এম. মিজানুর রহমান সোহেল: ইন্দোনেশিয়ায় সোদিমেদজো নামের ১৪৬ বছর সবচেয়ে বেশী বয়সী ব্যক্তিটি মারা যাওয়ার পর এই মুহূর্তে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ’ মনে করা হচ্ছে বাংলাদেশের পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার বিএল বাড়ী গ্রামের আলহাজ্ব আহসান উদ্দিন শাহকে। তার বয়স এখন ১২৫ বছর। বয়সের ভারে নওয়ে পড়লেও এখনও নিয়মিত নামাজ আদায় করেন তিনি। অবশ্য গত দু-বছর ধরে তিনি বসে বসে নামাজ আদায় করেন। ১৮৯২ সালের জানুয়ারি মাসের কোনও একদিন তিনি জন্ম গ্রহণ করেন।
এ বিষয়ে আহসান উদ্দিনের ছোট ছেলে সাংবাদিক গোলাম মওলা বলেন, আমার বাবা তাঁর দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আমুল পরিবর্তন যেমন দেখেছেন, তেমনি তিনটি শতক দেখা এই প্রবীণের জীবদ্দশায় বৃটিশ শাসিত সরকার, পাকিস্তান সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের শাসন দেখে যেতে পারছেন।
এই দীর্ঘজীবনের জন্য তিনি কৃতিত্ব দিয়েছেন নিয়ন্ত্রিত জীবন এবং খাদ্যাভাস। ছোট বেলা থেকেই তিনি নিয়মিত গরুর দুধ পান করেন। তার প্রিয় খাবার দুধ কলা ভাত। তিনি এখনও নিজেই নিজের খাবার খেতে পারেন। এখনও তিনি গরুর দুধ ছাড়া খাত খেতে চান না। বর্তমানে তিনি এক স্ত্রী ও ১৪ (সাত ছেলে ও সাত মেয়ে) সন্তানের জনক। মহান মুক্তিযুদ্ধের আগেই ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি ৫ ছেলে ও ৪ মেয়েসহ মোট ৯ সন্তান জন্ম দেন। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি আরও ২ ছেলে ও আরও ৩ মেয়েসহ মোট ৫ সন্তানের পিতা হন। সব মিলিয়ে ১৯৮৭ সালে তিনি ১৪ সন্তানের জনক হন।
এর আগে গত মে মাসে ইন্দোনেশিয়ায় সোদিমেদজো নামের ১৪৬ বছর সবচেয়ে বেশী বয়সী ব্যক্তিটি মারা গেছেন। ফলে ধরণা করা হচ্ছে, বর্তমানে পাবনার আহসান উদ্দিন শাহ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। তিনি ইদানিং কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চোখে একটু কম দেখছেন। কানেও তুলনামুলকভাবে কম শুনছেন।
তার বয়স প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বয়স কত হয়েছে তা বলতে পারবো না। তবে পাবনার ঈশ্বরদীর পাকশীতে যখন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণ করা হয় তখন আমার বয়স ছিল ১৮ থেকে ২০ বছরেরও কাছাকাছি। ১৯০৮ সালের দিকে বৃটিশ শাসিত ভারত সরকার ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ তৈরীর কাজ শুরু করে। তিনি জানান, ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ তৈরীর সময় তিনি ও তার বন্ধুরা সেখানে অনেক আড্ডা দিয়েছেন। রেল লাইনের জন্য যখন মাটি কাটা শুরু হয়, তখন তিনি তার বন্ধুদের সঙ্গে ওই রাস্তার ওপর ডাঙ্গুলি খেলেছেন। সেখানে গরু চরিয়েছিয়েন। তিনি বলেন, ওই সময় আমাদের চোখের সামনে কালো রঙ্গের মহিলারা (নারি শ্রমিকরা) জমি থেকে মাটি কেটে রাস্তা উচু করেছে। তারপর সেখান দিয়ে রেল পথ স্থাপন করা হয়েছে।
জানা গেছে, অবিভক্ত ভারতের পূর্বঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তর পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কলিকাতার সহজ যোগাযোগের কথা বিবেচনা করে বৃটিশ শাসিত ভারত সরকার ১৮৮৯ সালে এই অঞ্চলে রেলপথ তৈরীর পরিকল্পনা করে। ১৯০৮ সালের দিকে বৃটিশ শাসিত ভারত সরকার ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ তৈরীর কাজ শুরু করে। ওই বছরই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের মঞ্জুরি লাভ করে। এর পরের বছর ১৯০৯ সালে পদ্মায় পাকশি এলাকায় সেতু নির্মাণের জন্য সার্ভে করা হয়। ১৯১০-১১ সালে প্রথম কাজের মৌসুম শুরু হলে ভয়াল পদ্মার দুই তীরে সেতু রক্ষী বাঁধ নির্মণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে মূল সেতুর কাজ শুরু হয় পরের বছর ১৯১২ সালে। এর তিন বছর পরই ১ জানুয়ারি ১৯১৫ সালে ১ ডাউন লাইন দিয়ে প্রথম চালু হয় মাল গাড়ি। দুই মাস পরেই ৪ মার্চ ১৯১৫ সালে সেতুর উপর ডবল রেল লাইন দিয়ে যাত্রীবাহী গাড়ি চলাচলের উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভারতের গর্ভনর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড চার্লস হার্ডিঞ্জ যার নামে বর্তমানে সেতুটির নাম করণ।
আহসান উদ্দিন বলেন, ওই ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ কলকাতা বন্দরে মাছ রফতানীর জন্য প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে লাহিড়ী মোহনপুর, দিলপাশার, শরৎনগর ও বড়াল-ব্রীজ রেল ষ্টেশনগুলো চলনবিলের মাছ ও পাট রফতনীর জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এই বৃদ্ধের বয়স যখন ১০ বছর তখন তার পিতা বরকত শাহ মারা যান। তৃতীয় সন্তান মো. আফজাল হোসেন শাহ্ মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আহসান উদ্দিন বলেন, শেখ সাহেবের ডাকে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখনই আমি ৮ সন্তানের জনক (৪ মেয়ে ৪ ছেলে)। এছাড়া ছোট বেলায় বাবা মারা যাওয়ায় সংসারের হাল ধরতে হয় আমাকেই। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরণের সহায়তা করেছি। তখন আমার তৃতীয় নম্বর সন্তান আফজাল হোসেন মুক্তিযুদ্ধে যায়। সে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে আসে। ফিরে এসে ওরা সংঘবদ্ধভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/টিটি/পিএস