নারায়ণগঞ্জ থেকে : একাই হাঁটছেন আইভী। কে নামলো আর কে নামলো না, তা নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই তার। কখনো নিজ বাসভবনে আগত সমর্থকদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন, আবার কখনো বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ভোটারদেরে সঙ্গে দেখা করছেন। এভাবেই চলছে তার প্রচারণা।
গণভবনে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং সর্বশেষ শুক্রবার রাতে নারায়ণগঞ্জে এসে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পাঁচ নেতার ঐক্য প্রচেষ্টা আশার সঞ্চার করেনি মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে। ফলে গতকালও আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর গণসংযোগে দেখা যায়নি মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের। এমনকি ওয়ার্ড কমিটির নেতারাও গড়হাজির।
তাছাড়া এখন পর্যন্ত মহানগর আওয়ামী লীগ ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে কোনো মিটিংও করেনি। দেয়নি নেতাকর্মীদের কোনো দিকনির্দেশনা। তবে প্রতীক পাওয়ার পর প্রচারণার চিত্র পাল্টে যাবে। মাঠে নামবে দলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা- এমনটাই বলছেন আইভীর ঘনিষ্ঠজনরা। অন্যদিকে শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, শামীম ওসমান ও আইভীর মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, ভোটের আগে সেই দূরত্ব না কমালে নির্বাচনে কিছুটা হলেও এর প্রভাব পড়বে।
নানা নাটকীয়তার পর ১৮ই নভেম্বর দলের মনোনয়ন বোর্ড দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে নাসিক নির্বাচনে আইভীকে দলের মনোনীত প্রার্থী ঘোষণা করে। এতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয় শামীম ওসমান শিবির। পরে ২২শে নভেম্বর গণভবনে ডেকে নেয়া হয় নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতাদের। সেখানে উভয়পক্ষের বক্তব্য শোনার পর সকল ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে দলের প্রার্থী আইভীর পক্ষের কাজ করার জন্য নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা।
তখন সবাইকে মিলমিশ করে দিয়ে একসঙ্গে সেলফি (ছবি) তোলা হয়। কিন্তু ২৪শে নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমার সময় শামীম ওসমান শিবিরের কোনো নেতাকে আইভীর সঙ্গে দেখা যায়নি। এ নিয়ে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে শঙ্কা সৃষ্টি হয়। আইভীর পক্ষ থেকে বলা হয় তারা আসেনি। আর শামীম ওসমানের পক্ষ থেকে বলা হয় তারা তৈরি ছিল কিন্তু তাদের ডাকা হয়নি।
এরমধ্যে ২৭শে নভেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে নাসিক নির্বাচন নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কৌশল নির্ধারণী এক বৈঠকে ‘ওসমান পরিবারের সদস্যরা ছাড়া শামীম ওসমানের লোকেরাও সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে কাজ করবেন বলে মন্তব্য করেন আইভী।
ওদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে ফাটল বন্ধ করতে নারায়ণগঞ্জে ছুটে আসেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ৫ নেতা। শুক্রবার তারা দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। ঐক্যবদ্ধভাবে আইভীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দিয়ে নারায়ণগঞ্জ ত্যাগ করেন। কিন্তু সেই আগের অবস্থানে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতারা। নামেননি আইভীর পক্ষে। প্রতীক বরাদ্দের পরের চিত্রের অপেক্ষায় নগরবাসী।
এদিকে ২২শে নভেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের নেতাদের গুলশানে ডেকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন। পরদিন ২৩শে নভেম্বর দলের প্রার্থী ঘোষণা করেন সাখাওয়াত হোসেন খানকে। খালেদা জিয়ার নির্দেশনার প্রতিফলন ঘটে ২৪শে নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময়।
ওইদিন জেলা, নগর, উপজেলা বিএনপির শীর্ষ নেতা ও নারায়ণগঞ্জের সাবেক তিন এমপি উপস্থিত ছিলেন। সর্বশেষ শুক্রবার রাতে বিএনপির নগর কমিটি বর্ধিত সভা করে দলীয় প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের পক্ষে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে দলীয় প্রচারণায় এগিয়ে গেছেন সাখাওয়াত হোসেন।
আরেকবার সুযোগ চান আইভী: শনিবার সকালে নাসিকের সিদ্ধিরগঞ্জের ১ ও ২নং ওয়ার্ডে গণসংযোগ করেন আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। এ সময় তিনি দলীয় নেতাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করে মতবিনিময় করেন। সকাল ১০টায় সিদ্ধিরগঞ্জের ১নং ওয়ার্ডে রওশন মিয়ার বাড়ির মোড়ে যাওয়ার পথে ভাঙা রাস্তার চিত্র দেখিয়ে মেরামতের দাবি জানান এলাকাবাসী।
এ সময় সেলিনা হায়াৎ আইভী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, পুনরায় নির্বাচিত হলে এই রাস্তাটি মেরামত করে দিবো। সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জের ১নং ওয়ার্ডে কাজ কম হয়েছে। তবে আগামীতে নির্বাচিত হলে ১নং ওয়ার্ড থেকেই কাজ শুরু হবে। এ ওয়ার্ডের বিভিন্ন রাস্তা টেন্ডার হয়ে আছে। নির্বাচনের জন্য কাজ শুরু করতে পারে নাই। আপনাদের এ কষ্টের জন্য আমি দুঃখিত।’
আইভী বলেন, নির্বাচনে অর্ধেক নারী ভোটার। তারা অবশ্যই আমাকে ভোট দেবেন। কারণ, আমি অতীতে নারীদের উন্নয়নে অনেক কাজ করেছি। এ কাজ যদি অব্যাহত রাখতে হয় তাহলে আমি আরেকবার তাদের কাছে সুযোগ চাইছি।
এর আগে সকাল ৯টায় মিজিমিজি টিসি রোড এলাকায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন আইভী। পরে মজিবুর রহমান আইভীকে আশ্বাস দেন নৌকার পক্ষেই কাজ করবেন তারা। এরপর বেলা পৌনে ১২টায় ২নং ওয়ার্ডে মিজমিজি পশ্চিমপাড়া এলাকায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন মিয়ার বাড়িতে গিয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। ওই সময় ইয়াছিন মিয়া ফুলের নৌকা দিয়ে আইভীকে স্বাগত জানান এবং নৌকার পক্ষে কাজ করার অঙ্গীকার করেন।
এদিকে, গতকাল নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন সাখাওয়াত হোসেন খান। তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, এ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। তাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নগরীতে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তিনিও দাবি করেন, নির্বাচনে যে অর্ধেক ভোটার নারী রয়েছে তাদের ভোট তিনিই পাবেন। কারণ, তিনি অতীতে নারীদের অধিকার রক্ষায় অনেক কাজ করেছেন।
পরে তিনি মহিলা দল ও ওলামা দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই সময়ে সকল ভেদাভেদ ভুলে ধানের শীষের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার আহবান রাখেন। এর আগে তিনি শহরের বন্দর সেন্ট্রাল খেয়াঘাট এলাকায় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে সাখাওয়াত শহরের ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকায় জেলা বিএনপির কার্যালয়ে মহানগর ওলামা দলের সঙ্গে বৈঠক হয়।
এতে ওলামা দল নেতা শিবলি আহাম্মেদ, শহর বিএনপির উপদেষ্টা জামালউদ্দিন কালু, সাখাওয়াত হোসেন, জাকির হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ওই সভার পর সাখাওয়াত একই কার্যালয়ে বৈঠক করেন জেলা ও মহানগর মহিলা দলের সঙ্গে। সেখানে জেলা মহিলা দলের সভানেত্রী নুরুন্নাহার বেগম, মহানগরের সভাপতি রাশিদা জামাল, মহিলা দল নেত্রী রহিমা শরীফ মায়া, সাজেদা খাতুন মিতা, রেহেনা বেগম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সাখাওয়াত অভিযোগ করেন, শুক্রবার আইভী ও তার লোকজন মাইকসহ গাড়ি বহর নিয়ে নৌকা মার্কার বিশাল মিছিল করেছেন। আইভীর মতো ব্যক্তিত্বের দ্বারা গায়ের জোরে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনে নারায়ণগঞ্জবাসী হতাশাগ্রস্ত। অবাধ ও নিরপক্ষ নির্বচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে নির্বাচন কমিশনারের কাছে আচরণবিধি লঙ্ঘনে অচিরেই আইভীর শাস্তি দাবি করেন তিনি। এমজমিন
৪ ডিসেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি