বৃহস্পতিবার, ০৯ জুন, ২০১৬, ১২:১৩:২০

দ্বিস্তরের টেস্ট চালু হলে টাইগাররা যে সব সমস্যার সম্মুখীন হবেন

দ্বিস্তরের টেস্ট চালু হলে টাইগাররা যে সব সমস্যার সম্মুখীন হবেন

দেবব্রত মুখোপাধ্যায়: আগে কয়েক বার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে মিলিয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা। আবার আইসিসি সেই পুরানো প্রস্তাব—দ্বিস্তরের টেস্ট ক্রিকেট কাঠামো চালুর পথে হাঁটছে। কয়েক দিন আগেই আইসিসির প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন সরাসরি বলেছেন ২০১৯ সালেই বাস্তবায়ন করতে চান তারা এই পরিকল্পনা। এর দিন তিনেকের মাথায় অনিল কুম্বলের নেতৃত্বাধীন আইসিসির ক্রিকেট কমিটি টেস্ট কাঠামো সংস্কারে সর্বসম্মতিক্রমে মত দিয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও মনে করছে, এবার আর এই প্রস্তাবনা ঠেকানো সম্ভব হবে না।

আইসিসির প্রস্তাবনা অনুযায়ী বর্তমান টেস্ট র্যাংকিংয়ের শীর্ষ ৭টি দল থাকবে প্রথম স্তরে। আর দ্বিতীয় স্তরে থাকবে টেস্ট র্যাংকিংয়ের শেষ তিনটি দল এবং আইসিসি ইন্টার কন্টিনেন্টাল কাপের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ; মানে মোট ৫ দল। ৭ দল ও ৫ দলের দুই স্তরের প্রতিটি দল নিজেদের মধ্যে দুই বছর ধরে সিরিজ খেলবে। দুই বছর পর প্রথম স্তরের ৭ নম্বর দল দ্বিতীয় স্তরে নেমে যাবে এবং দ্বিতীয় স্তরের ১ নম্বর দল প্রথম স্তরে উন্নীত হবে; মানে, রেলিগেশন ও প্রমোশন ব্যবস্থা থাকছে।  বাংলাদেশ এখন আছে আইসিসি টেস্ট র্যাংকিংয়ে ৮ নম্বরে। ফলে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ের সাথে বাংলাদেশকেও খেলতে হবে দ্বিতীয় স্তরে। অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেল, টেস্টের এই দ্বিস্তরবিশিষ্ট কাঠামো শুধু বাংলাদেশের টেস্টকেও প্রভাবিত করবে না। কার্যত বাংলাদেশের ক্রিকেটই এখন নেতিবাচক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে যাবে।

n ওয়ানডে উন্নয়নে ধাক্কা

দৃশ্যত টেস্টের দ্বিস্তরের সাথে ওয়ানডের কোনো সম্পর্ক নেই। কাগজে-কলমে দ্বিতীয় স্তরের টেস্ট খেলুড়ে দেশ হওয়ার পরও বাংলাদেশ সব দেশের সাথেই ‘সমান’ ওয়ানডে খেলার সুযোগ পাবে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, ওয়ানডেতে এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা দল হয়ে উঠতে থাকা বাংলাদেশের সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলা সীমিত হয়ে যাবে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, তিন ফরম্যাটেই মূলত খেলা হয় দ্বিপাক্ষিক সফরের মাধ্যমে। বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্তরে নেমে গেলে শীর্ষ ৭ দলের কারো সাথে পরের দুই বছরে আর পূর্ণাঙ্গ দ্বিপাক্ষিক সফর বিনিময় করতে পারবে না। তার অর্থ বাংলাদেশে শীর্ষ কোনো দল শুধু ওয়ানডে সফর করতে আসার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। কারণ, দলগুলো নির্দিষ্ট কোনো একটি ফরম্যাটে কোথাও সফর করতে যাওয়া মানেই তাদের পূর্ণাঙ্গ একটি সফরের সময় নষ্ট।

 সে ক্ষেত্রে ওই দুই বছরে বাংলাদেশকে মূলত আইসিসি ইভেন্টে বড় দলগুলোর বিপক্ষে কয়েকটা ওয়ানডে এবং নিজের স্তরের দলগুলোর বিপক্ষে ওয়ানডে নিয়েই মূলত সন্তুষ্ট থাকতে হবে। যেহেতু নিজের স্তরের দলগুলোর ওয়ানডে রেটিংও অত্যন্ত কম; তাই ওয়ানডেতে উন্নয়ন তো দূরে থাক, বর্তমান র্যাংকিংও বাংলাদেশের ধরে রাখা অসম্ভব হবে।

n অর্থনৈতিক বিপর্যয়

ক্রিকেট বোর্ডের দৃষ্টিতে ভাবলে এটা হতে যাচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। যে কোনো ক্রিকেট বোর্ডের মতো, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও মূল আয়ের উত্সব টেলিভিশন স্বত্বসহ বড় বড় সিরিজ আয়োজন থেকে পাওয়া অর্থ। ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলোর বিপক্ষে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বন্ধ হয়ে গেলে আয়োজনের এসব আয় থাকবে না বললেই চলে।

এ ক্ষেত্রে আইসিসি অবশ্য ইতিমধ্যে একটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। নতুন প্রস্তাবনা অনুযায়ী, বোর্ডগুলো শুধু নিজদেশে সম্প্রচারের জন্যই হোমসিরিজগুলো বিক্রি করতে পারবে। প্রতিটি খেলা ওই দেশটির বাইরের দেশগুলোর টেলিভিশনে বিক্রি করবে আইসিসি নিজে। আর সেই টাকাটা একটা তহবিল করে সেটা দলগুলোর ভেতর বণ্টন করা হবে। এখন বিসিবি আইসিসির কাছ থেকে এমন একটি গ্যারান্টি চায় যে, ওই তহবিল থেকে তাদের সর্বশেষ বছরগুলোর আয়ের সমান অর্থ অন্তত যেনো বাংলাদেশকে দেওয়া হয়।

n মান ও মর্যাদা

দ্বিতীয় স্তরে খেলা সাকিব আল হাসান কিং একীভূত র্যাংকিংয়ে সেরা অলরাউন্ডারের জায়গা ধরে রাখতে পারবেন? আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৫-৬ উইকেট নেওয়ার প্রভাব কী মুস্তাফিজের টেস্ট র্যাংকিংয়ে পড়বে?

এগুলো প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। তেমনই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, আইসিসি সভায় বাংলাদেশের অধিকার বর্তমানের মতোই থাকবে কি না। একটা পূর্ণাঙ্গ টেস্ট খেলুড়ে দেশের মতামত আর সহযোগী দেশের মতামত এখন বোর্ড সভায় এক নয়। তাহলে তখন বাংলাদেশ ঠিক কোনো যুক্তিতে সভায় দ্বিতীয় স্তরে খেলতে থাকা সহযোগী দুটি দেশের চেয়ে বাড়তি মর্যাদা পাবে?

এই প্রশ্নগুলোর কোনো সুরাহা এখনও পর্যন্ত আইসিসি করতে পারেনি। তবে এমন একটা শঙ্কা আছে যে, বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা কাগজে-কলমে থাকলেও মান ও মর্যাদার দিক থেকে অবস্থানের কিছুটা অবনমন হবে। যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হবেন খেলোয়াড়রা।

n সফরসূচির অনিশ্চয়তা

‘বিগ থ্রি’ সংক্রান্ত সংস্কারের পর থেকেই আইসিসি ভবিষ্যত্ সফরসূচি বা এফটিপি থেকে সব কর্তৃত্ব তুলে নিয়েছে। এই অবস্থায় দ্বিস্তরের ক্রিকেট চালু হলে একটা অরাজকতা শুরুর সম্ভাবনা আছে। দলগুলো প্রত্যেকেই র্যাংকিং বাড়ানোর জন্য শুধু ওপরে থাকা দলের সাথে ম্যাচ খেলার জন্য আগ্রহ দেখাবে। ফলে নিচের দিকের দলগুলো খেলা থেকে বঞ্চিত হবে। যদিও আইসিসি বলছে, প্রতি স্তরের দলগুলোকে পরস্পরের বিপক্ষে দুই বছরের সার্কেলে কমপক্ষে একবার পরে তিন ম্যাচের সিরিজ খেলতে হবে। কিন্তু এফটিপিতে কর্তৃত্ব পুনর্বহাল না করে সেটা করতে আইসিসি কাউকে বাধ্য করতে পারবে না।

n এবং মরীচিকার স্বপ্ন

এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশের সামনে একটাই আশা আছে—প্রথম স্তরে উঠে এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা। সে আশাও মরীচিকার মতো হওয়ার কথা। কারণ, বাংলাদেশ যদি দ্বিতীয় স্তরে এক নম্বর দল হয়ে প্রথম স্তরে চলে যায়, তখন মূল কাজ হবে কমপক্ষে ছয় নম্বরে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ নেওয়া। না হয় সাত নম্বরেই থাকলে দুই বছর পর আবার নেমে যেতে হবে। আর প্রথম স্তরে গিয়েই দুই বছরের  অনভ্যস্ততার পর বড় দলগুলোর সাথে টেস্ট খেলে তাদের একটি দলকে টপকে ফেলাটা মরীচিকার মতো বলাটাও অন্যায় নয়।    

  বিসিবি যা বলছে

g স্পোর্টস রিপোর্টার

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন ক’দিন আগেই বলেছেন, তারা প্রস্তাবনার বিস্তারিত জেনে তবে মতামত দেবেন। গতকাল বাংলাদেশের সামনের চ্যালেঞ্জগুলোর কথা জিজ্ঞেস করতে সেটা স্বীকার করলেন বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী সুজন।

সুজন বললেন, এই সমস্যাগুলোর সমাধান পেলে তবেই তারা আইসিসিকে সিদ্ধান্ত জানাবেন, ‘ব্যাপারটা তো এখনও প্রস্তাবনা আকারে আছে। যদি অধিকাংশ সদস্য এই পরিবর্তনের পক্ষে থাকে, আমার তো চাইলেও ঠেকাতে পারবো না। তবে আমাদের কতোগুলো ব্যাপারে নিশ্চয়তা চাই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, আমাদের স্ট্যাটাস অক্ষুণ্ন রাখা, বাকী ফরম্যাটগুলোতে খেলার সমান সুযোগ এবং এফটিপির ব্যাপারে আইসিসির হস্তক্ষেপের নিশ্চয়তা পেলে তবেই আমরা সিদ্ধান্ত দেবো।’-ইত্তেফাক
৯ জুন,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে