সাব্বিরুল ইসলাম সাবু, মানিকগঞ্জ: 'আমারে মাইরেন না, আমি আর কোন দিন মাছ ধরুম না। মাপ কইরা দেন আমারে, মাপ কইরা দেন'। পুকরে মাছ ধরার অপরাধে নির্যাতনের শিকার শিশু সামি হাসপাতালের বিছানায় ঘুমের ঘোরে এভাবেই আর্তনাদ করে উঠছে। অজানা আশঙ্কায় সামির পরিবার রয়েছে চরম দুঃচিন্তায়।
শিশু নির্যাতনের এই ঘটনাটি ঘটেছে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার উলাইল ইউনিয়নের শিবরামপুর গ্রামে। ওই গ্রামের তুহিনুজ্জামানের ছেলে মোহাম্মদ সামি (১০) স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।
সামির মা খুরশিদা আক্তার জানান, তাদের পাশের বাড়ি ১নং ওয়ার্ডের সদস্য আজহারুল ইসলাম লালনের (লালন মেম্বার)। গ্রামে তাদের একটি পুকুরে মাছের চাষ করেন। গত বুধবার সকাল সাতটার দিকে ওই পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে যায় সামি ও তার এক বন্ধু। পুকুরে বড়শি ফেলতেই লাঠি নিয়ে লালন মেম্বার, তার ভাই বাচ্চু ও বোন জামাই তাড়া করে সামি ও তার বন্ধুকে। বন্ধু পালিয়ে বাঁচলেও ধরা পড়ে সামি।
হাত, পা বেঁধে পানিতে চুবিয়ে প্রচণ্ড মারধর করা হয় সামিকে। এরপর কালভার্টের পাইপে ঢুকিয়ে রাখা হয়। খবর পেয়ে সামির মা, বাবা ছুটে গিয়ে ছেলেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। কিন্তু হাতে লাঠি দেখিয়ে তাদের ভীড়তে দেয়নি লালনরা।
লালন চিৎকার করে বলেন, হাড় মাংস আলাদা করে তবে তোদের ছেলেকে ছাড়া হবে। এ সময় সামিও বারবার আর মাছ ধরবেনা বলে কান্নাকাটি করলেও মন গলেনি তাদের। এভাবে প্রায় একঘণ্টা নির্যাতন চালানো হয় সামির ওপর। এক পর্যায়ে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় সামিকে কোন রকমে উদ্ধার করে শিবালয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। কিন্তু অবস্থার অবণতি হলে সেখান থেকে সামিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় মানিকগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে।
খুরশিদা আক্তার জানান, সামির সারা শরীরের মারধরের চিহ্ন রয়েছে। ঘুমের ইনজেকশন দেয়ার পরও রাতে ঘুমাতে পারে নাই। আধো ঘুমে চেঁচিয়ে উঠেছে। বারে বারে বলছে আর মাছ ধরবেনা। মাপ করে দিতে বলছে। খুরশিদা বলেন, আমার ছেলে যদি দোষ করেই থাকে তা শুধরাতে আমাদের সুযোগ দেয়া হয়নি। একটা শিশুকে কীভাবে এমন নির্যাতন করা হলো তার বিচার চাই।
কর্তব্যরত নার্স জানান, শারীরিকের চাইতে মানসিকভাবে সামি বেশি বিপর্যস্থ। প্রচণ্ড ভয় পাওয়ার কারণে সে ঘুমাতে পারছেনা। প্রলাপ বকছে। মাঝে মাঝে খিচুনি হচ্ছে। তবে তাকে বিশেষ কেয়ারে রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান।
সামির বাবা তুহিনুজ্জামান তপু বলেন, ছেলের গুরুতর অবস্থার কারণে থানা পুলিশ করা সম্ভব হয়নি। তবে কোর্টে মামলা করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সাপ্তাহিক ছুটির পর আদালত খুললেই মামলা করা হবে।
তিনি আরও জানান, লালন মেম্বার লোক দিয়ে মামলা তুলে নেয়ার জন্য তাকে হুমকি দিচ্ছে। আজ শুক্রবার একটা মোবাইল ফোন থেকে লালনের পক্ষ হয়ে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে মীমাংসার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
এ ব্যাপারে লালন মেম্বারের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভীন্ন কথা বলেন। তিনি জানান, ওই দিন সামি একটি মোবাইলফোন দিয়ে তার কলেজ পড়ুয়া এক ভাতিজির আপত্তিকর ছবি তোলে। বিষয়টি জানার পর তারা সামিকে খোঁজাখুজি করে। এবং সেদিন তাকে ধরে শাসন করার জন্য দু একটা চর থাপ্পর মারা হয়। হাত বেঁধে মারধর, পানিতে চুবানো কিংবা কালভার্টের পাইপে ঢুকিয়ে নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেন তিনি।
পরে বিষয়টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মান্নানকে জানানো হয়। লালন মেম্বার দাবি করেন যে মোবাইল দিয়ে সামি ছবি তুলেছিল তা আবদুল মান্নানের কাছে গচ্ছিত আছে।
আব্দুল মান্নানের সাথে যোগাযোগ করা হলে সামির হাত বেঁধে রাখার বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে তিনি জানান, তার সামনে সামিকে দু একট চর থাপ্পর মারা হয়েছে। তার সামনে আর কোন মারধর করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, মোবাইল ফোনে কোন ছবি পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনটি তার কাছেই গচ্ছিত থাকার কথা বলে জানান। সম্ভবত ফোনটি নষ্ট।-কালের কণ্ঠ
০৭ জুলাই ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এপি/ডিসি