হায়দার আলী: বুকে ব্যথা নিয়ে ফেনীর দাগনভূঞা থেকে এসেছেন আজিমা খাতুন (২৭)। গত ১০ দিন ধরে শেরেবাংলা নগর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৪০ নম্বর বেডে আছেন তিনি। কিন্তু এই কয়দিনে তাকে বুকের ব্যথা যত না, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি যন্ত্রণা দিয়েছে তেলাপোকা। কেউ কেউ একে চায়না তেলাপোকা বললেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মতে, এটি জার্মানি তেলাপোকা। সম্প্রতি হাসপাতালে সরেজমিন পরিদর্শনের সময় আজিমা খাতুনের কাছে হাসপাতালের সেবার মান সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, 'বুকের যন্ত্রণার চেয়ে তেলাপোকার যন্ত্রণাই বেশি পাচ্ছি। আগে এই তেলাপোকা তাড়ান।' তিনি বলেন, 'বিছানার নিচ থেকে শুরু করে লকারেও হাজার হাজার তেলাপোকা আস্তানা গেড়েছে। গত রাতেও সব খাবার ফেলে দিতে হয়েছে। না খেয়ে থেকেছি। যিনি সঙ্গে আছেন তিনি রোগীর পরিচর্যা করবেন, না এই তেলাপোকা তাড়াবেন?' ৩৯ নম্বর বেডের অসুস্থ দীপা খানমও বলেন, 'শুধু আমার বেডেই তো ভাই এক লাখের বেশি তেলাপোকা।' আরেক রোগী বলেন, 'এ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয় না, তেলাপোকার আবাদ করা হয়। আমরা সেই তেলাপোকার খাদ্য ও সার।' এমনকি হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরাও এ নিয়ে অতিষ্ঠ ও আশঙ্কিত। কেননা তেলাপোকার কারণে খাবার থেকে রোগীর শরীরে জীবাণু ছড়াতে পারে, নতুন রোগ দেখা দিতে পারে। হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তি ও রোগীদের মাধ্যমে বাসাবাড়িতেও এ তেলাপোকা ছড়িয়ে পড়ছে।
হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ূয়ার মতে, ভয়ঙ্কর এবং শক্তিশালী এই তেলাপোকার নাম জার্মানি তেলাপোকা। তবে কয়েকজন নার্স বলেন, এটি চায়না তেলাপোকা। একে নিশ্চিহ্ন করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নাকি প্রতিদিনই বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওষুধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পন্থা প্রয়োগ করেও তেলাপোকার বংশ বিস্তার থামানো যাচ্ছে না।
হাসপাতাল থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বাসাবাড়িতে: এক নম্বর ওয়ার্ডের রোগী আবু তাহের। চলতি মাসের প্রথম দিন ভর্তি হয়েছেন তিনি। তার বোন জাহানারা বেগম বলেন, 'তেলাপোকার কারণে মেঝেতেও ঘুমানো যায় না। প্রথম দিন মেঝেতে শুয়েছিলাম। একটা তেলাপোকা কানে ঢুকে গিয়েছিল। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি।' চিকিৎসা করাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে এসেছেন রফিকুল ইসলাম প্রধান। তার দেখভাল করছেন তার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র আসাদুজ্জামান মিয়া। তিনি সমকালকে বলেন, 'বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর অনেক সমস্যাই মোকাবেলা করছি। কিন্তু ভাই, এর মধ্যে তেলাপোকার যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।' তিনি জানান, এ ব্যাপারে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করবেন।
সিনিয়র নার্স ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইনচার্জ আদুরী মণ্ডল সমকালকে বলেন, 'সবাই বলে, এটা চায়না তেলাপোকা। এর যন্ত্রণায় আমরাও অতিষ্ঠ। আমি এ সম্পর্কে পরিচালক স্যারকেও জানিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স বলেন, 'চায়না তেলাপোকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে কর্তৃপক্ষও ক্লান্ত হয়ে গেছে। কাপড়-চোপড় আর ব্যাগের সঙ্গে এই তেলাপোকা আমাদের কারও কারও বাড়িতেও চলে গেছে। বাসাবাড়িতেও এর বিস্তার ঘটছে। এরা ভয়ঙ্কর রকম প্রজননশীল। আমাদের কাছে রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে যত না, তারও বেশি অভিযোগ আসে এই তেলাপোকার উৎপাত নিয়ে।'
সবখানেই অব্যবস্থাপনা: সরেজমিনে দেখা যায়, দৃশ্যত তেলাপোকার যন্ত্রণা বড় হয়ে উঠলেও হাসপাতালের সবখানেই রয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। রোগীদের টয়লেটগুলো এত অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন যে, রোগীরাও সেখানে যেতে ভয় পান। হাসপাতালের নার্স, আয়া কিংবা বুয়াদের কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করলে তারা খারাপ ব্যবহার করেন। বাড়িতে গিয়ে টয়লেট ব্যবহার করতে বলেন। সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও বিছানার চাদর বা বালিশের কাভার পরিবর্তন করা হয় না। অনেক সময় নতুন ভর্তি হয়েও বেডে পুরনো রোগীর ব্যবহৃত চাদর ও বালিশ ব্যবহার করতে হয়। কোনো কোনো নার্স দুর্ব্যবহার করে বলেন, 'এত কিছু চান, তা হলে কেবিনে ভর্তি হন, প্রাইভেট হাসপাতালে যান। যেমন রোগী, তেমন সেবা।' অভিযোগ, হাসপাতালের চিকিৎসকরা রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিলে দালালদের সক্রিয় সিন্ডিকেট রোগীদের ফুঁসলিয়ে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এছাড়া হাসপাতালে এক্সরে, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে গেলে টাকা নিয়ে পরের সিরিয়াল আগে করানো হয়।
নার্স-আয়াদের যন্ত্রণাও কম নয়: ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকজন রোগীর স্বজন ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, 'খালি তেলাপোকারই না, নার্স ও আয়াদের যন্ত্রণাও কম নয়। পরামর্শের জন্য কিংবা অভিযোগ জানাতে গেলে বেশিরভাগ নার্সই খারাপ ব্যবহার করে থাকেন। ৪৪ নম্বর বেডের রোগী সেলিনা আক্তারের স্বামী আবু সাঈদ বলেন, 'আমার স্ত্রীকে সাড়ে ১০টায় স্যালাইন দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১১টা বেজে গেলেও তা দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে নার্সরা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতে বলেন। রোগীর কারণে চুপ করে থাকি। শেষ পর্যন্ত রাত সাড়ে ১১টায় স্যালাইন দেওয়া হয়।' আরও অনেকেই জানান, নার্সদের কাছ থেকে সদ্ব্যবহার পান না তারা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য: হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে রয়েছে বেসরকারি সংস্থা জে ডিলাক্স চ্যানেল। এ বিষয়ে সংস্থাটির কর্মকর্তা মো. বিপ্লব বলেন, 'তেলাপোকা নিধনে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। পরিচালক স্যারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিভিন্ন ওয়ার্ড পরিদর্শন করে এ সম্পর্কে নির্দেশও দিয়েছেন।' ঈদের ছুটিতে এই 'চায়না তেলাপোকা' নির্মূলের জন্য জোরালো চেষ্টা চলবে বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ূয়া বলেন, 'আজই (সোমবার) চিকিৎসকদের সঙ্গে হাসপাতালকে তেলাপোকা ও বিড়ালমুক্ত করার জন্য মতবিনিময় করেছি। এগুলো জার্মানি তেলাপোকা। এদের জীবনীশক্তি অনেক বেশি। তারপরও এদের নির্মূল করার লক্ষ্যে দ্রুত কাজ শুরু হবে।-সমকাল
২৮ আগস্ট,২০১৬/এমটি নিউজ২৪/আ শি/এএস