পাভেল হায়দার চৌধুরী: আগামী ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন। স্থানীয় সরকার পর্যায়ের এ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ মনোযোগ কাড়ছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকা বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটিতে অংশ নেওয়ায়। আর দলীয় প্রতীকে এটিই প্রথম কোনও সিটি করপোরেশন নির্বাচন হওয়ায় আগামী দিনের রাজনীতিতেও এর একটা প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা দেখছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
নাসিকের গত নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে বিএনপি তাদের প্রার্থী প্রত্যাহার করায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমান ও স্বতন্ত্রপ্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর মধ্যেই তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়ে পাঁচ বছর নারায়ণগঞ্জ শহর শাসন করেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। গতবারের স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকা আইভীই এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী। আর প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান প্রকাশ্যে তার পক্ষ নিয়েছেন।
তারপরেও দলীয় প্রতীকই শুধু নয়, এ নির্বাচনে শেষ মুহুর্তে নির্দলীয়, মহিলা ও অঞ্চলভিত্তিক ভোটাররাই মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর ভরসা। আর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা ও প্রথম সিটি নির্বাচনে বসে যাওয়ার কারণে আইভীর বিপক্ষে কোমর বেঁধে নেমেছেন বিএনপি প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান ও দলীয় নেতারা। এ কারণে এ নির্বাচনকে দলগুলোর ব্যাপারে জনমত যাচাই হিসেবেও ভাবছেন বিশ্লেষকরা।
মাঠ পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জে নৌকা ও ধানের শীষের ভোটার প্রায় সমানে সমান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নৌকার ভোটার এক লাখ দশ হাজার। অপরদিকে ধানের শীষের ভোটার কমপক্ষে এক লাখ। ফলে বিজয়ের মালা গলায় পরতে হলে আইভীকে ওই তিন শ্রেণির ভোটারদের ভোট বেশি টানতে হবে। সর্বমোট ভোটের সংখ্যা হিসাব করলে নির্দলীয় ভোট অর্ধেক।
আর এ পরিকল্পনা নিয়ে প্রচারণার শেষ দিন মঙ্গলবার পর্যন্ত বিশেষ করে এই তিন শ্রেণির ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘোরার চেষ্টা চালিয়েছেন নৌকার প্রার্থী আইভী। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে প্রচারণায় অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আইভীর ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, আইভী সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন নির্বাচনে যাতে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকে। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকলেও নির্বাচনের দিন সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের কাছে বিশেষ অনুরোধ করেছেন মেয়র প্রার্থী আইভী। কেন্দ্রীয় নেতাদের তিনি বলেছেন, সুষ্ঠু পরিবেশে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হলে অধিক সংখ্যক নির্দলীয় ও নারী ভোটার কেন্দ্রে ভোট দিতে যাবে। আর তার বিশ্বাস এদের সিংহভাগই তাকে ভোট দেবেন। এটি হলে নৌকার জয় সুনিশ্চিত বলে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন আইভী।
আওয়ামী লীগের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, গত রবিবার আইভী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করে বলেছেন, ‘আমি হেরে গেলে যাব, তবুও অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে নারায়ণগঞ্জে।’ সর্বশেষ মঙ্গলবার বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা আইভীকে ভোটের পরিস্থিতি জানতে ঢাকা থেকে ফোন করলে তাদেরকেও আইভী বলেন, ‘সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক তা চাই আমি। তাতে হেরে গেলেও যাবো।’
তাদের দাবি, দল নিরপেক্ষ ভোটাররা বেশি আইভীর দিকেই ঝুঁকে আছেন। মোট ভোটার সংখ্যার প্রায় অর্ধেকের মতো নারী ভোটার রয়েছে নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে এক লাখ ভোটার নৌকার পক্ষে আনতে কাজ করে যাচ্ছে নৌকার প্রার্থী। শেষ সময়ে অঞ্চলভিত্তিক ভোটারদের কাছে টানতে সর্বাত্মক চেষ্ঠা অব্যাহত রেখেছেন আইভী। এসব হিসাব-নিকাশ আইভীকে অনেকখানি এগিয়ে রেখেছে।
আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী সূত্রগুলো বলছে নারায়ণগঞ্জে সর্বমোট ভোটার সংখ্যা চার লাখ ৭৬ হাজার। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ ৪১ হাজার। নারী ভোটার দুই লাখ ৩৫ হাজার। নৌকা আর ধানের শীষ মিলিয়ে ভোট রয়েছে দুই লাখ দশ হাজারের মতো।
এরমধ্যে নৌকার এক লাখ দশ হাজার ভোটের মধ্যে ২০/৩০ হাজার ভোট নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান পরিবারভিত্তিক। এই ভোটগুলো শামীম ওসমানের ইশারায় এদিক, ওদিক যাবে। শামীম ওসমানকে বিশ্বাস করলেও বিজয় নিশ্চিত করতে দল নিরপেক্ষ, মহিলা ও অঞ্চলভিত্তিক ভোটারদের প্রাধান্য দিচ্ছেন আইভী।
জানা গেছে, আইভীকে জিততে হলে দল নিরপেক্ষ প্রায় আড়াই লাখ ভোটের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ভোট নিজের কব্জায় আনতে হবে। অন্যদিকে চাঁদপুর, মতলব, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও বরিশালের ভোট রয়েছে প্রায় সোয়া এক লাখ। এরমধ্যে কিছু ভোট আইভীর জরুরি। অপরদিকে নারী ভোটারের দিকে আইভীর রয়েছে বিশেষ নজর।
জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জের ভোট রয়েছে ৩০/৪০ হাজার। বরিশালের ভোট রয়েছে ২০/২৫ হাজার। কুমিল্লা-চাঁদপুর-মতলব মিলিয়ে রয়েছে ৫০ হাজারের মতো ভোটার। বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের রয়েছে আরও ২৫/৩০ হাজার ভোট। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থানের এই ভোটারদের প্রতি আস্থা রয়েছে আইভীর। তবে বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনের আদি বাড়ি মুন্সিগঞ্জের ভোটার নিয়ে তার খানিকটা দুশ্চিন্তা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, নারায়ণগঞ্জে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের ভোট কিছু বেশি। নারায়ণগঞ্জে মেয়র হিসাবে জিততে হলে অবশ্যই দল নিরপেক্ষ ভোটগুলো ফ্যাক্টর। তাছাড়া অর্ধেকের বেশি নারী ভোটার রয়েছে। অঞ্চলভিত্তিক কিছু সংখ্যক ভোটার রয়েছে। নৌকার ‘ফিক্সড’ ভোট ছাড়াও এ তিনটি শ্রেণির ভোটও টানতে হবে। তিনি বলেন, সেদিক থেকে আইভী অনেকাংশে এগিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে নারী ভোটার প্রতি দশ জনে আট জনই আইভীর।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, নারায়ণগঞ্জে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা ইতোমধ্যে সরকার দিয়েছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীও সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন চায়।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুহিবুল হাসান নওফেল বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। আর সে নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীই বিজয়ী হবে। তিনি বলেন, আমি নারায়ণগঞ্জে নির্বাচনি প্রচারণায় কাজ করছি, আমি আইভীর জনসমর্থন দেখেছি।-বাংলাট্রিবিউন
২১ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ