বিল্লাল হোসেন রবিন: সিল মারার সময় কই আছিলেন? এহন তো সব শেষ। আমাগোরে ডেইল্লা ধাক্কাইয়া বেডারা রুমে ঢুইক্কা যেমনে পারছে ব্যালট পেপারে সিল মারছে। আমাগোরে ভোট দিতে দেয় নাই। এইড্যা কুনো ভোট অইলো? সোনারগাঁয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নের মঙ্গলের গাঁও তাহেরপুর হাজী লাল মিয়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র্রে বেলা ১২টায় গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে এভাবেই ক্ষোভ ঝাড়তে ঝাড়তে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান বেশ কিছু মহিলা ভোটার। আছিয়া বেগম (৪৮) নামে এক ভোটার বলেন, সকাল থেকে সুন্দর মতোই ভোট চলছিল। বেলা ১১টার দিকে বৃষ্টি শুরু হলে হঠাৎ কয়েকজন যুবক মহিলাদের ঢেলে ৬নং মহিলা বুথে ঢোকে। এবং ব্যালট পেপার নিয়ে নৌকা মার্কায় সিল মারতে থাকে। পরে কে যেন বলে ওই সাংবাদিকরা আসতেছে। তখন দ্রুত তারা পালিয়ে যায়। পরে মহিলা বুথ ৬-এ গিয়ে দেখা যায় সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মাহাবুবুর রহমান নৌকা প্রতীকে সিল দেয়া ব্যালট বই নিয়ে বসে আছেন।
শুধু নৌকা প্রতীকেই নয়, তার কাছে থাকা মেম্বার এবং মহিলা মেম্বারদের ব্যালট বইয়েও (ব্যালট বইয়ের ২২৭৭৫ থেকে ২২৯০০ পর্যন্ত) সিল মারা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই আমরা পরিস্থিতির শিকার।’ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আবদুস সাত্তার খবর পেয়ে ওই বুথে ছুটে গেলেও তিনি এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃষ্টির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সেখানে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা প্রকাশ্যে ব্যালট বইয়ে সিল মারে। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের নীরবতার মধ্যেই সব বুথে ব্যালট পেপারে সিল মারার মহোৎসব চলে। এদিকে সাংবাদিকদের আসার খবর পেয়ে দ্রুত সটকে পড়ে তারা। ফলে সিল মারা সব ব্যালট পেপার বাক্সে ভরতে পারেনি। ওই সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকার এসিল্যান্ড আসিফ ইকবালকে সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রটিতে প্রবেশ করেন সোনারগাঁ থানার ওসি (তদন্ত) হারুন অর রশিদ। উভয়কে সিল মারা ব্যালট বই দেখানোর পরেও তারা এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেননি। উল্টো বলেন, আপনারা ভোট নিতে থাকেন। বৃষ্টিতে পাল্টে যায় চিত্র
সকালে দিকে সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। লাইনে ভোটারও ছিল পর্যাপ্ত। কিন্তু বেলা ১১টায় মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলে পাল্টে যেতে থাকে পরিস্থিতি। ওই সময় ভোটাররা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে সিল মারা শুরু করে। ঘটনার প্রতিবাদ করলে তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা। শুধু তাই নয়, সরকারদলীয় প্রার্থীদের পক্ষে নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে সিল মারার উৎসবে মেতে উঠলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। যেন তারা অসহায়। সাংবাদিকরা গিয়ে হাতেনাতে নৌকা প্রতীকে সিল মারা ব্যালট বইসহ সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের ধরলেও তারা সাংবাদিকদের কাছে তাদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে বলেছেন, তাদের কিছুই করার নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কোনো সহায়তা করছে না।
জামপুর ইউনিয়নে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শাহ মো. হানিফের পক্ষে জাতীয় পার্টির এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা প্রভাব বিস্তার করেছেন বলে অন্যান্য চেয়ারম্যান প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন। যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় এমপি লিয়াকত হোসেন খোকাও স্বীকার করেন তিনি জামপুরেই অবস্থান করছেন।
এদিকে সন্মান্দি ইউনিয়নে বিএনপি বা জাতীয় পার্টির কোনো চেয়ারম্যান প্রার্থী না থাকলেও এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৩ জনই ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা। এ ইউনিয়নের নীলকান্দা নাজিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ঈমানেরকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা দখল করে প্রকাশ্যে সিল মারে। ওই সময় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা প্রকাশ্যে সিল মারা ছবি তুলতে গিয়ে নাজিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকার সমর্থিতদের হাতে মহসিন নামে একটি জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিক লাঞ্ছিত হয়েছেন। এছাড়া এ ইউনিয়নের নানাখী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা দখলের চেষ্টা করলে পুলিশ ৩ রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
জামপুর ইউনিয়নে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহ মো. হানিফের পক্ষে প্রকাশ্যে সিল মারার অভিযোগ রয়েছে। এ ইউনিয়নের মহজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করে। এ নিয়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এছাড়া এ ইউনিয়নের ওটমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কলতাপাড়া সিনিয়র মাদরাসা, বাসাবো টিলাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পাকুন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দখলের চেষ্টা করা হয়। জামপুর ইউনিয়নে জাতীয় পার্টির প্রার্থী থাকায় স্থানীয় এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা সেখানেই অবস্থান করেছেন নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে। সোনারগাঁ থানার ওসি শাহ মঞ্জুর কাদের বলেন, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন শেষ হয়েছে। এ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে গতকাল ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টিতে বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিল। এছাড়া ২টি জাতীয় পার্টির এবং ১০টিতেই আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিল।
দুদঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বেলা সাড়ে ১১টায় ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পুরুষ মেম্বার প্রার্থীর একশ পাতার একটি ব্যালট বই প্রকাশ্যে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে মোরগ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা মুজিবুর রহমানের সমর্থকরা ব্যালট বইটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ কারণে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আবুল হোসেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ভোটগ্রহণ স্থগিত করে দেন। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশে ছিনতাই হওয়া ব্যালট বই উদ্ধার ছাড়াই ২ ঘণ্টা পর দুপুর দেড়টায় আবারও ভোটগ্রহণ শুরু হয় বলে তিনি জানিয়েছেন।
অপরদিকে নির্বাচনে ভোটগ্রহণের শেষ সময়ে বৈদ্যের বাজার ইউনিয়নের একটি কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য রুবায়েত হোসেন শান্তকে পুলিশ পিস্তলসহ আটক করে। কিন্তু পিস্তলটি বৈধ হওয়ায় পুলিশ তাকে ছেড়ে দিলেও তার অস্ত্রটি পুলিশ হেফাজতে নিয়ে নেয়। সোনারগাঁ থানার ওসি শাহ মঞ্জুর কাদের বলেন, অস্ত্রটি বৈধ হলেও নির্বাচন আচরণবিধি অনুযায়ী নির্বাচনের দিন কেউই বৈধ অস্ত্রও বহন করতে পারেন না।
এদিকে কেন্দ্র দখল, ভোটারদের চেয়ারম্যান পদে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা এবং কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ এনে সোনারগাঁ উপজেলার ৩ ইউনিয়নের বিএনপি প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। গতকাল দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত ওই ৩ প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। তারা হলেন- পিরোজপুর ইউনিয়নের বিএনপি প্রার্থী এবং বর্তমান চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, সাদিপুর ইউনিয়নের বিএনপি প্রার্থী কামরুজ্জামান মাসুম এবং কাঁচপুর ইউনিয়নের বিএনপি প্রার্থী ফজলুল হক। এই ৩ প্রার্থীই সরকারদলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল, পোলিং এজেন্ট বের করে দেয়া এবং ভোটারদের চেয়ারম্যান পদে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করার অভিযোগ আনেন।-সুত্র: মানবজমিন
২৯ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ