আরিফ হোসেন, শ্রীনগর (মুন্সীগঞ্জ) থেকে : সৌদি আরবে অলিউল্লাহকে ফোন করলে তা ধরতো এক মহিলা। বারবার এমনটাই ঘটেছে। ও আসলে আমাকে না জানিয়ে সেখানে আরেকটি বিয়ে করেছে। তাই তাকে মেরে দিয়েছি। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে স্বামী অলিউল্লাহকে হত্যার পর পুলিশের কাছে এভাবেই হত্যার কারণ বর্ণনা করেছে মাজেদা বেগম।
মঙ্গলবার হত্যার পর নিজেই শ্রীনগর থানায় হাজির হয়ে জানায়, স্বামীকে হত্যা করে ঘরে তালা দিয়ে এসেছি। আমাকে গ্রেপ্তার করুন। অপরদিকে অলিউল্লাহর পরিবারের দাবি দীর্ঘ ১৮ বছরের প্রবাস জীবনের অর্জিত অর্থে স্ত্রী মাজেদা বেগমের নামে অর্ধকোটি টাকার জমি কেনা হয়েছিল। এ সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্যই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে পুত্রকে হত্যার খবর শুনে অলিউল্লাহর পিতা ইদ্রিস মোল্লা (৯৫) একই দিন রাত ৯টার দিকে হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনায় উপজেলার পুঁটিমারা এলাকায় শোক নেমে এসেছে।
সূত্রমতে, তিন মাস আগে অলিউল্লাহ ছুটিতে দেশে আসেন। আসার পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহ লেগেই থাকতো। ছুটি শেষ হয়ে গেলে অলিউল্লাহর সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল। ওই সময় ফ্লাইটের ছয় ঘণ্টা আগে ভিসাসহ পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে মাজেদা তার স্বামীর বিদেশ যাওয়া ঠেকিয়ে দেয়। পরে এক মাসের মধ্যে অলিউল্লাহ নতুন পাসপোর্ট করে কোম্পানির কাছ থেকে ভিসা সংগ্রহ করে। এ নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হতো। মঙ্গলবার রাতে সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে অলিউল্লাহর সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা মাজেদা বেগম কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। রোববার মাজেদা বেগম তার স্বামী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে উপজেলার হাসাড়া গ্রামে বাবার বাড়িতে বেড়াতে যায়।
বাবার বাড়িতে মাজেদা বেগম তার স্বামীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। সোমবার বিকালে স্বামী-স্ত্রী ও দুই ছেলে ষোলঘর ইউনিয়নের পুঁটিমারা গ্রামের নিজেদের বাড়িতে চলে যায়। বাড়িতে গিয়ে সন্ধ্যার পর মাজেদা ভাত রান্না করতে যায়। এর ফাঁকে স্বামী-সন্তানের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুটি ছুরি এনে তোষকের নিচে রেখে দেয়। ভাত রান্না হলে ছেলে ওমর (৭) ও মারুফ (৫)কে তা খাওয়ায়। পরে সাতটার দিকে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে ভাত খায়। সাড়ে সাতটার দিকে গরম দুধের সাথে ৭টি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ওলিউল্লাহকে খাওয়ানোর বিশ মিনিটের মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ে। অন্য রুমে ছেলেদের ঘুম পাড়ায়।
সাড়ে ৮টার দিকে ওড়না দিয়ে অলিউল্লাহর হাত-বেঁধে ফেলে। পরে আরেকটি ওড়না গলায় পেঁচিয়ে শ্বাষরোধ করে হত্যা করে। ছেলেরা জেগে লাশ দেখে ফেলতে পারে এ আশঙ্কায় তাদের রুমের লাইট নষ্ট করে দেয়। পরে রাত দশটার দিকে একাই লাশ খাট থেকে নামিয়ে তিন রুম পার করে পাকা বারান্দার একটি স্টোর রুমে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখে। সকালে উঠোন ঝাড় দিয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় মাজেদা। অন্যরা জিজ্ঞেস করলে জানায় স্বামীর বিমান টিকিটের জন্য টাকা জোগাড় করতে যাচ্ছে। পরে সন্তানদের বাবার বাড়ি রেখে থানায় এসে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পুলিশ অলিউল্লাহর বসত ঘরের তোষকের নিচ থেকে দুটি ধারালো ছুরি উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় উলিউল্লাহর বড় ভাই মো. আহসান উল্লাহ বাদী হয়ে মাজেদা বেগম, তার বাবা নুরু খলিফা ও দুই ভাই হাবিব এবং মাসুমকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছে।
অলিউল্লাহর বড় ভাই আহসান উল্লাহ জানান, পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলার পর হাসাড়া ইউপি চেয়ারম্যান সোলায়মানের বাড়িতে সালিশ বসে। সেখানে অলিউল্লাহ জানায়, সৌদি আরবের কোম্পানিতে তার প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা জমা রয়েছে। এ টাকা তোলার জন্যই তার সৌদি আরব যাওয়ার প্রয়োজন। সবকিছু শুনে অলিউল্লাহকে তিন মাসের জন্য বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেয় সালিশদাররা। অলিউল্লাহর বিদেশে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না। যদি সে বিদেশে বিয়ে করতো তাহলে মাজেদার নামে সম্পত্তি রাখতো না। এবার দেশে আসার পর দেড় মাস আগেও অলিউল্লাহ তার স্ত্রী মাজেদার নামে নতুন করে জমি রেখেছে। ১৮ বছরের প্রবাস জীবনের কষ্টার্জিত সব অর্থ ও সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্যই মাজেদা তার বাপ-ভাইয়ের সহায়তায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
শ্রীনগর থানার অফিসার ইনচার্জ সাহিদুর রহমান জানান, ময়নাতদন্তের পর অলিউল্লাহর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মাজেদা বেগমকে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরো কেউ জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এমজমিন
৯ফেব্রুয়ারি,২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি