রিপন আনসারী: ছবিটি গোয়েদা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও তার একমাত্র শিশুপুত্র সামির। ঘরের দেয়ালে টাঙ্গানো এই ছবিটি আজ শুধুই স্মৃতি। বাবার আদর, ভালোবাসা আর কখনোই পাবে না ৫ বছরের ছোট শিশু সামি। ছুটি পেয়ে বাড়ি এসে আর কোনোদিন বুকে তুলে নিয়ে গালে চুমু খাবে না। অবুঝ সামির সমস্ত আদর ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে সন্ত্রাসীরা। শুধু সামিই নয় নিহত রবিউলের স্ত্রীর গর্ভের অনাগত সন্তানটিও এ পৃথিবীর আলো দেখার আগেই বাবাকে হারালো। গতকাল রোববার সকালে নিহত পুলিশ অফিসার রবিউলের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, কান্নার রোল। কারো চোখ কান্নায় ভিজে যাচ্ছে আবার কারো চোখের পানি কেঁদে কেঁদে শুকিয়ে গেছে। রবিউলের ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী উম্মে সালমা স্বামীর শোকে কাতর হয়ে বিছানায় মিশে গেছেন।
অনেকটা বাকরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন তিনি। কারো সঙ্গে কোনো কথাই বলছে না। শুধু চোখ গড়িয়ে ছল ছল করে পানি ঝরছে। আর শিশু সামিকে দেখা গেলো বাড়ির ভেতরে খেলার সাথীদের সঙ্গে বল নিয়ে খেলতে। বাবা নেই সে ধারণাও তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ঘরের খাটে শুয়ে আছেন রবিউলের মা করিমুন নেসা। পুত্র শোকে দুদিন ধরেই শুধু কাঁদছেন। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছে না। আর ভাইকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছে রবিউলের একমাত্র ছোট ভাই শামসুজ্জামান। ভাতিজাকে বুকে জড়িয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে। শামসুজ্জামান বলেন, আমাদের পরিবারের সমস্ত সুখ-শান্তি সন্ত্রাসীরা কেড়ে নিয়েছে। আমরা সবাই আজ ভাইকে হারিয়ে এতিম হয়ে গেছি। ৫ বছরের ভাতিজা এখনও বুঝতে পারছে না তার বাবা নেই। আর এক মাস পরেই অনাগত আরেক সন্তান এ পৃথিবীতে আসছে। ওরা যে আর কোনো দিন বাবাকে দেখতে পাবে না। এ কথা বলতেই কেঁদে উঠেন।
শামসুজ্জামান আরো বলেন, আমার ভাই শুধুই একজন দক্ষ পুলিশ অফিসার ছিলেন না। ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী। নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিবন্ধীদের জন্য নজরুল ইসলাম বিদ্যাসিঁড়ি নামের একটি প্রতিবন্ধী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামে। এছাড়া, নজরুল বিদ্যাসিঁড়ি নামে একটি কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করেন। কয়েকদিন আগে বাড়িতে এসে প্রতিবন্ধী ও এলাকার গরিব-দুঃখী মানুষজনকে ঈদের কাপড় চোপড় দিয়ে সকলের সঙ্গে ইফতারও করেছেন। ইফতার শেষে রাতেই ঢাকা চলে যাওয়ার আগে গ্রামের ওই সব মানুষগুলোকে কথা দিয়েছিলেন আবার তিনি আসবেন। ঈদও করবেন এলাকার মানুষের সঙ্গে। কিন্তু আমার ভাইয়ের সেই আশা আর পূরণ হলো না। তার আগেই গ্রামে এলেন লাশ হয়ে। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত সাড়ে ৮টা। একটি অ্যাম্বুলেন্সে এসি রবিউলের লাশ আনা হয় গ্রামের বাড়ি কাটিগ্রামে। তার আগে থেকেই বাড়িভর্তি মানুষ অপেক্ষায় থাকেন কখন লাশ আসবে। লাশের কফিন বাড়ির ভেতর নেয়া মাত্রই স্বজন ও প্রতিবেশীদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠে সেখানকার পরিবেশ। রবিউলের নিথর দেহটি নামানোর পর লাশকে ঘিরে স্বজনদের আহাজারি আরো বেড়ে যায়।
একে একে স্বজন ও এলাকার মানুষ রবিউলের মুখখানি দেখতে থাকেন। নিহত রবিউলের শিশুপুত্র সানিকে কোলে নিয়ে চাচা শামসুজ্জামান কফিনের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আসেন স্বামীকে শেষ বারের মতো দেখতে। এ সময় তার কান্না আর আহাজারি দেখে উপস্থিত কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। সর্বশেষ স্বামীর মুখখানি দেখার পর লাশের পায়ের কাছে চলে যান স্ত্রী উম্মে সালমা। এসময় মৃত স্বামীর পায়ে কদমবুসি করে শেষ বিদায় জানান। রাত সাড়ে দশটার দিকে কাটিগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পুলিশের গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এসময় জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস, পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমানসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে কাটিগ্রাম কবরস্থানে দাফনের মধ্য দিয়ে শেষ বিদায় জানানো হয় গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ রবিউল ইসলামকে।-এমজমিন
৪ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/সবুজ/এসএ