মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬, ০৩:৪৬:০৮

একটি বিবাহ বার্ষিকী এবং একটি বন্ধুত্বের গল্প.....

একটি বিবাহ বার্ষিকী এবং একটি বন্ধুত্বের গল্প.....

লেখকঃনিলয় আহসান নিশো(বৃষ্টিহীন বর্ষাকাল)
..
...
(১)
..
...
রাত ৮টা.....
নিলয় অফিস থেকে বাসায় আসলো।এসেই দেখে তার বিল্লিটা(নিরুপমা)  মন খারাপ করে বসে আছে। একেই আজকে অফিসে অতিরিক্ত ৩ঘন্টা কাজ করতে হয়েছে।তার উপর বাসায় এসে দেখে নিরুপমা এভাবে বসে আছে মন খারাপ করে।নিলয় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে তোমার।মন খারাপ কেন?
নিরুপমার কোন উত্তর নাই।নিলয় এবার রেগেই জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে টা কি??
সারাদিন অফিস করে এসে কি তোমার নাটক দেখতে হবে আমাকে?
..
...
নিরুপমা শুধু একবার আস্তে করে বললো তোমাকে আমি সকালে অফিস যাওয়ার সময় কি যেন বলেছিলাম?
নিলয়ের এবার মনে পড়লো আজকে সকালে নিরুপমা টাই বাধার সময় বেশ খুশি ছিল আর অফিস থেকে বিকেলের মধ্যেই আসতে বলেছিল....
তখন নিলয় বললো, অফিসে কাজ ছিল তাই দেরি হয়ে গেছে।এতে মন খারাপের কি আছে।আজ তো আর প্রথম বারের মত এমন হচ্ছে না।একা একটা মানুষ এত বড় ব্যবসা চালানো এত সহজ না।
..
...
নিরুপমা বললো নিলয় আজ ১৫ই জুন....
আমাদের পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী।
নিলয় এবার প্রচন্ড রেগে গেল।রেগে গিয়ে বেশ ঝাঁঝালো গলায় কথা বলতে লাগলো। আজ বিবাহ বার্ষিকী তো কি হয়েছে? তোমার সাথে আমাকে নাচতে হবে?  বিয়ে হয়েছে একবার সেটা নিয়ে প্রতিবছর এত মাতামাতি কিসের?
নিলয় তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? তুমি নিজেই তো বলেছিলে বিয়ের আগে যে প্রতিবছর আমরা বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করবো।তখন বলেছিলাম কারন তখন শুধু আমরা দুজন ছিলাম। আর এখন আমার একটা পরিবার আছে। আমার মেয়ে নিলিমা আছে।তার ভবিষ্যৎ গড়তে হবে আমাকে।তাই এত আদিখ্যেতা দেখার সময় নেই আমার।
..
...
নিরুপমা বিছানায় শুয়ে পড়ে বালিশ জরিয়ে গুমরে কাঁদতে লাগলো। নিলয় ফ্রেস হয়ে রুমে আসলো। এসে দেখে নিরুপমা কাদঁছে।মেজাজ টাই বিগড়ে গেল তার।নিরুপমা কে ডেকে উঠিয়ে বসাল।জিজ্ঞেস করলো কাঁদছো কেন?
নিরুপমা বললো তুমি আমাকে বলেছিলে আমাদের বিয়ের জন্য তোমার বান্ধবীরা যে সাহায্য করেছে সেটা তুমি কখনোই ভুলবে না।আর প্রতি বিবাহ বার্ষিকী তে তুমি ওদের সবাইকে নিয়ে বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করবে।সে সব আজ কই গেল নিলয়?
নিলয় এবার চুড়ান্ত রেগে গিয়ে বললো, তোমার কোন বান্ধবীর মনে আছে আমাদের কথা??  কে তোমার খবর রাখে? চল আজকে তোমাকে প্রমান করাই দিব যে তারা সবাই তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই ব্যস্ত। তোমাকে দেবার মত সময় আজ তাদের কাছে নেই?
..
...
নিরুপমা অবাক নিলয়ের এমন আকস্মিক পরিবর্তন এ।নিলয় নিরুপমা কে বের হতে বললো। অনেক টা জোর করে নিরুপমা কে বের করে এনে গাড়িতে বসালো।তারপর তাদের রাজকন্যা নিলীমা কে কোলে করে নিয়ে আসলো। নিরুপমা চুপচাপ বসে আছে গাড়িতে। নিলয় গাড়ি চালাতে লাগলো। নিরুপমা বললো কোথায় যাচ্ছি আমরা।নিলয় রাগ ধরে রেখেই বললো তোমার অতি আহ্লাদের বান্ধবীদের বাসায়।
তারা তো আমাদের বিবাহ বার্ষিকীর কেক নিয়ে তাদের বাসায় অপেক্ষা করছে সেই কেক তোমাকে খাওয়াতে।নিরুপমা কিছু টা লজ্জা বোধ করলো নিলয়ের এমন অপমানসুচক কথায়।
..
...
(২)
..
...
ভার্সিটির সব থেকে চঞ্চল ছেলেটি নিরুপমার সামনে বসে আছে। সেটাও আবার ভেজা বেড়ালের মত চুপসে।যে ছেলেটা পুরো ভার্সিটি কে মাতিয়ে রাখে সেই ছেলেটি নিরুপমার সামনে আসলে বোকা হয়ে যায়।আজব!!!! লাগে নিরুপমার আবার ভালো ও লাগে অনেক? ছেলেটিকে ভেজা বেড়ালের মত দেখে।তাই নিরুপমা আদর করে ছেলেটিকে ডাকে মিঁয়াও বলে।আর ছেলেটি নিরুপমাকে ডাকে বিল্লি বলে।কারন নিরুপমা মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই বিল্লির মত সাজে। আবার নিরুপমা কে বিল্লি না সাজলেও চলে কারন নিরুপমা বিল্লির মতই কোমলমতি আর আদুরে।
মাঝে মাঝে মুখ এমন ভঙি করে তাকায় যে তার সামনে কখনোই কোনভাবে মন খারাপ করে থাকা সম্ভব না।
..
...
নিলয় অনেক হাসি খুশি টাইপের ছেলে।সবাইকে অনেক হাসি খুসি রাখে। কিন্তু নিরুপমার সামনে সব গুলিয়ে যায়। কারন নিরুপমা অনেক শাষন করে নিলয় কে।আর নিলয় টাও যে কি সব কথা মেনে নিবে।একটু ভুল করলেও বারবার স্যরি বলে মাথা খারাপ করে দিবে।মাঝে মাঝে নিরুপমাও কিছু ভুল করে। তখন স্যরি বলতে গেলেই নিলয় স্যরি বলতে দিতো না।বলতো আমার বিল্লি টাকে আমাকে কখনোই স্যরি বলতে হবে না।আমার বিল্লি টার কোন ভুল নাই আমার কাছে।নিরুপমা মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই অনেক রাগ জমা করে নিলয়কে রাগ দেখানোর জন্য দেখা করতে বলতো, নিলয় আসলে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে ভুলে যেত সব রাগ নিরুপমা।
..
...
মিয়াও হল নিলয় আর মিয়াও এর বিল্লি হল তার নিরুপমা। দুজন দুই একই ভার্সিটি তে আলাদা ডিপার্টমেন্ট এ পড়ে। কি থেকে কিভাবে যেন তাদের সম্পর্ক টা হয়েই যায়।৪বছর রিলেশন করে।এই ৪বছরে কম ঝামেলা তাদের পোহাতে হয়নি।অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়েছে ওরা। অনেক ঝড় গেছে। তবু তারা হাত ছাড়ে নি।তবে তাদের এই সম্পর্ক টিকে থাকার পিছনে অন্যতম কারন হল নিরুপমার বান্ধবীরা।
রুনা, উপমা,কেয়া,  ও মুক্তা।অনেক কষ্ট সহ্য করেছে তারা। শুধু নিরুপমার জন্যই।নিরুপমা আম্মুর সামনে  কত বার যে কত মিথ্যে বলেছে সেগুলো হিসেব করে শেষ করা যাবে না।
..
...
(৩)
..
...
হঠাত গাড়িতে ব্রেক কষায় নিরুপমার ঘোর ভাঙলো, নিরুপমা বাইরে তাকিয়ে দেখে তারা টঙীতে এসে পড়েছে মানে Runa  এর বাসায়। বাসার কলিংবেল চাপতেই কাজের মেয়ে টা দরজা খুলে দিল। নিরুপমা কে মেয়েটি চিনে নিরুপমা জিজ্ঞেস করলো রুনা কই? ম্যাডাম তো সাহেবের সাথে গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে গেছে আজ ২দিন হল, মেয়েটি বললো। রুনা কে ফোন দাও নিরুপমা কে বললো নিলয়। নিরুপমা রুনা কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো যে আজ তার পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী আর রুনার সেখানে থাকার কথা। সে কেন গ্রামে গেছে এই সময়। স্যরি দোস্ত আমার একটুও মনে ছিল না তোর বিবাহ বার্ষিকীর কথা।দোস্ত  এর পরের বার কয়েক দিন আগেই মনে করাই দিস তোকে গিফট দিবো আর একসাথেই তোর ষষ্ঠ বিবাহ বার্ষিকী ধুমধাম করে উদযাপন করবো। রুনা বললো।
নিরুপমা নিলয়ের দিকে ফ্যাকাসে মুখে তাকালো।যার জন্য সে কাঁদতেছিল তার নিরুপমার বিবাহ বার্ষিকীর কথা মনেই নেই।নিরুপমা গাড়িতে উঠে বসলো নিলীমা কে কোলে নিয়ে।নিলয় গাড়ি চালাতে লাগলো।
...
...
নিরুপমা ভাবছে রুনার কথা।এই কি সেই রুনা।ক্যাম্পাসে দেখা হলেই আগে জোর করে হলেও একটা hug দিবে তারপর কথা শুরু করবে।বলবে দোস্ত তোরে বুকে নাই জড়াইলে তো আড্ডা দিয়া মজা পাইতাম না।নিরুপমা বারবার বলতো এর পরের বার আর এমন করবি না। আমার সব Hug আমার স্বামীর জন্য জমাই রাখছি।তখনি রুনা বলে উঠত, বিয়ে কর আগে আমি তোর বাসার পাশে বাসা নিবো আর প্রতিদিন তোকে হাগ করবো। তোমাকে ছাড়া তো আমার চলবে না জানু।তোমাকে আমার চাই।তোমার নিলয়ের কাছ থেকে তো তোমাকে চুরি করে আনবো। এই সেই রুনা যে আমার বিয়ের দিন আমার থেকেও বেশি কেঁদেছিল আমাকে জড়াই ধরে।সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম রুনা আমার জন্য কি?
একবার জড়াই ধরে এই যে কান্না শুরু করলো আর থামার নাম নেই।মনে হচ্ছিল আম্মু নয় রুনাই কন্যাদান করছে।
আর সেই রুনা কি আজকের রুনা?
আমার এই বিবাহ বার্ষিকী যাক পরের টাতে আমাকে উইশ করবে।...
হা হা হা......
..
...
(৪)
..
...
নিলয় সা সা করে গাড়ি চালাচ্ছে রাতের ঢাকা শহরে, নিলয় যে প্রচন্ড রেগে আছে সেটা নিরুপমা ভাল করেই টের পাচ্ছে।নিলয় এমনিতে অনেক শান্ত আর ঠান্ডা মেজাজের ছেলে।কিন্তু রেগে গেলে প্রচন্ড ভয়ানক হয়ে যায়।হঠাত নিরুপমার মনে হল ভার্সিটির সেই নেতা বড় ভাইয়া টার কথা।নেতা বলে অনেক  মেয়েকেই রাজনীতিতে যোগ দেবার নাম করে ভোগ করে।অনেক মেয়েকে প্রেগন্যান্ট করে পলিটিকাল প্রেসার দিয়ে ভার্সিটি ছাড়তে  আর বাজে কমেন্ট করার রেকর্ড ঊনার ঝুলিতে আছে।যেহেতু ক্ষমতাশীন দলের নেতা তাই কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।সেদিন কিভাবে যেন নিরুপমা ওনার সামনে যায় আর নিরুপমা মাশাল্লাহ সেই লেভেলের আগুন ঝরা সুন্দরী তাই ওই নেতা নিরুপমাকে ডেকে নিয়ে রাজনীতি তে যোগ দেবার কথা বলে, বাজে প্রস্তাব দেয়।নিরুপমা না করলে নিরুপমার সাথে অনেক খারাপ আচরন আর বাজে কথা বলে, তোকে পরে দেখে নিবো বলে থ্রেড করে।
..
...
কথা টা কোন না কোন ভাবে নিলয়ের কানে যায়।যদিও নিরুপমা নিলয়কে না জানানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।সেদিন ঐ নেতার পলিটিকাল মিটিং চলছিল ৩ তলার অডিটোরিয়াম রুমে।নিলয় প্রচন্ড রেগে সেখানে গিয়ে তার কলার ধরে টানতে টানতে ভবনের নিচে মাঠে নিয়ে এসে কোন কথা না বলে বেধরক পেটাতে থাকে। ততক্ষনে ওই নেতার সাঙপাঙ দিয়ে মাঠ ভর্তি সবাই নিলয় কে পেটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখনো নিলয় ঐ ভাইয়া পিটিয়েই যাচ্ছে পরে নিলয়ের বন্ধুরা এসে তাকে থামায় ততক্ষনে ওই ভাইয়ার অবস্থা বেগতিক, তাকে  হাসপাতাল নিতে হবে। আর তখনি নেতার সাঙপাঙরা নিলয়ের উপর চড়াও হতে চাইলে নিলয় বললো, আমার ওর (নেতা) সাথে ব্যক্তিগত সমস্যার কারনে ওকে পিটিয়েছি।তাই সাবধান করছি ভুলেও কেউ আমাকে মারতে আসবেন না।ফল ভাল হবে না।নিলয়ের রক্ত বর্ন চোখ দেখে তারা কিছু বলার সাহস পায় নি কারন নিলয় ক্যাম্পাসে কখনোই এমন করেনি।
..
...
যে ছেলে কখনো কাউকে একটু উচ্চ স্বরে কথা বলে না তার এই রুপ দেখে নিরুপমা ও ভয় পেয়ে যায়।
তারপর নিলয়ের বন্ধুরা ঐ নেতার সাঙপাঙ দের সব খুলে বললে তারা ওই নেতা কে নিয়ে হাসপাতালে যায় আর প্রায় ১মাস হাসপাতালে তাকে থাকতে হয়েছিল। মিনিমাম ৫-৬যায়গায় মেজর ফ্রাকচার হয়েছিল। পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ঐ নেতা নিরুপমার কাছে মাফ চেয়ে নেয়।
..
...
(৫)
..
...
গাড়ি থামতেই নিরুপমার ঘোর ভাঙে।দেখে নিলিমা কোলে ঘুমাই পড়েছে।গাড়ি উপর Upoma বাসার সামনে। মানে তারা উত্তরা ১০ নং সেক্টরে।
নিরুপমা কলিংবেল চাপে দরজা খুলে উপমার ননদ। নিরুপমা জিজ্ঞেস করে উপমা আছে কিনা।তখন উপমার ননদ বলে ভাবি তো সন্ধ্যার পর ভাইয়ার সাথে শপিং এ বের হইছে।অনেক দিন পর ভাইয়া আজকে বাড়িতে ছিল তো তাই।
নিলয় নিরুপমার দিকে রেগে তাকায়।মানে ফোন দিতে বলে উপমা কে।নিরুপমা উপমাকে ফোন দেয়।উপমা ফোন রিসিভ করে বলে যে তার আসলে মনে ছিল আজ নিরুপমার বিবাহ বার্ষিকী কিন্তু আজ অনেক দিন পর তার স্বামী ফ্রি ছিল তাই তাকে একটু সময় দিতেই তার সাথে শপিং এ বের হইছে।হাজার হোক স্বামী বলে কথা একটু একান্ত সময় তো দিতেই হয়।তাই আর নিরুপমার বিবাহ বার্ষিকীতে  এবার সে আসতে পারবে না।
নিরুপমা চোঁখের পানি ফেলতে ফেলতে ফোন টা পার্সে রেখে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়, উপমার ননদ বাসায় বসতে বললে নিরুপমা বলে অন্য একদিন বসবে।
নিরুপমা গাড়িতে বসে নিলয় আবার চালানো শুরু করে।
..
...
নিরুপমা চোঁখ বন্ধ করে নিলয়ের কাঁধে মাথা রেখে ভাবতে থাকে। এই উপমা তাকে বলেছিল,
"দোস্ত তোর সব দোষ আমার কাছে মাফ,
তুই চাইলে দিতে পারি কলিজার হাফ"
আজ নিরুপমার বিবাহ বার্ষিকী তে তাকে দেবার মত এক ঘন্টা সময় নেই এই উপমার।আচ্ছা আমার কথা বাদ উপমা তো নিলয়ের সেই ভক্ত ছিল। আমরা সবাই কোন কিছুতে না করলে যদি নিলয় হা বলতো তবুও সে রাজি হয়ে যেত।আজ তো নিলয়ের ও বিবাহ বার্ষিকী। তবুও তার সময় নাই? আচ্ছা এই কি সেই উপমা যে কিনা নিজের হাতে নিরুপমা কে বিয়ের সাজ সাজানোর জন্য কনে চুরি করেছিল।মানে অন্য কনে সাজানোর ঘরে সব বান্ধবীরা থাকতো আর নিরুপমা কে সবাই একটু একটু করে সাজাবে কিন্তু উপমা সেটা হতে দিবে না সে একাই সাজাবে।তাই নিরুপমা কে চুরি করে অন্য রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে একাই সাজিয়েছিল।
আজকের এই উপমা আর সেদিনের সেই উপমা।
অনেক বদলে গেছে জীবন।
..
...
(৬)
..
...
আবার গাড়িতে ব্রেক কষলো নিলয়। মানে আবার কোথাও এসেছে। বাড়িটা নিরুপমা চিনে না।কিন্তু এটা গুলশান এলাকা।দরজায় কলিংবেল চাপতে বললো নিলয়। কলিংবেল চাপতেই Keya এর স্বাশুরি বের হয়ে আসলো। নিরুপমা ওনাকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেয়া আছে কি?
উনি বললেন নাতো মা, কেয়া আর উনার ছেলে কাল কে ওনার ছোট ছেলে বউয়ের বাসায় গেছে।কয়েকদিন থেকে আসবে।আসলে কেয়ার স্বামীর ছোট ভাইয়ের নতুন বিয়ে হয়েছে তো তাই নতুন সংসার গুছিয়ে দিয়ে আসবে আর কি..
নিরুপমা কেয়া কে ফোন দিল।কেয়া তো ফোন পেয়ে অনেক খুশি। বললো দোস্ত কেমন আছিস? আজ অনেক দিন পর ফোন দিলি।বাড়ির সবাই কেমন আছে? তোর মেয়ে নিলীমা মামনি কেমন আছে?
নিরুপমা কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো সবাই ভাল।আর তোর কি খবর? কেয়া বললো আমিও ভাল। আচ্ছা আমার নতুন বাসায় আসিস একদিন গুলশান এ।
নিরুপমা মৃদু হেসে ফোন রেখে দিল।কেয়ার মনেই নেই আজ নিরুপমার বিবাহ বার্ষিকী।
নিরুপমা আবার চুপ করে গিয়ে গাড়িতে বসলো নিলীমাকে কোলে নিল।
নিলয় গাড়ি চালাতে লাগলো।
..
...
নিরুপমা ভাবতে পারছে না যে কেয়ার মত মেয়ের তার বিবাহ বার্ষিকীর কথা একটুও মনে নেই।এই কেয়াই কিনা বলতো সবসময় যে, নিরুপমা প্রেম করছিস ঠিক আছে, বিয়ে করবি ঠিক আছে কিন্তু বিয়ের পর আমাকে ভুলে গেলে চলবে না জানু।প্রতি বছর খবর মা দিলেও তো বিবাহ বার্ষিকীর দিনে তোর বাসায় পৌছে যাবো। সারা বাড়ি সাজাবো আর পার্টি দিবো, কেক কাটবো, তোর সাথে নাচবো সারারাত, ঐ রাতে তোর স্বামী মানে নিলয় বেচারাকে একাই ঘুমাতে হবে।কারন সেদিন সারারাত তুমি আমার কাছে থাকবা জানু।আর নিলয় কি কি করছে সারা বছর সব বলবা।কিভাবে আদর দেয় সেগুলোও বলবা। কারন আমি তো তোমার প্রথম স্বামী জানু..... আমাকে এসব বলা যাবে।নিরুপমা লজ্জায় লাল হয়ে যেত।আর আজ সেই কেয়া।সব হারিয়ে গেছে আজ সব স্মৃতি।
..
...
নিলয় রাগে গজ গজ করছে আর গাড়ির স্পিড বাড়াচ্ছে।রাতের ঢাকার রাস্তা অনেক টাই জ্যামহীন।সোডিয়াম আলোয় নিলয়ের রাগে মাখা পুরুষালী চেহারা দেখে নিরুপমা নিলয়ের প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।
নিলয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিরুপমা, নিলয়ের সেদিকে খেয়াল নেই।নিলয় রাস্তায় দেখে গাড়ি চালাচ্ছে।
এবার বনানীর মেইন রোডের সাথেই একটা বড় বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করলো। তারপর হাত ধরে ২য় তলার ফ্লাটে নিয়ে ডোর বেল চাপলো। Mukta এর ছোট দেবর দরজা খুলে দিল।আসলে ছেলেটি মুক্তাদের সাথেই থেকে লেখাপড়া করে ঢাকায় আর নিরুপমা কে চিনে।নিরুপমার অনেক বড় ফ্যান সে।তাই নিরুপমা কে দেখে অনেক খুশি হয়ে গেল। নিরুপমা জিজ্ঞেস করলো মুক্তা কই?
ছেলেটি বললো ভাইয়া আর ভাবি তো আজকে আব্বু আম্মুর কাছে গেছে বিকেলে। আব্বু আম্মু কে মনে হয় ঢাকায় নিয়ে আসবে।
..
...
নিরুপমা কে আবার ফোন দিতে  বললো মুক্তা কে নিলয়। নিরুপমা না দিতে চাইতে চাইতেও ফোন দিল।মুক্তা সবসময় অনেক হাসিখুসি স্বভাবের মেয়ে।তাই ফোন রিসিভ করেই অনেক খুশি হয়ে নিরুপমা কে অনেক গুলো প্রশ্ন করলো। নিরুপমা সব কথা শেষে জানতে চাইলো?  মুক্তা তুই আমার বিবাহ বার্ষিকীর তারিখ টা মনে আছে তো?
মুক্তা বললো  অফ কোর্স জানু... এই তো জুলাই ২৩ তারিখে তাই না??
নিরুপমা কান্মা চেপে ধরে রেখে বললো হা  হা মনে থাকে যেন... ভুলে যাস না আবার।মুক্তা হেসে বলে ঊঠলো আরে জানু, আমার জানুর বিবাহ বার্ষিকী আর আমি ভুলবো? এটা আবার হয় নাকি??
নিরুপমা কিছু না বলে ফোন টা কেটে দিল।আজ প্রথম মনে হল তার বিয়ে জুলাই ২৩ শে হইছিল আর সেটা সে নিজেই জানে না... হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে।
..
...
নিরুপমা গাড়িতে গিয়ে বসলো আর মনে করতে লাগলো ক্যাম্পাসের সেই দিনের কথা যেদিন মুক্তার বার্থডে সে সারপ্রাইজ প্লান করার জন্য নিরুপমা শেষে উইশ করবে।তাই এমন ভাব করে ছিল যেন সে মুক্তার বার্থডে ভুলে গেছে।মুক্তার সে কি অভিমান।শেষে মুক্তার মান ভাঙাতে সন্ধ্যার সারপ্রাইজ বিকেলেই দিতে হয়েছিল আর তাকে বুঝানো গেছিল যে নিরুপমা তার বার্থডে ভুলে নাই। মুক্তা সেদিন ও বলছিল যে নিরুপমা তোর বিয়ে হলে তোর প্রতি বিবাহ বার্ষিকী তে আমি তোকে এভাবেই সার প্রাইজ দিবো।হ্যা আজ মুক্তা সারপ্রাইজ ঠিক ই দিল। সেটা নিরুপমা বিবাহ বার্ষিকীর তারিখ চেঞ্জ করে...
বিবাহ বার্ষিকীর সারপ্রাইজ বিবাহ বার্ষিকী ভুলে যাওয়া....
..
...
(৭)
..
...
নিলয় গাড়ি চালাতে লাগলো। নিরুপমা ভাবছে।নিলয়ের পরিবর্তন গুলো।এই সেই ছেলে যে তার সামনে ভেজা বেড়ালের মত চুপসে থাকতো আর আজ সেই ছেলে তাকে ঝাঁঝালো গলায় এত্ত গুলো কথা শুনালো।আসলে নিলয় আর তাকে আগের মত ভালবাসে না।আচ্ছা আমার তো একটা স্বপ্ন ছিল। আমার সব বান্ধবীরা জব করছে। নিজের জীবন নিয়ে বিজি।আর আমি? একাই আমিই শুধু বাসায় বসে আছি। মাঝে মাঝে মনে হয় কি দরকার ছিল এত ভাল রেজাল্ট এর, এত গুলো সার্টিফিকেট নামক কাগজের টুকরোর....??
সেই বার নিলয় কে বললাম নিলয় আমি একটা জব করি?
নিলয় বললো আচ্ছা দেখি কি জব করা যায় তোমার জন্য।সেই থেকে প্রায় ২বছর হয়ে গেল আমার জব আর করা হল না।
..
...
আচ্ছা নিলয় তো বিয়ের আগে আমার সব ইচ্ছা পুরন করতো।আর বিয়ের পর মাত্র একটাই ইচ্ছা করেছিলাম সেটা হল আমি একটা জব করবো সেটা ২বছরেও পুরন হয়নি। অথচ এই সেই নিলয় যে কিনা গ্রাম থেকে ৮০০ কিলোমিটার রাস্তা পার করে আমার ইচ্ছে পুরন করতে আমার কাছে এসেছিল।ব্যাপার টা এমন ছিল যে আমি সন্ধ্যে  ৮টার দিকে ফোন দিয়ে নিলয় কে বলি তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।তখন ভার্সিটি ছুটি ছিল তাই নিলয় তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল কয়েকদিন আগেই।তাই নিলয় বললো এখন কিভাবে দেখবা বিল্লি?  ঢাকায় যাই আগে তখন দেখিও।আমি জেদ করে বললাম আমি তোমাকে সকালে ঘুম থেকে ঊঠেই দেখতে চাই।সেই বার সত্যি সত্যি সকাল বেলা ঘুম থেকে ঊঠে দেখে সে আমাদের বাসার বাইরে গেটের সামনে দাড়িয়ে। সেদিন প্রথম নিলয় কে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেলেছিলাম। নিলয় আমার সাথে কথা শেষ করেই বাসে ঊঠে পরে আর সকালে আমার বাসার সামনে আমার সাথে দেখা করেই পরের বাসে গ্রামে ফিরে যায়।
..
...
সেই নিলয়কে আর আমি খুজে পাই না।এখন আমি পুরোনো হয়ে গেছি হয়তো তাই আমার ইচ্ছে গুলোর আর মুল্য তার কাছে নেই...
এখন সে অনেক বড় ব্যবসায়ী সারা দেশে যার নাম ডাক।কিন্তু আমি যে আমার নিলয় কে চাই।
ভাবতে ভাবতেই নিরুপমার চোখের কোনে পানি জমে যায়।নিলয়ের সেদিকে নজর নেই।আর আগে নিলয় কখনোই নিরুপমা কে কাঁদতে দিত না আর নিরুপমা কাঁদলেও নিলয় তার চোঁখের পানি মাটিতে পড়তে দিত না।হাতে ধরে খেয়ে ফেলতো।
আর আজ, আমার কান্না নিলয়ের চোখেই পড়ছে না......
..
...
(৮)
..
...
গাড়ি নিরুপমাদের বাসায় এসে থামলো, নিলীমা তখনো ঘুমে।তাই নিলয় অনেক রেগে নিরুপমা কে বললো যাও নিলীমা কে রুমে শুয়ায় রেখে ছাদে আসো।কথা আছে তোমার সাথে।
নিরুপমা কিছুই বলতে পারছিল না,তাই চুপ চাপ নিলীমা কে রুমে নিয়ে গেল।আর নিলয় ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেস হয়ে ছাদে গেল।
ততক্ষনে রাত ১১:৪০বাজে.....
নিরুপমা নিলিমা কে রুমে শুয়ায় ফ্রেস হতে যায়।তার আগে নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে নেয় নিলয়ের ঝাঁঝালো কথা শুনার জন্য।
...
...
কিছুক্ষন পর নিরুপমা ছাদে আসে।কিন্তু ছাদের দরজা লাগানো।একটু জোরে ধাক্কা দিতেই দরজা টা খুলে যায়।
পুরো ছাদ টা অন্ধকার। হঠাত করে একটা স্পট লাইট জলে ঊঠে। দেখে রুনা হাতে প্লাকার্ড নিয়ে দাড়িয়ে আছে তাতে লিখা "শুভ"....
.
তারপর আরেকটা লাইট জলে ঊঠে সেখানে উপমা
হাতে প্লাকার্ড তাতে লিখা "পঞ্চম"....
.
আবার একটা লাইট জলে ঊঠে এবার কেয়া। হাতে প্লাকার্ড তাতে লিখা "বিবাহ"....
.
এইবার চতুর্থ লাইট টা জলে উঠিতেই মুক্তা কে দেখা গেল। হাতে প্লাকার্ড তাতে লিখা "বার্ষিকী"
.
এইবার শেষ বার মানে পঞ্চম স্পট লাইট টা জলে উঠে নীল আলোয়...। আর সেখানে মিয়াও দাড়িয়ে হাতে প্লাকার্ড
তাতে লিখা "বিল্লি"
এবার পুরো ছাদে অনেক গুলো ঝারবাতি জলে ঊঠে একসাথে আর সেই সাথে সবাই একসাথে চিৎকার বলে ঊঠে
.
"শুভ পঞ্চম বিবাহ বার্ষিকী বিল্লি"
.
..
...
নিরুপমা এতক্ষনে বুঝতে পারে এগুলো সব নিলয়ের প্লান ছিল।আর নিলয়ই তার খুশির জন্য সবাইকে এনেছে বাসায়।আর এইসব সাজানোর জন্য তাকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যায়।
..
...
এই বার সবাই মিলে কেক কাটতে যায়।নিরুপমা কেক কাটছে কিন্তু কেকের মাঝ খানে ছুড়ি টা আটকে গেছে। নিরুপমা একটু জোর দিয়ে টানতেই ২টা চাবি বের হয়ে আসে কেকের ভিতর থেকে।তখন নিলয় চাবি ২টা হাতে নিয়ে নিরুপমার সামনে হাটু গেড়ে প্রপোজ করে আর বলে ভালবাসি আমার বিল্লি টাকে...
আর আমার বিল্লি টা নাকি জব করবে?
তাই এই যে এই চাবিটা হল আমাদের গুলশানে একটা নতুন ব্রাঞ্চ খুলেছি সেখানে আমার বিল্লি টা জব করবে।
পদ টা হল M.D.....
.
আর এই চাবি টা হল আমার নিরুপমার নিজের কার।যেটাতে করে প্রতিদিন অফিস করতে যাবে।
..
...
নিরুপমা এবার নিলয় কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো আর বললো এত কিছু করলে একটু বললে না কেন?
নিলয় তখন বললো
তুমি বলে ছিলে??
আমার নিলীমা যখন ৬মাস তখন আমাকে বলেছিলে যে আমি নিলীমার "বাবাই" হতে যাচ্ছি.....
আমার জীবনের বড় সারপ্রাইজ ছিল সেটাই।
আর সেটা কতদিন পর বলছিলা আমাকে??
তাই আমিও আজ সকাল থেকে রুনা,  উপমা, কেয়া, মুক্তা সবার বাসায় গিয়ে সবাইকে প্লান বুঝাই দিয়ে এসেছি।
..
...
আর আজকে সারাদিন তোমাকে এত রাগ দেখানোর জন্য স্যরি......
তোমার স্যরি গ্রহন করা হল কিন্তু এদের,  রুনা, উপমা,  কেয়া, মুক্তা তোদের স্যরি গ্রহন করা হবে না।কারন তোরা আমার ফ্রেন্ড হয়ে আমাকে কান্দাইছিস.....
তোদের কোন মাফ নাই...
কেন জানু.....
তুমি কেমনে ভাবতে পারলা যে আমরা আমাদের সবার একটা কলিজার টুকরার বিবাহ বার্ষিকী ভুলবো......
.
এটা বলতেই  রুনার, উপমার,কেয়ার, আর মুক্তার স্বামীরা একসাথে নিলয়ের সাথে হো হো করে হেসে উঠলো আর বললো হাজার বছর তোমরা এভাবেই থাকো.....
...
......
চলুক তাদের মান অভিমানের ভালবাসা.....
.
.
dedicated: Roukeya Binta Reza Rain (বিল্লি)
৩০ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে