নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশের রাজনীতি অঙ্গনে সম্প্রতি সবচেয়ে বিয়োগাত্মক ঘটনাটি হলো সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যু। লক্ষ-কোটি ভক্ত-সমর্থকদের কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন বাংলাদেশের রাজনীতির এই প্রবাদ পুরুষ।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ দলের জন্য কি বা করেননি তিনি। দলের দুঃসময় দলের সাথেই ছিলেন তিনি। দলকে সবসময় তিনি সাহস যুগিয়েছেন সামনে থেকেই। তার মৃত্যুতে হাহাকার শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে, জনসাধারণের হৃদয়েও পড়েছে শোকের ছায়া।
এদিকে পিতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুর পর ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছেন তার কন্যা রীমা ইসলাম। তাকে নিয়ে বিভিন্নজন আবেগঘন স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। কেউ কেউ তার রাজনীতিবিমুখতা, প্রচারবিমুখতার কথা উল্লেখ করেছেন। কেউ আবার উল্লেখ করেছেন, তার বাবা তার জন্য কোনো অর্থ সম্পদ রেখে যাননি।
পিতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কফিনের পাশে বিমর্ষ বদনে দাঁড়িয়ে থাকা কন্যা রীমা ইসলামের একটি ছবি ফেসবুকে বিভিন্নজনের ওয়ালে দেখা যায়। ঐ ছবিটিতে দেখা যায়, রীমা ইসলাম ও অন্যান্যরা গাড়ি থেকে পিতার কফিনটি নামাচ্ছেন। তিনি অশ্রু ভারাকান্ত নয়নে তাকিয়ে আছেন।
মাত্র এক বছরের ব্যবধানে হারিয়েছেন মা-বাবা দু’জনকে। হয়েছেন বাকরুদ্ধ, স্বজন হারানোর ব্যথায় কাতর। আপনজন হারিয়ে চারপাশে যেন কেবলই শূন্যতা। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সদ্যপ্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের একমাত্র মেয়ে সৈয়দা রীমা ইসলাম কীভাবে সইবেন এ শোক- এ প্রশ্ন স্বজনসহ সবার।
তবে লন্ডনপ্রবাসী রীমা দেখেছেন তার বাবার প্রতি দেশের মানুষের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এ থেকেই ভাবছেন দেশে ফিরে আসার কথা। মনকে শক্ত করে কাটিয়ে উঠতে চান শোক। লন্ডনের কর্মস্থলে কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে শিগগিরই তিনি দেশে ফিরবেন বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।
২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর মমতাময়ী মা শীলা ইসলামকে হারান রীমা ইসলাম। জীবনের প্রথম সেই ধাক্কাটি সামলে উঠেছিলেন বাবা সৈয়দ আশরাফের স্নেহের স্পর্শে। কিন্তু বছর পেরোতেই শেষ আশ্রয় বাবাকেও হারালেন তিনি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দ আশরাফ ৩ জানুয়ারি ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে জন্ম এবং সেখানেই বেড়ে ওঠেন রীমা। সেখানেই এমবিএ সম্পন্ন করেছেন। লেখাপড়া শেষ করে লন্ডনেই ব্যাংকে চাকরি করছেন। হংকং-সাংহাই ব্যাংক করপোরেশনে (এইচএসবিসি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। গত বছরের ৩ জুলাই সৈয়দ আশরাফ গুরুতর অসুস্থ হয়ে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি হন। অসুস্থ বাবার শুশ্রূষার জন্য কর্মস্থল ছেড়ে ব্যাংককে ছুটে আসেন রীমা। আশা ছিল উন্নত চিকিৎসায় অচিরেই পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে আবার তার বাবা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগের মতোই ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে অনন্তের পথে পাড়ি জমান সৈয়দ আশরাফ।
সৈয়দ আশরাফের পরিবারের সদস্যরা জানান, রীমা জানতেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার বাবা একজন জনপ্রিয় মানুষ। কিন্তু এতটা জনপ্রিয় ছিলেন, তা কখনও ভাবেননি। ব্যাংকক থেকে বাবার মরদেহ নিয়ে ঢাকায় অবতরণের পর শোকার্ত হাজারো নেতাকর্মী আর সাধারণ মানুষের আহাজারি দেখে রীমার চোখে জমেছিল শোক-বিহ্বল গর্বের অশ্রুবিন্দু। জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় প্রথম জানাজায় হাজার হাজার মানুষের ঢল, কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানে দ্বিতীয় জানাজায় তিন লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি এবং ময়মনসিংহ শহরে তৃতীয় জানাজায় লাখো মানুষের অংশগ্রহণ দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি রীমা। এমন একজন বাবার সন্তান হতে পেরে যুগপৎ গৌরব ও অহঙ্কারও অনুভব করেন।
কর্তব্যের টানে গত মঙ্গলবার বাবার শেষ চিকিৎসাস্থল ব্যাংকক গেছেন তিনি। সেখানে হাসপাতালের বকেয়া দেনা ও বকেয়া বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করে ফিরে যাবেন নিজের কর্মস্থল লন্ডন শহরে।
রীমা ইসলামের চাচা (সৈয়দ আশরাফের চাচাতো ভাই) সৈয়দ তারেকুল ইসলাম ভিক্টর জানান, বাংলাদেশের আপামর মানুষের ভালোবাসা দেখে এবং পিতার প্রতি জনগণের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা দেখে রীমা অচিরেই দেশে ফিরে আসার চিন্তা করছেন। লন্ডনে চাকরি ছাড়ার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে সহসাই তার ফিরে আসার কথা রয়েছে।
বাবার মতোই মৃদুভাষী, শান্ত ও ধৈর্যশীল তরুণী রীমা। শোলাকিয়া মাঠে বাবার জানাজার সময় পাশেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ছিলেন তিনি। এ সময় তাকে দেখে আগামীর সম্ভাবনার ইঙ্গিত খুঁজে পান উপস্থিত মানুষ।
কিশোরগঞ্জের রাজনীতিতে রীমা তার বাবার উত্তরসূরি হতে পারেন- এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও স্ট্যাটাস দিয়েছেন অনেকে। তবে বেশিরভাগ সমর্থকেরাই চাচ্ছেন রীমা ইসলামকে যেনো উপ-নির্বাচনে এমপি প্রার্থী করা হয়।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন।
আশরাফুল ইসলাম ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন। ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নেন তিনি।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্র ধরে তিনি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭০ বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তিনি যুক্তরাজ্য চলে যান। প্রবাস জীবনে তিনি যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আশরাফুল ইসলাম ১৯৯৬ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় তিনি নির্বাচিত হন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালের ১৬ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি এক কন্যার জনক।