দক্ষিণ-পশ্চিমে হযরত শাহ্ মিসকিন (রা.)- এর পূণ্যভূমি সংলগ্ন এ গ্রামে এখনো শুরু হয়নি নগর সভ্যতার ধাপাধাপি, নেই যানবাহনের ভেঁপু। ফুল ফলে রস তীর্থও নয় এ গ্রাম। তবে ছিমছাম নৈসর্গিক পরিবেশ
নিঃসন্দেহে দৃষ্টিনন্দন। গ্রামের উত্তর ও পূর্ব অংশের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীলা নদী ও পশ্চিম-উত্তর অংশে বৃহৎ ছত্রাইল বিলের জলরাশির কলকল শব্দ হতদরিদ্র মানুষের মনকুঞ্জে দেয় দোলা। ভৌগোলিক দিক থেকে নিম্নাঞ্চল হওয়ার কারণে গ্রামের মানুষজন প্রায় প্রতি বছর বন্যায় ফসলহানিসহ নানা সমস্যায় পতিত হয়।
গুটিকয়েক পরিবার ছাড়া এ গ্রামের প্রায় সবাই ছিল হতদরিদ্র, দিনমজুর, মৎস্য শিকারি, প্রান্তিক ও বর্গাচাষি।
বাংলার চিরায়ত কার্তিক-চৈত্রের অভাবের ভয়াবহতার চিত্র ছিল এদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আবার কেউ কেউ নদী, খাল-বিলে মাছ শিকার করে সংসার চালাত। স্বভাবতই গ্রামের অধিকাংশ লোক একসময় ছিল হতদরিদ্র, দিনমজুর। আর্থ- সামাজিক অবস্থায় পিছিয়ে থাকা বলদী গ্রামের পুরো ছবি এখন হাতপাখার বদৌলতে বদলে গেছে। যে গ্রামের শিশুদের অদৃষ্টে ছিল মজুরি, তারা এখন লেখাপড়া করছে। বুঝতে শেখার আগেই
পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে হাতপাখা তৈরির কাজে লেগে যায়। গড়ে তোলে আগামীর একেকটি স্বপ্ন। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার অভাবগ্রস্ত এ মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে এখন সোনালি স্বপ্নে বিভোর তাদের যাপিত জীবন। কারণ তাদের হাতে ধরা দিয়েছে আয়ের এক উৎসমূল। বলদী গ্রামে এসে কথা
হয় বর্তমানে স্বাবলম্বী কয়েকজন পাখা নির্মাণকারী ও বিক্রেতার সঙ্গে। তারা একে একে বর্ণনা করে তাদের সুদিন আসার সংক্ষিপ্ত কাহিনী। জামেনা খাতুন নামে মধ্য বয়সী এক মহিলা স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে
নিজ বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করতেন। স্বল্প দাম ও মানের কাপড় দিয়ে শিশুদের পোশাক ও মহিলাদের ব্লাউজ তৈরি করে বিক্রি করতেন পাড়ার লোকজনের কাছে।
যা আয় হতো তা দিয়েই চলত তার সংসার। একযুগ আগের কথা। এক সময় শুরু করলেন কাপড়ে নক্শা করে বাঁশ দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ। আপন পরিকল্পনায় জামেনা খাতুনের আয়ের পথ সুগম হলো। গ্রামের
মহিলা ভিক্ষুকদের হাত দিয়ে পর্যায়ক্রমে তার বিপণন শুরু করলো গ্রাম থেকে গ্রামে।
জামেনা খাতুনের ক্রমবর্ধনশীল এ শিল্পের প্রসার দেখে এলাকার উৎসাহী নারী-পুরুষ অনেকেই তার কাছ থেকে হাতেকলমে শিক্ষা নিয়ে শুরু করেন পাখা তৈরির কাজ। পাখা প্রস্তুতকারক নারী ও শিশু শ্রমিকদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট শ্রমের বিনিময়ে কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। একজন পাখা শ্রমিক দৈনিক ১২-১৫টি পাখা তৈরি
করতে পারেন। এখানে তৈরি হয় তিন ধরনের পাখা। উন্নত পাখার মূল জমিনে নানা রঙের সুতা দিয়ে নকশি আঁকা থাকে। নকশির পাশে মিহি সুতায় গাঁথা থাকে গ্রামীণ শ্লোক, ছড়া ও ভালোবাসার ছন্দ।
দৃষ্টিনন্দন এ পাখাগুলোর উৎপাদন খরচ ১৫/২০ টাকা। মাঝারি ধরনের পাখায় নকশি বা কারুকাজ থাকে কম এবং এর উৎপাদন খরচ ১০/১২ টাকা। নকশি বা ঝালরবিহীন সাধারণ পাখা চলে বেশি। মাত্র ৫ টাকা
এর উৎপাদন খরচ। পাখা তৈরির পর শ' হিসেবে এই পেশায় নিয়োজিত পাইকার ও বিক্রেতারা ক্রয় করেন। প্রতি শ'তে লাভ হয় ৪শ' টাকার বেশি।
২২ আগস্ট ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস