মো: গোলাম মোস্তফা : গত ২৪ নভেম্বর ২০১৭খ্রি : বাংলাদেশের বাউল গানের জগতে একটি নক্ষত্র ঝড়ে যায়। তিনি হলেন আমাদের সবার প্রিয় বারী সিদ্দিকী (১৯৫৪-২০১৭)। প্রথম জীবনে তাঁর পরিচয় ছিল তিনি একজন নামকরা বংশীবাদক।
তবে তিনি বাউল রশিদ উদ্দিনের (১৮৮৯-১৯৬৪) বিখ্যাত দুটি গান হুমায়ূন আহম্মেদ তাঁর পরিচালনায় ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে কষ্ঠ দেওয়ার পর বারী সিদ্দিকীকে আমরা নতুন করে পাই কন্ঠ শিল্পী হিসেবে।
আমার সোয়া চান পাখী
আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।
পান্ডুলিপিতে রশিদ উদ্দিনের হাতের লেখা এটি ৬৬ নং গান। কিন্তু এই গানটি হুমায়ূন আহম্মেদ “শ্রাবণ মেঘের দিন” চলচ্চিত্রে গীতিকার হিসেবে কবি পরিচিতিতে রশিদ উদ্দিনের নাম ব্যবহার না করে উকিল মুন্সির নাম ব্যবহার করেছেন। যা আদৌ সত্য নয়।
সম্ভবত এই ভুলটি হয়েছিল হুমায়ূন আহম্মেদ যার মাধ্যমে গানটি সংগ্রহ করেছিলেন তার ভুলের জন্য। গত ফেব্রুয়ারি ২০১৩ খ্রিঃ মাহবুব কবির সম্পাদিত ‘উকিল মুন্সির গান’ নিয়ে লিখা গবেষনাধর্মী গ্রন্থে তিনি বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
জনাব মাহবুব কবির বলেন, “এখানে উল্লেখ্য, হুমায়ূন আহম্মেদের ওই চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত “সোয়া চান পাখি/আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি” গানটি উকিল মুন্সির বলে পরিচিতি পায়। গানে কবি পরিচিতির ভণিতায় উকিলের নাম। তবু এ গানটি রশিদ উদ্দিনের নাকি উকিল মুন্সির তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে।
কিন্তু আমি যা দেখেছি ও জেনেছি তা হলো, রশিদ উদ্দিনের নাতির কাছে সংরক্ষিত তার প্রায় আড়াইশ গানের মধ্যে এই গানটি রয়েছে। রশিদ উদ্দিনের গানের এ পান্ডুলিপিটি অতি পুরানো। অন্যদিকে বিভিন্নজনের সংগ্রহ করা উকিল মুন্সির গানের পুরনো যে চারটি ডায়েরি আমার হস্তগত হয়েছে, সেসব ডায়েরির একটাতেও ওই গানটি নেই। এই চারটি ডায়েরির একটি গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশক সময়কালের।
এছাড়া নেত্রকোণা অঞ্চলের বাউল শিল্পীদের দাবি “সোয়া চান পাখি” গানটি রশিদ উদ্দিনের।” তাছাড়া বাউল শিল্পী বারী সিদ্দিকীর জীবদ্বশায় গত নভেম্বর ২০১৩খ্রি: মো: গোলাম মোস্তফা সংগ্রহ ও সম্পাদিত “রশিদ গীতিকা” গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার পর তিনি এই গ্রন্থের একটি কপি সংগ্রহ করেন এবং তাতে বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের হাতের লেখা প্রায় অতিপুরুনো পান্ডুলিপিতে সোনা চান পাখি গানটি লেখা দেখে এই অনাকাক্সিক্ষত ভুলটি উদার মন নিয়ে স্বীকার করে নেন এবং তখন থেকে কোনো গানের অনুষ্ঠানে রাবী সিদ্দিকী এই গানটি গাওয়ার সময় শেষের অংশে রশিদ উদ্দিনকে গানের গীতিকা হিসেবে স্বীকার করে উকুলি মুন্সির নাম সংযুক্ত করে দিতেন।
তখন তিনি গাইতেন “বাউল কবি রশিদ বলে ওরে উকিল ডাকলেই বা আর হবে কি।” পাঠকের জ্ঞানার্থে পান্ডুলিপি থেকে গানটির কোনো অংশ পরিবর্তন ছাড়াই হুবুহু তুলে ধরলাম।
ও আমার সোয়া চান পাখি
আমি ডাকিতাছি ঘুমাইছ নাকি?
তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি
আইজ কেন তুই হইলে নিরব মেল দুইটি আঁখি॥
বুলবুলি আর তোতা ময়না কত নাম তর রাখি
শিকল কেটে চলে গেলে কারে লইয়া থাকি॥
তোমার আমার মধুর পিরীত চন্দ্র সূর্য সাক্ষী
অকস্মাৎ কেন ভেঙ্গে দিলে বুঝলামনা চালাকী॥
বিশ্ব জোড়া এই পিরীতি সবই দেখছি ফাঁকি
বাউল কবি রশিদ বলে ডাকলেই বা হবে কি ॥
আবার অনেকেই মনে করে থাকেন এই “সোয়া চান পাখি গানটি” রশিদ উদ্দিন রচনা করেছেন তার প্রথম স্ত্রী দৌলতেন্নেছার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে। কিন্তু পারিবারিক তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, রশিদ উদ্দিনের প্রথম স্ত্রী দৌলতেনেচ্ছা মারা যান রশিদ উদ্দিনের মৃত্যুর পর এবং দ্বিতীয় স্ত্রী আমিরজান মারা যান প্রায় শত বছর বয়সে ২০১৭ খ্রি:।
দ্বিতীয় স্ত্রী আমিরজানের মতে, রশিদ উদ্দিন এই গানটি রচনা করেন তার প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় সন্তান বোরহান উদ্দিনের মৃত্যুর পর। বাংলা ১৩৪৪ সনের ২২শে চৈত্র রোজ সোমবার প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় ছেলে আদরের বোরহান উদ্দিন মৃত্যুবরণ করে। এতে রশিদ উদ্দিন খুবই মর্মাহত হন। রশিদ উদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী আমিরজানের মতে, “এই সময় বাউল রশিদ উদ্দিন তার বিখ্যাত গান “আমার সোয়া চান পাখী, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি” গানটি রচনা করেন।
তিনি বলেন, “ছেলের মৃত্যুর সময় গান পাগল রশিদ উদ্দিন ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার বাড়িতে বাউল গানের আসরে ছিলেন। সেখানে বসেই তিনি তার প্রিয় সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ পান। তখন তিনি উক্ত গানটি রচনা করেন এবং ছেলের মৃত্যুর পর প্রায়ই তিনি একা একা বসে এই গানটি গাইতেন।” রশিদ উদ্দিনের পান্ডুলিপি ছাড়াও পারিবারিক ডায়েরীতে গানটি ও ছেলের মৃত্যুর তারিখসহ বিস্তারিত লেখা রয়েছে। কাজেই এ বিষয়ে বিতর্ক তৈরি করা অনর্থক।
হুমায়ূন আহম্মেদে “শ্রাবণ মেঘের দিন” চলচ্চিত্রে রশিদ উদ্দিনের লেখা এবং বিখ্যাত বাউল শিল্পী বারী সিদ্দিকী গাওয়া আরেকটি বিখ্যাত গান হলো-
মানুষ ধর মানুষ ভজ শোন বলিরে পাগল মন।
মানুষের ভিতরে মানুষ করিতাছে বিরাজন॥
মানুষ কি আর এমনি বটে যার কারণে জগৎ রটে
ঐ যে পঞ্চ ভূতের ঘটে খেলিতেছে নিরঞ্জন॥
চৌদ্দ তালার উপরে দালান তার ভিতরে ফুলের বাগান
লাইলী আর মাজনু দেওয়ান বর্যকে করছে আসন॥
তালাশে খালাস মিলে তালাস কর রং মহলে
উঠিয়া হাব লঙ্কেরপুলে চেয়ে থাকে সারাক্ষন।
উঠিয়া দেখিবেপুলে দুই দিগেতে অগ্নিজ্বলে
ভেবে রশিদ উদ্দীন বলে চমকিছে স্বর্ণের মতন॥
দুই ধারেতে দুই কডড়া হায়াত আর মউত মাঝে ভরা
সময় থাকতে খোঁজেগে তোরা নিকটেতে কালসমন।
সোনারপুরি আধাঁর করে যেদিন পাখি যাবে উড়ে
শূন্যখাঁচা থাকবে পড়ে, কে করবে আর তার যতন॥
বাউল রশিদ উদ্দিনের এই গান দুটি দরদি কন্ঠ দিয়ে পরিবেশন করে, প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন বিখ্যাত লোকগীতি শিল্পী বারি সিদ্দিকী। ফলে মানুষ নতুন করে পরিচয় খুঁজতে থাকে গীতিকার বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের।
বাউল রশিদ উদ্দিন তার এ গানের জন্য ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক “শ্রেষ্ঠ গীতিকার” মরণোত্তর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করে এবং উক্ত পুরস্কারটি ঘোষণা করা হয় ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে। কিন্তু গীতিকারের ঠিকানা খুঁজে পেতে সমস্যা হওয়ায় পরিবারের লোকদের কাছে পুরস্কারটি পৌঁছায় ২০০৪ সালে।
আজ বাউল কবি রশিদ উদ্দিন, লেখক ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ুন আহম্মেদ, বাউল শিল্পী বারী সিদ্দিকী তারা সকলেই আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন। কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাদের স্মৃতি আর অহংকার করার মতো কিছু কালজয়ী কর্ম। তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, আমাদের জন্য এক একটি প্রতিষ্ঠান। তারা বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে, তাদের কর্মে। ওমর হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে।
লেখক : সংগ্রহ ও সম্পাদক, রশিদ গীতিকা এবং অধ্যক্ষ রাজুর বাজার কলেজিয়েট স্কুল, নেত্রকোণা সদর, নেত্রকোণা।
এমটিনিউজ/এসবি