জুবায়ের আল মাহমুদ রাসেল: চোখের পলকে পার হয়ে গেল ৫টি বছর। একটা সময় ছিল যখন আফতাব আহমেদ বাংলাদেশ দলের হয়ে ব্যাট হাতে মাঠে নামতেন, তখন গ্যালারীতে বসে থাকা হাজারো দর্শক তার ব্যাটিং নৈপূণ্যতে মুগ্ধ থেকেছেন। যার বিশাল এক ছক্কায় ২০০৫ সালে নেটোওয়েস্ট সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম জয়ের স্বাদ পেয়েছিল কোটি বাঙালি। ক্রিকেট পাগল এই মানুষটি সর্বশেষ দেশের জার্সিতে খেলেছেন ২০১০ সালে। টাইগারদের একসময়ের মারকুটে ব্যাটসম্যান সেই আফতাব এখন কি করছেন? জীবনের প্রতিটি দিন তিনি কিভাবে কাটাচ্ছেন?
বাংলাদেশ ক্রিকেটের নবযাত্রার অন্যতম নায়ক এই আফতাব আহমেদ। যিনি ব্যাটিংয়ে নামলেই প্রতিপক্ষ বোলারদের হৃদ স্পন্দন একটু হলেও কাঁপতো। সেই মারকুটে টাইগারের অভিষেক হয় ২০০৪ সালে বার্মিংহামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। আর টেস্ট অভিষেক হয় একই বছর চট্টগ্রামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।
আফতাব আহমেদের বয়স এখন ৩০ বছর। যে মানুষটিকে এ বয়সে জাতীয় দলে খেলার কথা তিনি গত বছরই বলে দিয়েছিলেন, প্রিমিয়ার লিগের শেষ আসরের খেলাটা তার জীবনের শেষ খেলা। তাহলে আফতাবের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? তিনি ক্রিকেট ছেড়ে কি করতে চান? উত্তরটাও সেদিন তিনি বলেছিলেন। আফতাব আহমেদের লক্ষ্য ক্রিকেট কোচ হওয়া। বর্তমানে তিনি তার সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্যে ক’দিন আগে কোচেস কোর্সও করেছেন।
ক’দিন বাদে সত্যি সত্যি তিনি কোচ হিসিবে আত্মপ্রকাশ করেন। চট্টগ্রামে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের পাশেই চট্টগ্রাম বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে। মূলত সেখানেই চলছে আফতাবের ক্রিকেট একাডেমি। হলুদ জার্সি পরে শতাধিক ছেলে অনুশীলন করছিল মাঠে। যাদের গুরুর নাম আফতাব। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের শুরুর পাঠটা যার হাত ধরেই এসেছিল। আইসিএল কাণ্ডের পর জাতীয় দলে শেষ বার খেলেছিলেন ২০১০ সালে। এখন ‘আফতাব আহমেদ ক্রিকেট একাডেমি’ নিয়েই দিন কাটছে তার।
টাইগার ক্রিকেটের অহংকার আফতাবের জন্ম ও শৈশব দুটোই কেটেছে চট্টগ্রামে। তার প্রথম বিদ্যালয় সেন্ট মেরি স্কুল। শুরুর দিকে আফতাবের আন্তর্জাতিক খেলার প্রতি তেমন টান ছিল না, এমনকি তিনি এটাকে নির্যাতন বলেও মনে করতেন। পরিবার ও বন্ধুবান্ধব থেকে দূরে থাকতে হবে ভেবে তিনি বিকেএসপিতে ভর্তি হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার পিতা ক্রীড়ামোদী ছিলেন এবং তার ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। আফতাব তার ক্রিকেটীয় জীবন সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেননা এবং তার ক্রিকেট ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসার ঘটনাও রয়েছে। দলে সুযোগ না পাওয়ার কারণে তার মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি বলেন, "আমি অনেক বার ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলাম, কিন্তু কখনো দলে ঢুকতে পারিনি।" শেষ পর্যন্ত প্রতীক্ষার অবসান ঘটে এবং তিনি দলে সুযোগ পান। তার পিতা ১৯৯৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলাকালে মারা যান।
আফতাব তার কোচিং সেন্টারের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেন গত ফেব্রুয়ারিতে। ক্ষুদে ক্রিকেটাররাই তার পাঠশালার ছাত্র। সপ্তাহে চারদিন চলে প্রশিক্ষণ। মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠ ও নাসিরাবাদ বয়েজ স্কুল মাঠে পালা করেই চলছে তার এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। জাতীয় দলে অনেকদিন ধরেই তামিম ছাড়া চট্টগ্রামের কোনো প্রতিনিধি নেই। পাঁচ মাসের প্রশিক্ষণে আফতাব নাকি খুঁজে পেয়েছেন কিছু প্রতিভাবান তরুণকে। যারা হয়তো ঠিকমতো গড়ে উঠলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন। মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স চত্বরে বসেই জানালেন, “আমার এই একাডেমিতে মূলত আসছে একেবারেই অপরিপক্ক ক্রিকেটাররা। যারা হয়তো ক্রিকেটের কোনো নিয়মই জানে না। তারপরও বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান ক্রিকেটারের খোঁজ পেয়েছি। যাদের ঠিকভাবে পরিচর্যা করলে একদিন হয়তো ভালো কিছু করতে পারে। খেলতে পারে জাতীয় দলেও।”
আগামি প্রজন্মের ক্রিকেটার সম্পর্কে আফতাব বলেন, “আমি যদি চট্টগ্রাম থেকে এবং চট্টগ্রামে প্র্যাকটিস করে জাতীয় দলে সুযোগ পেতে পারি তাহলে এরা কেনো পারবে না। অবশ্যই সম্ভব এদেরও ভালো কিছু করা। এদের মধ্য থেকেই হয়তো একদিন নান্নু-আকরামদের খোঁজ পাওয়া যাবে।”
তবে অপ্রাপ্ত বয়সে কেন তিনি ক্রিকেট ছেড়েছেন তা স্পষ্ট করেন নি। তবে তার চোখে মুখে ফুটে উঠছিল কোন এক অজানা অভিমান। যে অভিমানে তিনি ক্রিকেটকেই বিদায় জানিয়েছেন। শেষ দিকে আফতাব শুধু এটুকু বলেন, ‘ক্রিকেট বোর্ড আমার সাথে যেটা করেছে, তা যেন আর কোন ক্রিকেটারের সাথে করা না হয়।’
আফতাব আহমেদ আর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ওয়ানডে খেলেছেন ৮৫টি, ২৪.৭৩ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন ১৯৫৪ এবং উইকেট পেয়েছেন ১২টি। ওয়ানডে ম্যাচে সেঞ্চুরি না পেলেও হাফ সেঞ্চুরি করেছেন ১৪টি। সেরা ব্যাটিং ও বোলিং স্ক্রোর যথাক্রমে ৯২ নট আউট ও ৩১ রানে ৫ উইকেট।
এছাড়া তিনি ১৬ টেস্ট খেলে ২০.৭৮ ব্যাটিং গড়ে রান করেছেন ৫৮২। যার মধ্যে ১টি হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে। সেরা ব্যাটিং ৮২ নট আউট এবং উইকেট পেয়েছেন মোট ৫টি।
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/এমআর