সবুজ আলম ফিরোজ: সেলফি নামক শব্দের সাথে আমরা সবাই বেশ পরিচিত। সেলফি মানে তো হালকা আঙুলের ছোঁয়া। ফ্রন্ট ক্যামেরায় এক ক্লিকেই ছবি। বন্ধুদের সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়া অথবা একাকী নির্জনে বসে থাকা। আনন্দ-উল্লাস, হাসি-কান্না, বিদায়-অভিবাদন যে কোন মুহূর্ত ধরে রাখতে মোবাইলে স্কিনে এক ক্লিকেই তোলা হচ্ছে সেলফি। তারপর ফেসবুকে দেওয়ালে আলতো ভাবে আপলোড। ব্যাস। লাইক, কমেন্টেস, অ্যাকশন।
সেই অ্যাকশনে দুনিয়া জেনে গেলো আপনার কারেন্ট স্ট্যাটাস। কী করছেন? কোথায় আছেন? কেমন আছেন? সবই জেনে গেলো আপনার ফেসবুক বন্ধুরা। সেলফি অ্যাকশনের জ্বরে ভুগছে আজ গোটা বিশ্ব। আর এই অ্যাকশনের সেলফিতে রয়েছে মৃত্যুর ফাঁদ। রাস্তাঘাটে, রেস্তোরাঁয়, শপিং মলে, রেললাইনে, ব্রিজের ওপরসহ ভয়ংকর জায়গাতেও সেলফি তুলছে সেলফি প্রেমিকরা।
তবে বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সেলফি তোলার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এমনকি এটা অনেকের ক্ষেত্রে সেলফি আসক্তি বা ব্যাধির পর্যায়ে চলে গেছে। এমনও দেখা যায়, সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় থেকে দিনের সকল কাজ এবং রাতে ঘুমুতে যাওয়া পর্যন্ত যত ঘটনা সবই ঘণ্টায় ঘণ্টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করে কেউ কেউ।
ঘুম থেকে জেগে বিছানায় শুয়েই সেলফি তুলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় ‘শুভ সকাল বন্ধুরা’। এরপর- এখন হাত-মুখ পরিষ্কার করছি, নাস্তা সারছি। অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। এই মাত্র অফিসে পৌঁছলাম। এমনভাবে সারাদিনের কর্মকাণ্ড সেলফির মাধ্যমে ফেসবুক, টুইটারে পোস্ট করে জানান দেয় বন্ধুদের।
এছাড়া সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সেলফি টনিক হিসেবে ব্যবহৃত করছে ছোট-বড় সব শ্রেনির মানুষ। নিজেকে ‘হিরো’ হিসেবে উপস্থাপন করতে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ সেলফি তোলার হিড়িক। এর জন্য কেউ কেউ নিচ্ছে ভয়ংকর সব চ্যালেঞ্জ, পরোয়া করছে না মৃত্যুকেও। তাই সেলফি শুধু আনন্দের প্রিয় মুহূর্তগুলোকেই ধরে রাখছে না, ঠেলে দিচ্ছে শোকের-মৃত্যুর দিকেও।
মৃত মানুষের সঙ্গেও সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিয়েছে কিছু তরুণ। মৃত নানার সঙ্গে সেলফি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দিয়েছে তিন কিশোর, যার ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘যাকে নিয়ে এত মজা করতাম, যাকে ঘিরে ছিল আমাদের হাসি-খুশি, যার সঙ্গে কথা না বলে থাকতাম না, সে হলো আমাদের নানা। তিনি আর নেই। চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। আমরা তোমায় ভুলব না। মিস ইউ সো মাচ নানাভাই’। এটা নিছক কোন কল্পকাহিনী নয়।
ঘটনাটি ২০১৫ সালের নভেম্বরে আমাদের এই বাংলাদেশেই ঘটেছে। সেখানে দেখা যায়, মৃত নানাকে ঘিরে বিচিত্র মুখের ভঙ্গিমায় পোজ দিয়েছে ওই কিশোরেরা। তবে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। তখনকার সময় এই পোস্টটি ফেসবুকে ভাইরাল ছিল। প্রশ্ন উঠেছে তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষা নিয়ে।
শুধু এখানেই শেষ নয়। সেলফি নিয়ে ঘটছে নানান ধরনের ঘটনাও। প্রেমিকার সেলফি পছন্দ না হওয়ায় তাঁকে খুন করে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিয়েছে খোদ প্রেমিক। শুধু সেলফি তুললেই হবে না। নিজেকে আকর্ষণীয় রূপে হাজির করতে জানতে হবে তোলার স্টাইল বা এর নানামুখী ব্যবহারের। তরুণ প্রজন্মের কাছে এর বেশ গুরুত্বও রয়েছে।
এ কারণে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও চালু করেছে সেলফি তোলা-বিষয়ক কোর্স। বৈচিত্র্য আনতে নানান রকম মুখভঙ্গিও আবশ্যক সেলফিতে। ছোট একটা ঘটনা বলে আজকের লেখা শেষ করবো, গত বছর নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় চলন্ত বাইকে সেলফি তুলতে গিয়ে পিকআপের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তিন বন্ধু ঘটনাস্থলে মারা যায়।
তবু থেমে নেই সেলফি তোলা। থেমে থাকার কোনো কারণও নেই। তবে কথা একটাই সেলফিটি যেন শেষ স্মৃতি না হয়ে যায়! সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে আমাকে আপনাকেই সবাইকে।
সবুজ আলম ফিরোজ
সাংবাদিক
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/ফিরোজ/এফএ