যবধানে হারতে পারে!
কিন্তু, ফুটবল ইতিহাস সম্পর্কে যাদের টুকটাক জ্ঞান আছে, তারা নিশ্চয়ই জানেন, এর চেয়ে ঢের বড় ব্যবধানেও নিষ্পত্তি হয়েছে এল ক্লাসিকোর। যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত ম্যাচটির ফলাফল আপনার না জানা থাকলে এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠতে পারেন। ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত সেই ম্যাচটির স্কোরলাইন ছিল এরকম- রিয়াল মাদ্রিদ ১১- ১ বার্সেলোনা!
বিশ্বাস না হয়ে থাকলেও এটাই সত্যি, নিজেদের স্টেডিয়ামে বার্সাকে ১১-১ গোলেই হারিয়েছিল রিয়াল। কিন্তু এই ম্যাচের পেছনে আছে একটা গল্প, আছে একজন সামরিক শাসকের দাম্ভিকতার কাহিনী, একদল হিংস্র সমর্থকের ক্ষিপ্ত সমর্থনের কাহিনী। রোমাঞ্চকর সেই কাহিনী পড়বার জন্য স্বাগতম সবাইকে।
১৯৪৩ সালের ১৯ জুন, ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার ফুটবলারেরা যখন এস্তাদিও কামার্টিন (তখনকার রিয়াল মাদ্রিদের হোম ভেন্যু) এ পা রাখছিলেন, ফুটবলবিশ্ব তখনো অজ্ঞাত সামনের ৯০ মিনিট তাদের জন্য কি নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। বার্সেলোনার মত ক্লাব ১১-১ গোলে হারবে, এটা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়! এটা তো পাড়ার কোন ফুটবল ম্যাচ না, কোপা ডেল জেনেরালিসিমোর(বর্তমান কোপা ডেল রে’র তৎকালীন নাম) সেমিফাইনাল ম্যাচ!
এই ম্যাচে এমন স্কোরলাইন আর যাই হোক, স্বাভাবিক বলা চলে না। ব্যাপারটা আরও অস্বাভাবিক ঠেকবে যখন জানবেন আগের লেগেই এই রিয়ালকেই ৩-০ গোলে হারিয়েছিল কাতালানরা! প্রথমার্ধ শেষেই ৮-০, ৯০ মিনিট শেষে ১১-১, এই অদ্ভুতুড়ে স্কোরলাইনের পেছনের গল্প শুনতে হলে ফিরে যেতে হবে ’৪০ এর দশকে, জেনারেল ফ্রাঙ্কোর শাসনামলে।
খেলার সাথে রাজনীতির যোগসূত্র নতুন কিছু নয়। সভ্যতার আদিকাল থেকেই ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে খেলাকে। ইতিহাসের সকল স্বৈরশাসকেরাই ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার প্রভাবক হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে খেলাকে। স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি।
১৯৩৯ সালে গৃহযুদ্ধ সমাপ্তির পর ক্ষমতায় জাঁকিয়ে বসলেন ফ্রাঙ্কো, নিজেকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ঘোষণা করলেন। ক্ষমতায় এসেই যিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমার শাসনামল নির্মিত হবে বেয়নেট ও রক্তের উপর, কোন হিপোক্রিটিকাল নির্বাচনের উপর নয়!’
স্ট্যালিন যেমন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে নিয়েছিলেন মস্কোকে, হিটলার যেমন বানিয়েছিলেন বার্লিনকে, ফ্রাঙ্কো তেমনি বানালেন মাদ্রিদকে। মাদ্রিদকেই বানাতে হত, ফ্রাঙ্কো যে ক্যাস্টিল অঞ্চলের মানুষ!
মাদ্রিদ বনাম বাকি স্পেন:
বস্ক এবং কাতালুনিয়া, এই দুই অঞ্চলের মানুষের প্রতিই দারুণ ক্ষোভ ছিল ফ্রাঙ্কোর। এখন যেমন বার্সার স্টেডিয়ামে ব্যানার দেখতে পাওয়া যায় ‘উই আর নট স্পেন’ লিখা, তখনো এই দুই অঞ্চলের মানুষদের মাঝে এই একই মনোভাব বজায় ছিল। তারা স্বায়ত্বশাসন চেয়েছিল, স্পেন থেকে আলাদা হতে চেয়েছিল। আর এটাই মেনে নিতে পারেননি ফ্রাঙ্কো, তার মতে এটা বহির্বিশ্বের কাছে স্পেনের বিভক্ত জাতিসত্ত্বাকে তুলে ধরে।
ফ্রাঙ্কো তাই ঠিক করলেন, কোন আঞ্চলিক আন্দোলন বেড়ে উঠতে দেয়া যাবেনা, স্পেনে রাজত্ব থাকবে শুধু ক্যাস্টিলদের। সবাইকে কথাও বলতে হবে ক্যাস্টিলদের ভাষাতেই। আর এটাই গায়ে লাগল স্বাধীনতাকামী কাতালানদের। আইন করে যখন নিজস্ব ভাষায় কথা বলা বন্ধ করে দিলেন ফ্রাঙ্কো, তখন কাতালানদের সমস্ত আশা-ভরসা প্রতিবাদের জায়গা হয়ে উঠল তাদের ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা।
বার্সেলোনার স্টেডিয়াম হয়ে উঠল একমাত্র জায়গা, যেখানে তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলতে পারত, নিজেদের পতাকা উড়াতে পারত। বার্সার আজকের যে মোটো, মোর দ্যান এ ক্লাব, তা গড়ে উঠেছিল ওই সময়েই। শুধু তো একটা ক্লাব না, বার্সা তো একটা জাতিগোষ্ঠীর আশা-নিরাশার আশ্রয়স্থল!
ঐতিহাসিক সেই ম্যাচ:
১ম লেগে ৩-০ তে জেতা ম্যাচে বার্সা সমর্থকেরা ‘শোষক’ দের বিপক্ষে এমন জয়ে দারুণ উল্লাস প্রকাশ করেছিল মাঠেই। শোষক বলা, কারণ রিয়াল ছিল জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সমর্থনপুষ্ট দল। যতবারই রিয়ালের ফুটবলারদের পায়ে বল যাচ্ছিল, বার্সা সমর্থকেরা দুয়ো দিচ্ছিল। মাদ্রিদ সমর্থকেরা এই ক্ষোভ মনে মনে পুষে রেখেছিল। সেই ক্ষোভের উদগিরণ কতটা ভয়ানক হতে পারে, দ্বিতীয় লেগে সেটা টের পেয়েছিল বার্সা ফুটবলাররা।
দ্বিতীয় লেগ খেলতে যখন বার্সা মাদ্রিদে পৌঁছাল, পরিস্থিতি তখনই বেশ উত্তপ্ত। সেই আগুনে আরও ঘি ঢাললেন মার্কার সাংবাদিক, মাদ্রিদ সমর্থক আরনেস্টো টিউস। আগের লেগে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে হারের খুঁটিনাটি তুলে ধরে জ্বালাময়ী এক লেখা লিখলেন তিনি, আর সেই লেখাই যেন আরও খেপিয়ে তুলল মাদ্রিদ সমর্থকদের। ম্যাচের ভেন্যু এস্তাদিও কামার্টিন তখন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে, প্রত্যেক মাদ্রিদ সমর্থক যেন মুখিয়ে আছে অপমানের যোগ্য জবাব দেয়ার জন্য।
২০ হাজার ক্ষিপ্ত উন্মত্ত সমর্থক ‘কাতালান ব্লাড’ ঝরানোর আবেদন নিয়ে কোরাস গাইছিল! মাদ্রিদ সমর্থকেরা এতটাই হিংস্র হয়ে উঠে যে তারা বার্সা প্লেয়ারদের মাথা কেটে ফেলার কথাও বলছিল বারবার! এরকম কোরাসে ভয় পেয়ে যান প্রত্যেক বার্সা ফুটবলার, নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পরেন তারা। শঙ্কিত করার কাজটা ম্যাচের আগেই একদফা করে এসেছিলেন ফ্রাঙ্কো সাম্রাজ্যের ডিরেক্টর অফ স্টেট সিকিউরিটি। বার্সা ড্রেসিংরুমে গিয়ে ভয়ানক ভাষায় মনে করিয়ে দিয়ে এসেছিলেন, মাদ্রিদের করুণাতেই তারা কাতালুনিয়া অঞ্চলে টিকে আছে।
স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তির এমন হুমকি ও প্রতিপক্ষ সমর্থকদের খুনে মানসিকতা- সব মিলিয়ে বার্সা ফুটবলাররা ভয়ানক ঘাবড়ে যান। মাঠে তারা স্বাভাবিকভাবে মুভ করতে পারছিল না, প্রতিবার সেই ‘কাতালান ব্লাড’ ঝরানোর কোরাস। সেই আতঙ্কেরই প্রতিফলন পরল স্কোরলাইনে, ১১-১! রিয়ালের ১১ গোলের ৮ টিই এসেছিল ম্যাচের প্রথমার্ধে।
তৎকালীন বার্সা প্রেসিডেন্ট এমন ঘটনায় হকচকিয়ে গিয়ে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। দর্শকদের এমন আচরণ ও খেলার অন্যায় ফলাফল নিয়ে লিখেছিলেন বলে সাংবাদিক হুয়ান অ্যান্টোনিও সামারাঞ্চকে ১০ বছর কলম ধরতে দেয়া হয়নি! এই দিনের পর থেকেই বদলে গেল মাদ্রিদ-বার্সা ইতিহাস। আজকের এই আগুন ঝরা লড়াইয়ের সূত্রপাতও এই ম্যাচকে ঘিরেই। এমনি এমনি তো আর এক দলের সমর্থকেরা অন্য দলের সমর্থকদের চক্ষুশূল জ্ঞান করে না!
শেষটা করা যাক ছোট্ট আরেকটা তথ্য দিয়ে। হুমকি ধামকি দিয়ে কাতালানদের হারালেও শেষ পর্যন্ত ওই ট্রফি কিন্তু মাদ্রিদ জিততে পারেনি। অ্যাটলেটিক বিলবাও কিংবদন্তি তেলমো জারা একাই ফাইনালে হারিয়ে দেন মাদ্রিদকে। এক অর্থে তাই সেমিফাইনালে হেরেও ফাইনালে জিতেছিল বার্সেলোনাই! খেলাধুলা, স্পোর্টসকিডা অবলম্বনে
৩ ডিসেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর