মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০১৬, ১২:৩০:০৫

‘আমি আর বাঁচুম না, বাবারে খবর দ্যান’

‘আমি আর বাঁচুম না, বাবারে খবর দ্যান’

বিল্লাল হোসেন রবিন: ‘আমি আর বাঁচুম না, বাবারে খবর দ্যান। আমার কেমন জানি লাগতাছে।’ পায়ুপথে বাতাস ঢুকানোর পর কারখানার ফ্লোরে পড়ে থাকা শিশু সাগর বর্মণ এমন আর্তনাদই করছিল। দ্রুত তার বাবাকে খবর দেয়া হয় এবং হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সাগরের সেকশনের লাইনম্যান মনির বরাত দিয়ে এমনটাই বলেছেন তার ভাবী অঞ্জনা রানী।

এর আগেও একবার কারখানার এক কর্মকর্তা সুতার কোন ফেলে সাগরের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। মাথায় ৫-৬টা সেলাই দেয়া হয়। চাকরি হারানোর ভয়ে বিষয়টি চেপে যান পরিবারের সদস্যরা। এমন নির্যাতন-নিপীড়ন নিত্যদিনের ঘটনা বলে জানিয়েছে কারখানায় কাজ করা এক ডজনের বেশি শিশু শ্রমিক।

গতকাল সোমবার সকাল থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত সরজিমন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের যাত্রামুড়ায় জোবেদা টেক্সটাইল অ্যান্ড স্প্রিনিং মিলে নিহত শিশু শ্রমিক সাগরের ঘটনা অনুসন্ধানে গিয়ে অনিয়মের নানা চিত্র পাওয়া গেছে।


এদিকে সাগর বর্মণ হত্যার ঘটনায় তার বাবা রতন বর্মণ বাদী হয়ে ৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো কয়েকজনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। সোমবার সকালে পুলিশ গ্রেপ্তারকৃত এজাহারভুক্ত আসামি জেবায়দা টেক্সটাইল ও স্পিনিং মিলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাজমুল হুদাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করলে আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এর আগে রূপগঞ্জ থানার ওসি ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্ব পুলিশ কারখানায় অভিযান চালিয়ে ২৪ জন শ্রমিককে আটক করে। যাদের মধ্যে অধিকাংশ শিশু। অন্যদিকে ঘটনার পর থেকেই গা-ঢাকা দিয়েছেন কারখানার সকল কর্মকর্তা।

সোমবার বেলা আড়াইটা পর্যন্ত অফিসের চেয়ারগুলো ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখা যায়। নিরাপত্তাকর্মী থেকে শুরু করে দু-চারজন যারা আছেন কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি। সাগরের মৃত্যুর ঘটনায় শ্রমিকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করলেও তাদের চোখে মুখে দেখা গেছে ভয় আর আতঙ্ক। কিছু বললে যদি চাকরি চলে যায়? ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত শেষে বিকাল ৪টার দিকে সাগর বর্মণের লাশ রূপগঞ্জে আনা হয়। পরে সেখান থেকে নারায়গঞ্জের বন্দরের লাঙ্গলবন্দ শ্মশানে নিয়ে দাহ করা হয়।


এদিকে গতকালও পুলিশ ও র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনা অনুসন্ধানে গিয়েছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি প্রতিনিধি দল। জেলা পুলিশের এএসপি (সার্কেল-বি) ফোরকান সিকদার বলেন, শিশুটির পায়ুপথে একজনের পক্ষে বাতাস ঢুকানো সম্ভব নয়। একাধিক ব্যক্তি ঘটনার সঙ্গে জড়িত। ঘটনার তদন্ত চলছে। ৪ জনকে আসামি করে নিহতের বাবা মামলা দিয়েছে। একজনকে রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।


এর আগেও সাগরের মাথা ফাটানো হয়। সাগরের ভাবী অঞ্জনা রানী জানান, তিনি ছাড়াও তার শ্বশুর রতন বর্মণ, শাশুড়ি লাবণ্য বর্মণ ও দেবর সাগর বর্মণ একই কারখানায় কাজ করেন। এর মধ্যে জোবেদা গ্রুপের এখলাছ স্প্রিনিং মিলের-১ ও এখলাছ স্প্রিনিং মিলের-২-এর ৫ নাম্বার সেকশনে কাজ করে সাগর।

আর তিনি ও তার শ্বশুর রতন বর্মণ কাজ করেন ৪ নাম্বার সেকশনে। ফিনিশিং সেকশনে কাজ করেন শাশুড়ি লাবণ্য বর্মণ। সাগর মাসে ৩ হাজার ১০০ টাকা বেতনের শ্রমিক ছিল। গত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে একবার সাগরের মাথায় সুতার কোন ফেলে দেয় কয়েকজন কর্মকর্তা। কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে তখন আমরা কিছুই বলতে পারিনি। ওই সময়ে সাগরকে হাসপাতালে নিয়ে মাথায় ৫-৬টা সেলাই দেয়া হয়েছিল। আহত হওয়ার কারণে যে কয়দিন কাজে যেতে পারেনি সে কয়দিন হাজিরা থেকে বেতনও কাটা হয়েছিল।

আর এবার তাকে মেরেই ফেললো! কিন্তু কারা তাকে মেরেছে? এমন প্রশ্নে অঞ্জনা বলেন, রোববার দুপুরের দিকে কমপ্রেসার মেশিনের সামনে ফ্লোরে মধ্যে পড়ে ছিল সাগর। লাইনম্যান মনিকে বলে আমার জানি কেমন লাগতাছে। আমি আর বাঁচুম না, বাবারে খবর দেন। এমনভাবেই আর্তনাদ করছিল। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পর সেখানে সে মারা যায়। সাগর বলেছে যারা তাকে হাওয়া দিয়েছে তাদের সে চিনে। কিন্তু নাম বলে যাওয়ার আগেই তো সে মরে গেছে। একথা বলেই কেঁদে ওঠেন অঞ্জনা রানী।


নির্বাক লাবণ্য বর্মণ:
নেত্রকোনার খালিয়াজুরী থানার রাজিবপুর এলাকায় বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন তিনি। স্বামী রতন বর্মণও দিনমজুর। ২ ছেলেকে নিয়ে আর পেরে উঠছিলেন না লাবণ্য বর্মণ। সংসারে অভাব লেগেই থাকতো। একটু সুখের আশায় পৈতৃক ভিটা ছেড়ে স্বামী ও শিশু সন্তান সাগরকে নিয়ে ছুটে আসেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে।

৫-৬ মাস আগে তিনজনই রূপগঞ্জের যাত্রামুড়া জোবেদা টেক্সটাইল মিলে কাজে যোগ দেন। মিলের পাশে দীঘি বরারো এলাকায় সাত্তার মিয়ার বাড়িতে ১০ ফুট বাই ১২ ফুটের একটি রুম ভাড়া নেন তারা। মিলের রিং সেকশনে বাবা-ছেলে চাকরি নেয়। আর তিনি ফিনিশিং বিভাগে ৩ হাজার টাকা বেতনে ঝাড়ুদারের কাজ শুরু করেন। বাবা-ছেলে ভোর ৬টায় কাজে যান আর ফিরেন বেলা ২টায়। তিনি রাত ১০টায় গিয়ে ফেরেন ভোর ৬টায়। ফলে ঘটনার দিন ছেলের সঙ্গে দেখা হয়নি।

দুপুরেই খবর পান তার আদরের ধন আর নেই। শনিবার রাত ৯টায় ছেলে সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়েছিল। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত  (সোমবার বেলা আড়াইটা) ছেলের মুখটা দেখতে পাইনি। একথা বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন লাবণ্য বর্মণ।


কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ৩ ছেলের মধ্যে সাগর বর্মণ (৯) ছিল সবার ছোট। বড় ছেলে উদয় বর্মণ নেত্রকোনায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে দিনমজুরি করে কোনো রকমে টিকে আছেন। মেজ ছেলে বাবা-মায়ের সঙ্গেই রূপগঞ্জে চলে আসেন। মেজ ছেলে নিপু বর্মণ রূপগঞ্জে দিনমজুরি করেন। তার স্ত্রী অঞ্জনা জোবেদা টেক্সটাইল মিলেই চাকরি করেন। আদরের ধন ছোট ছেলেকে হারিয়ে লাবণ্য বর্মণ নির্বাক হয়ে গেছেন। সাংবাদিকদের মাধ্যমে তিনি ছেলে হত্যার বিচার দাবি করেন।


ঘটনা আড়াল করতে নানা তৎপরতা: এদিকে ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাগরের মৃত্যুর পর কারখানার সকল শ্রমিককে ডেকে কর্তৃপক্ষ বিফ্রিং করে। যা শিখিয়ে দেয়া হয়েছে তার বাইরে যেন কারো সঙ্গে তারা কোনো কথা না বলে। দুর্ঘটনাস্থলে শক্তিশালী কমপ্রেসার মেশিন যেখানে ছিল তড়িঘড়ি করে ওই স্থানের দেয়ালে রং দিয়ে লেখা হয় ‘হাওয়া দেয়া নিষেধ’। একটি আর্ট পেপারেও হাতে লেখা হয় ‘হাওয়া দেয়া নিষেধ’, আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ।

এরপরই গা-ঢাকা দেয় কারখানার সকল কর্মকর্তা। তদন্তকারী ওই কর্মকর্তা বলেন, এসব কিছুই করা হয়েছে ঘটনাটি আড়াল করার জন্য। তিনি আরো বলেন, এমন কেউ ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছে, যাকে রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। সাধারণ কোনো শ্রমিক ঘটনাটি ঘটালে কর্তৃপক্ষ দোষী ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করতো কারখানার স্বার্থে। কিন্তু তা করা হয়নি।


এক কর্মকর্তা ৭ দিনের রিমান্ডে:
সাগর বর্মণ নিহত হওয়ার ঘটনায় সাগরের বাবা রতন বর্মন বাদী হয়ে জোবেদা টেক্সটাইল মিলের ৪ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৬/৭ জনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ এজাহারনামীয় আসামি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) নাজমুল হুদাকে (২৪) গ্রেপ্তার করেছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আদালতে পাঠানো হলে শুনানি শেষে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আশেক ইমাম ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

 

মামলার অন্য ৩ আসামি হলেন একই প্রতিষ্ঠানের প্রোডাকশন ম্যানেজার মো. হারুন অর রশিদ (৪৮), সিনিয়র প্রোডাকশন অফিসার আজাহার ইমাম সোহেল (৩৬) এবং সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার মো. রাশেদুল ইসলাম (৪০)। আর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাব-১১ সদস্যরা আটক করেছেন মিল মালিকের আত্মীয় মাসুম ভূঁইয়া এবং এনামুল ভূঁইয়া নামে ২ যুবককে।


গা-ঢাকা দিয়েছেন কর্মকর্তারা: এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে, শিশু সাগর বর্মণের মলদ্বারে কম্প্রেসারের নজেল দিয়ে বাতাস প্রবেশ করানোর ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি জড়িত। এ ঘটনায় জড়িতরা মালিকপক্ষের এবং প্রভাবশালী। যে কারণে তাদের বাঁচাতেই সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে মিলের সব কর্মকর্তা পলাতক রয়েছেন।


সামান্য অজুহাতে শিশু শ্রমিকদের নির্যাতন: গতকাল সরজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, একটি গেট ব্যবহার করেই এখলাছ স্পিনিং মিল, জোবেদা টেক্সটাইল মিল এবং আজহারুল স্পিনিং মিলে প্রবেশ করতে হয়। তিনটি প্রতিষ্ঠানের মালিক অভিন্ন এবং একই বংশীয়। তবে গতকাল প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি অফিস রুম ফাঁকা দেখা গেছে। কোনো অফিস কক্ষেই কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। চেয়ার টেবিল সব ফাঁকা পড়ে আছে। তবে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, শ্রমিকরা বিভিন্ন ইউনিটে কাজ করছে।


নিহত সাগর বর্মণ কাজ করতেন রিং সেকশনে। ওই সেকশনে মোট ১৫৮ জন শ্রমিক। যাদের ৭০ ভাগেরই বয়স ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। রিং সেকশনে একজন সুস্থ মানুষ ১০ মিনিট অবস্থান করতে পারবে না। এত গরম। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকদের নাভিশ্বাস উঠছে। চারপাশে দেয়াল, উপরে টিন দিয়ে তৈরি লম্বা শেডের মধ্যে কাজ করার সময় শ্রমিকরা প্রচণ্ড ঘামের কারণে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৩টি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ১ হাজার ২০০ শিশু শ্রমিক রয়েছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।

এসব শিশু শ্রমিকদের প্রতিষ্ঠানের প্রধান গেট দিয়ে না ঢুকিয়ে পেছনের একটি পকেট গেট দিয়ে প্রবেশ করানো হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া নানা তুচ্ছ ঘটনায় এখানে কর্মরত শিশু শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালানো হয় বলে কর্মরত শ্রমিকরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন।

গত এপ্রিল মাসে তুচ্ছ একটি ঘটনায় নিহত সাগরের মাথা ফাটিয়ে ফেলে প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা। ওই সময় সাগরের মাথায় ৫/৬টি সেলাই দিতে হয়েছিল। তাছাড়া ওই কারণে যে ক’দিন সে কাজে যেতে পারেনি ওই কয়দিনের বেতন কেটে রাখা হয়েছে বলে তার ভাবী অঞ্জনা জানিয়েছেন।


শিশু শ্রমিক উদ্ধার: এদিকে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রূপগঞ্জ থানার ওসি ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ২৪ জন শ্রমিককে উদ্ধার করা হয়েছে। ওই ২৪ শ্রমিকের মধ্যে ৮/১০ ছিল শিশু শ্রমিক। এভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শ্রমিকদের উঠিয়ে নিয়ে যাবার খবরে মিলের অন্য শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ভর করে। সব শ্রমিক কাজ ফেলে এক স্থানে জড়ো হয় ভয়-আতঙ্ক নিয়ে। একদিন আগে শিশু সাগরকে হত্যা, অপরদিকে মিলের কোনো কর্মকর্তা উপস্থিত না থাকায় শ্রমিকদের ভয় আরো জেঁকে বসে। তারা সাংবাদিকদের কাছে ভয়ার্ত কণ্ঠে জানতে চায় তাদের কিছু হবে না তো? বিশেষ করে মিলে কর্মরত নারী শ্রমিকদের ভয়টা ছিল একটু বেশিই।


রূপগঞ্জ থানার ওসি ইসমাইল হোসেন বলেন, ২৪ জন শিশু শ্রমিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয়া হবে। আর শিশু শ্রমিকদের তাদের পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হবে। এ ঘটনায় ৪ জনের নাম উল্লেখ করে নিহতের বাবা রতন বর্মণ মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ এজাহারনামীয় একজনকে গ্রেপ্তার করেছে।


সরকারি আইনে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ থাকলেও এ প্রতিষ্ঠানে ৯-১০ বছর বয়সী অসংখ্য শিশুকে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে দেখা গেছে গতকালও। দেশের সংবিধান অনুযায়ী ১৪ বছরের নিচে সবাই শিশু। ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত কিশোর। কিন্তু রূপগঞ্জের এ প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য শিশু শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে।


ঘটনা দেখলেও সবাই চুপ: গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা গেছে, মিলের পেছনের দিকে রিং সেকশনে কাজ করতো সাগর। তার বাবাও পাশেই একই সেকশনে কাজ করতো। কিন্তু কম্প্রেসার রুমটি সামনের দিকে। দুপুরে ঘটনার সময় সাগরে কিভাবে, কি কারণে গেল বা কে তাকে ডেকে নিয়ে গেল সে বিষয়ে কেউ মুখ খুলছে না। অথচ আশপাশের সেকশন থেকে ঘটনাস্থলের সবকিছু দেখা যায়। শক্তিশালী কম্প্রেসারের নজেল সাগরের মলদ্বারে প্রবেশ করাতে একাধিক সামর্থ্যবান ব্যক্তির প্রয়োজন বলে মনে করেন রূপগঞ্জ থানার ওসি ইসমাইল হোসেন।


ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী লাইনম্যান মনি আক্তার নিহত সাগরের বাবা রতন বর্মণকে খবর দিলেও গতকাল তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। শ্রমিকদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ঘটনার পরপরই মিলের শিশু শ্রমিকদের বের করে দেয় কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া কম্প্রেসার পাইপের ওপরে হলুদ রং ব্যবহার করে লিখে দেয়া হয় ‘হাওয়া দেয়া নিষেধ’। যা র‌্যাবের তদন্তে ধরা পড়ে। যে স্থানে সাগরের মলদ্বার দিয়ে বাতাস প্রবেশ করানো হয় ওই স্থানটি অন্য সেকশন থেকে সরাসরি দেখা গেলেও গতকাল ওই ঘটনার ব্যাপারে কোনো শ্রমিক মুখ খোলেননি। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার পরপর এ ব্যাপারে মুখ খুলতে কঠোরভাবে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের নিষেধ করেছেন। যারা মুখ খুলবে তাদের চাকরি থেকে বের করে দেয়ার ভয় দেখানো হয়েছে।


র‌্যাব-১১ সহকারী পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন বলেন, রোববার ঘটনার খবর পেয়ে র‌্যাব সদস্যরা ওই মিলে রাত আড়াইটা পর্যন্ত অবস্থান করে। কিন্তু কথা বলার জন্য কোনো কর্মকর্তাকে তারা পাননি। তারাও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।   


নিন্দা আর ক্ষোভ: এদিকে শিশু সাগর বর্মণকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা আর ক্ষোভ জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। তারা বলেন, ঘটনার জন্য কোনোভাবেই মালিক দায় এড়াতে পারেন না। তাই এ ঘটনায় তার সাজা হওয়া উচিত। নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও শহর সুজনের সভাপতি আবদুর রহমান বলেন, রোববার জোবেদা টেক্সটাইল মিলে যে পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছে তার দায় প্রতিষ্ঠানের মালিক কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। মিল মালিক শ্রম আইন লঙ্ঘন করে শিশু শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন।

মিল মালিক মোজাম্মেল হক সমাজে দানবীর সাজলেও ভেতরে ভেতরে তিনি তার মিলে অসংখ্য শিশুকে শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগিয়ে প্রকারান্তরে শ্রমিক নির্যাতন করে আসছিলেন। শিশু সাগরকে হত্যার পর পুলিশ এখনো হত্যার রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি। এতেই বোঝা যায় পুলিশ মালিকপক্ষকে সুবিধা দিতেই নীরবতা পালন করছে।


খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জহিরুল ইসলাম বলেন, যে সময় শিশুদের লেখাপড়া করে আনন্দময় সময় কাটানোর কথা, সেই সময় জোবেদা টেক্সটাইলসহ দেশের অনেক শিল্প কারখানায় শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। যা আইনগতভাবে অবৈধ। তিনি সাগর বর্মণ হত্যার বিচার দাবি করে বলেন, তা না হলে খেলাঘর সারাদেশে আন্দোলন গড়ে তুলবে।


বাংলাদেশ গার্মেন্ট-টেক্সটাইল ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান ইসমাইল বলেন, আইএলও কনভেনশন এবং বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী শিশু শ্রম নিষিদ্ধ। জোবেদা টেক্সটাইল মিলের  মালিক দালালচক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলা হতে শিশু শ্রমিক সংগ্রহ করে দুটি অপরাধ করেছেন। প্রথমত, শিশু শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে অর্থের সাশ্রয় হয়। দ্বিতীয়ত, শিশুদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করালেও তারা প্রতিবাদ করে না।

জোবেদা টেক্সটাইলের ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় বাধ্য হয়ে তাদের শিশু সন্তানদের কাজে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এ কারণে জোবেদা টেক্সটাইলের মালিক এবং ওই প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রমিক সরবরাহকারী দালালচক্রের শাস্তি হওয়া উচিত।


ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি হাফিজুল ইসলাম বলেন, শিশু সাগরকে হত্যার পর থেকে নানা নাটক করা হচ্ছে। প্রথমে বলা হলো, সাগরের বয়স ১০ নয় বরং ১৮। আর এখন বলা হচ্ছে শিশুটি নিজেই কম্প্রেসার দিয়ে শরীর পরিষ্কার করতে গিয়ে শরীরে বাতাস ঢুকে মারা যায়। যা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এসব নাটক করে অপরাধীরা রক্ষা পাবে না। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের ভেতরে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মালিকের।

তাই এ অভিযোগ থেকে মালিক কোনোভাবেই রেহাই পেতে পারে না। প্রশাসন মালিককে রক্ষার চেষ্টা করলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার হুশিয়ারি দেন তিনি। শিশু সাগরকে নির্মমভাবে হত্যার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি। বিবৃতিতে তিনি হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি জানিয়েছেন।-এমজমিন

২৬ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে