মাসকাওয়াত আহসান : ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নাম এখন থেকে ‘বাংলা’। ইংরেজিতে যার উচ্চারণ হবে ‘বেঙ্গল’ এবং হিন্দিতে ‘বাঙ্গাল’। অপেক্ষা শুধু কেন্দ্র সরকারের অনুমোদনের। ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুলেছে দুই দেশের মানুষকেই। কলকাতার কিন্ডারগার্টেনের শিশুরা আলোচনা করছে, যা বাবা একটা সাবজেক্টের নাম স্টেটের নাম হয়ে গেলো; পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসবে কে জানে!
এক ডেঁপো শিশু বলে, হয়তো মমতাময়ীর কবিতাই পড়তে হবে। উনিই যেহেতু সাবজেক্ট আর স্টেটকে এক করে দিলেন। একটি চশমা পরা পনেটিল করা শিশু বলে, শুধু সাবজেক্ট বলছো কেন; এটা তো একটা ল্যাঙ্গুয়েজ। ল্যাঙ্গুয়েজ আর স্টেট কী এক জিনিস!
সাঁঝে বাড়ী ফিরে জি’বাংলা টিভি চ্যানেল দেখে একটি শিশু হেসে কুটিপাটি হয়।
: মাম্মী দেখে যাও স্টেটের নামের আগে জি লাগিয়ে দিয়েছে।
হঠাৎ দেখা যায় পর্দাজুড়ে এক গান-অলা গানের চেয়েও মিষ্টি করে বলছেন, মমতাময়ী তো দেবী; ৩০০ বছর পর উনার নামে মন্দির হবে; মানুষ এসে উনার মূর্তিতে অর্ঘ্য দেবে। তাই উনি যখন বলছেন অন্য কারো আপত্তি করা ঠিক হবে না। দেবী যখন বলছেন, এ রাজ্যের নাম বাংলা; তবে তাই হোক।
শিশুটির দাদা খিল খিল করে হেসে বলেন, দাদু ভাই আমি তো সেই যশোর থেকে এইসেছি; তাই আমাকে বাঙ্গাল বলে টিটকারী দিয়েছে কতজন। এখন তো দেইখতেছি এ রাজ্যকে হিন্দীতে বাঙ্গাল বইলে ডাকবে। পুরো বসার ঘর জুড়ে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
ওদিকে সাঁঝের দিকে কার্তিক গিয়েছে তার সান্ধ্যকালীন খুশীজল সংগ্রহ করতে। প্রতিদিনের মতো ক্যাশে বসা লোকটাকে টাকা এগিয়ে দিয়ে বলে, ও দাদা একটু বাংলা দেবেন।
ক্যাশাবাবু মুচকি হেসে বলে, ১৪০ টাকায় একটা পুরো রাজ্য কিনতে চাইছেন; সাহসের বলিহারি।
ওদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কজন পন্ডিত মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন।
একজন অধ্যাপক বলছেন, এ রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ হচ্ছে; যাকে ইংরেজিতে বলা হবে বেঙ্গল। ওদিকে আবার যুগের পর বাংলা ভাষাকে ইংরেজিতে বেঙ্গলি বলা হয়। এই জায়গায় একটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
আরেকজন অধ্যাপক বলেন, এখন এ রাজ্যে মমতাময়ী দেবী যা বলবেন ওটাই নিত্যসত্য। দেখুন না এই “বাংলা” নামটাকে যৌক্তিকতা দিতে তেলের শিশি নিয়ে কিছু শিল্পী-সাহিত্যিক নেবে পড়েচেন জি’বাংলা টিভিতে। জি’বাংলা শুনে সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠেন।
ওদিকে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে এক সংগীত শিল্পী চোখ মুঁদে গান গাইছেন, আমি বাংলার গান গাই।
কয়েকজন দর্শক উত্তেজিত হয়ে ওঠে, আপনি ভারতের একটা রাজ্যের প্রশংসা করে গান গাইছেন কেন; ভারতপ্রীতির একটা সীমা থাকা উচিত।
শিল্পী তখন ঘাবড়ে গিয়ে গান ধরেন, আমি বাংলাদেশের গান গাই।
একজন দর্শক বলে, হ এইবার ঠিক আছে।
এক অত্যন্ত বিচক্ষণ জিপিএ গোল্ডেন ফাইভ পাওয়া তরুণ বাংলা একাডেমির সামনে দিয়ে যাবার সময় মা’কে জিজ্ঞেস করে, এটা কী ভারতের ‘বাংলা’ রাজ্যের কনস্যুলেট!
মা বলেন, ওসব পলিটিক্যাল চিন্তা করতে নেই; তোমাকে “আই হেইট পলিটিক্স” জেনারেশান হতে হবে। ইনশাল্লাহ সামনে বছর তোমাকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দেবো।
বাংলা বাজারের বইয়ের দোকানগুলোতে ভীষণ টেনশান নেমে আসে। স্বাভাবিকভাবেই কলকাতার বইপুস্তকও সেখানে আছে। পাছে সবাই এটাকে ভারতীয় বাজার ভেবে ফেলে কিনা।
আর যারা জিহাদী বই বিক্রি করে সেসব বইয়ের দোকান রীতিমত “অনুভূতি” আঘাত প্রাপ্ত হয়। ভারতের একটা রাজ্যের নামে বইয়ের বাজার; এ হতে পারে না। দোকানীর চোখের দুপাশ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। একজন আক্ষেপ করে বলে, আহারে ওরা খিলাফতী বাংলা ভাইয়ের নামডাও নিয়া নিলো।
সর্বত্র এক বাংলা বিভ্রাট ছড়িয়ে পড়ে। টিভিতে বাংলা গানের আসরের উপস্থাপিকা বলেন, চিন্তা করবেন না, এ অনুষ্ঠানের গানগুলো সব বাংলাদেশের।
আন্তর্জাতিক রেডিওর বাংলা সার্ভিসগুলো বিপদে পড়ে যায়। এমনকি দ্বিভাষিক অনলাইন পত্রিকাগুলোতে ওপরে লেখা থাকে বাংলা সংস্করণ। সাংবাদিকেরা চিন্তায় পড়ে যায়; পাঠক যদি ভেবে বসে এটা ভারতীয় মাধ্যম। বাংলা রাজ্যের খবরই শুধু আছে এতে।
বাংলাদেশের কিছু বিশেষজ্ঞ টিভি টকশোতে গোঁ ধরে বসেন, পশ্চিমবঙ্গের নাম বাংলা হলে বাংলাদেশ নামটির কপিরাইট ভঙ্গ হয়। তাছাড়া জাতীয় সংগীতের মধ্যে বাংলা শব্দ রয়েছে। জয় বাংলা শ্লোগানেও বাংলা আছে।
প্রতিপক্ষের জাস্টিফিকেশান ঘরানার টকাররা বলেন, দেশে এমনি প্যাঁচের অভাব নাই; এখন নতুন প্যাঁচ দিয়েন না। নামে কী আসে যায়; হোয়াট ইজ নেম! আপনারা কী রামপালের বিপক্ষের শক্তি!
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়েস্ট বেঙ্গলের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে ফোন করে বলেন, ‘বাংলা’ নামটা একটু পুনর্ভাবনা করা যায় কিনা।
দিদি ক্ষেপে ওঠেন, প্রত্যেকটা কেন্দ্রীয় বৈঠকে ওয়েস্ট বেঙ্গলের মুখ্যমন্ত্রী ‘ডব্লিউ’ এলফাবেট শেষে থাকায় এমন সময় বক্তব্য রাখার সুযোগ পায়; যখন অন্য সবাই বক্তব্য শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাংলা নামটা হলে আমার এই ভোগান্তিনাশ হবে। তাই পৃথিবী উলটে গেলেও আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে নড়ছি না।
: কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নামটি ১৯৭১ সালে স্বাধীন হবার পর থেকে প্রতিষ্ঠিত। তাই ওয়েস্ট বেঙ্গলের নাম বাংলা রাখাটা অসৌজন্যমূলক হয়ে যায়।
দিদির রাগ সপ্তমীতে চড়ে যায়, আপনি ইতিহাসের কী জানেন! বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মহান অধিপতি সিরাজউদ্দৌলার বাড়ী হাজারদুয়ারী আমার বাংলায় অবস্থিত। আপনি বরং আমাদের ভাগের বিহার-উড়িষ্যাটা আমাকে বুঝিয়ে দিন।
লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক ও বিতার্কিক
[পাঠকই লেখক কলামে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। এমটিনিউজ লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে এমটিনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে। তাই এখানে প্রকাশিত মতামতের জন্য এমটিনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় গ্রহণ করবে না।]
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি