‘রেফারি চেয়েছিল বলেই ভারত চ্যাম্পিয়ান হয়েছে’
সুরজিৎ সেনগুপ্ত, কেরালা থেকে : অনেক ভারতবাসীর মতো আমিও দেশের জয় চাইছিলাম। তবে আমার মনে হল, আমাদের থেকে রেফারিই বোধহয় বেশি করে ভারতের জয় চাইছিল। ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে হচ্ছে, নিরপেক্ষ থাকা আমার দায়। একটা সত্যি কথা না বলে থাকতে পারছি না, রেফারি চেয়েছে বলেই ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
ভারত যে যোগ্য দল হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হয়নি, তা বলছি না। যোগ্য দলের জয় কলঙ্কিত হয়ে গেল রেফারির হস্তক্ষেপে। দু–দুটি নিশ্চিত পেনাল্টি থেকে আফগানিস্তানকে বঞ্চিত করলেন জাপানের রেফারি কিমুরা। ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে একবার বক্সের মধ্যে অর্ণব মণ্ডলের হ্যান্ডবল এড়িয়ে গেলেন, আর একবার ফয়জল শায়েস্তাকে বক্সের মধ্যে পেছন থেকে বিকাশ জাইরু ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেও পেনাল্টি দিলেন না। আগের সাফ কাপের ফাইনালে এই আফগানিস্তানের কাছে হেরে রানার্স হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল ভারতকে।
গতবছরের ফাইনালের মধুর প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ ছিল ভারতের সামনে। সুযোগটা দারুণভাবে কাজে লাগাল। ধারে ভারে ভারতের তুলনায় আফগানিস্তান এগিয়ে থাকলেও মন বলছিল ভারতই চ্যাম্পিয়ন হবে। আসলে সুনীল ছেত্রিদের গ্রুপ লিগ ও সেমিফাইনালের খেলা আমাকে আশাবাদী করে তুলেছিল। এক দিকে দুরন্ত ফর্মে থাকা ভারতীয় দল, তার ওপর ঘরের মাঠে খেলা। কনস্টানটাইনের দলকে নিয়ে আশাবাদী না হওয়ার কোনও কারণ ছিল না।
শুরু থেকেই যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সুনীলরা, দেখে মনে হচ্ছিল জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু খেলা যত গড়াল, প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ম্যাচের ওপর ক্রমশ আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করল আফগানরা। ১৪ মিনিটেই এগিয়ে যেতে পারত ভারত। বাঁদিক থেকে বল নিয়ে ঢুকে হোলিচরণকে পাস দেন জেজে। হোলিচরণের ক্রস আমিরির পায়ে লেগে গোল হয়ে যাচ্ছিল। আফগানিস্তানের গোলকিপার অবিশ্বাস্যভাবে সেই বল বাঁচিয়ে দেন।
ফিরতি বলে ৬ গজ বক্সের মধ্যে থেকে জেজের হেড আবার সেই একই দক্ষতায় বাঁচিয়ে দলের নিশ্চিত পতন রোধ করেন আজিজি। এই ধাক্কা সামলে উঠে খেলার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে শুরু করে আফগানরা। জুবেইর আমিরি, ফয়জল শায়েস্তার নেতৃত্ব মাঝমাঠের দখল নিয়ে নেয়। নারায়ণ দাসের তুলনায় প্রীতম কোটালকে একটু বেশিই দুর্বল মনে হয়েছিল আফগানদের। তাই বাঁদিক দিয়ে বারবার আক্রমণ তুলে নিয়ে আসছিল।
তা ছাড়া ডান দিকে আফগানদের সীমাবদ্ধতাও থাকতে পারে। সেইজন্য বাঁ প্রান্তকে হয়ত বেছে নিয়েছিল। তবে আফগানিস্তানের পরিকল্পনা দেখে একটু অবাকই হলাম। ভারতীয় ডিফেন্সে অর্ণব মণ্ডল ও অগাস্টিন ফার্নান্ডেজের মতো দু’জন লম্বা ফুটবলার, গোলকিপার গুরপ্রীত সিংও দীর্ঘদেহী। তা সত্ত্বেও উঁচু করে বল তুলে খেলে গেল আফগানরা। কেন এই ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছিল, বোধগম্য নয়। জমিতে বল রেখে খেলতে গেলে যে ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হয়, তা কিন্তু আফগানদের নেই।
ফলে, ভারতের গোলে দ্রুত পৌঁছনোর জন্য এরিয়াল বলে খেলার চেষ্টা করছিল। এই কৌশল দিয়ে ভারতীয় দলের ডিফেন্স ভাঙা সম্ভব ছিল না। যে–সব সেন্টার ভারতীয় বক্সে ভেসে আসছিল, গুরপ্রীত সিং অনায়াস দক্ষতায় লুফে নিচ্ছিল। সুনীল ছেত্রিকেও দেখছিলাম হাত তুলে উঁচু করে বল চাইছিল। আফগানদের বড় চেহারার মাঝে ওইরকম উচ্চতা নিয়ে কেন উঁচু বল চাইছিল, বুঝলাম না। প্রথমার্ধে বেশ কয়েকবার গোল করার মতো জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল আফগানিস্তান। তবে ফয়জল শায়েস্তা দিনের সহজতম সুযোগ নষ্ট না করলে প্রথমার্ধেই এগিয়ে যেতে পারত আফগানরা।
তীয়ার্ধে ছবিটা বদলে গেল। ভারত চাপ দিতেই আফগানিস্তানকে অতি সাধারণ মানের দল মনে হচ্ছিল। এই সময় অনেক বেশি আধিপত্য দেখাতে শুরু করেছিল সুনীলরা। এর প্রধান কারণ হোলিচরণ নার্জারি ও বিকাশ জাইরুর জায়গা বদল। প্রথমার্ধে বাঁদিকে খেলছিল হোলিচরণ, ডানদিকে বিকাশ জাইরু। আগের ম্যাচে হোলিচরণকে ডানদিকে খেলতে দেখেছিলাম।
পুরনো জায়গা ফিরে পেতেই ছন্দ ফিরে পেল হোলিচরণ। চাপে পড়ে ভুল করতে শুরু করল আফিগানস্তান। আর এতেই আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল ভারতীয়দের। আফগানিস্তান অবশ্য খেলার গতির বিরুদ্ধে এগিয়ে গিয়েছিল। প্রতি আক্রমণে উঠে এসে ফয়জল শায়েস্তা অর্ণব মণ্ডল ও অগাস্টিন ফার্নান্ডেজের মাঝখান দিয়ে দারুণভাবে বলটা রেখেছিল জুবের আমিরির উদ্দেশ্যে। দলকে এগিয়ে দিতে ভুল করেনি আমিরি। এই প্রথম আফগানদের একটা নিচু শট খেলতে দেখলাম। আর তাতেই গুরপ্রীত পরাস্ত।
২ মিনিটের বেশি অবশ্য লিড ধরে রাখতে পারেনি আফগানরা। জেজের গোলে সমতা ফেরে। বাঁদিক থেকে হোলিচরণ নার্জারির সেন্টার সুনীল ছেত্রি হেড করে। হাসেমি ও গোলকিপার আজিজির ভুল বোঝাবুঝিতে গোল করে যায় জেজে। আমি বলব, ভারতের এই গোলটা পড়ে পাওয়া। সমতা ফেরানোর পর আরও চাপ বাড়ায় ভারত। বেশ কয়েকটি সুযোগ পেলেও কাজে লাগাতে পারেনি।
নির্ধারিত সময় ১–১ গোলে শেষ হওয়ার পর অতিরিক্ত সময়ে আফগানদের আরও চেপে ধরে ভারত। অভিজ্ঞতার যে আলাদা মূল্য রয়েছে, দেখিয়ে দিল সুনীল ছেত্রি। অতিরিক্ত সময়ে তার গোল ভারতকে শুধু দুরন্ত জয়ই এনে দিল না, একইসঙ্গে গত সাফ কাপের মধুর প্রতিশোধ এলো। গুটিয়ে না থেকে ঝাঁপালে কী ফল হয়, হাতেনাতে ফল পাওয়া গেল।
৪ জানুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪ডটকম/এসএস/এসবি