ফজলুল করিম : তিনটি ধর্মের তীর্থস্থান, হাজার কোটি মানুষের স্বপ্নের ভূমি, নির্যাতিতদের জন্মভূমি, সেই আল আকসা বা আল কুদস আজ একটি বিশেষ জাতির নিকট শিকলাবদ্ধ। ইতিহাসের নানা চড়াই উৎরাই লেগেছে এর পবিত্র পিঠে। তবুও হারায়নি আকর্ষণ। বরং নানা রুপে গুণে মহিমান্বিত হয়েছে। কখনো হয়েছে ঐতিহ্যের, কখনো ধর্মের, কখনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের। এর বুকে জন্মেছে অনেক মহৎ ব্যক্তি। তারা অতীতের নবী থেকে আজকের রানিতিসি, ইয়াসির আরাফাত, ইসমাইল হানিয়া, মাহমুদ আব্বাস, মাহমুদ দারবিশ ও নিজার কাব্বানিসহ আরো অনেকে।
সেই আল আকসা আজ পরাধীন। এর অধিবাসীদের একটি বড় অংশ আজ নির্বাসিত। অপর অংশের কিছু বিতাড়িত বা কারারুদ্ধ আর কিছু পরবাসীয়র জীবনযাপন করছে। যারা বাইরে তারা লড়াইরত। আজকের এ পরিস্থিতির জন্য শিকার এবং শিকারি উভয়ই দায়ী। এক্ষেত্রে যারা শিকার তাদেরকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে।
(১) মানুষ হিসেবে
(২) মুসলিম হিসেবে
(৩) আরব হিসেবে
(৪) প্রতিবেশী হিসেবে।
মানুষ হিসেবে গোটা মানব জাতি ব্যর্থ হয়েছে। এরা আবার দুই শ্রেণীর। এক শ্রেণী সবল ও অপর শ্রেণী দুর্বল। সবল শ্রেণী চাইলে এটি প্রতিরোধ করতে পারে। তারা কখনো মন থেকে এটি চায়না। এই না চাওয়ার জন্য তাদের বেশ প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছে। সুড়সুড়ি আছে এমন মানুষকে সুড়সুড়ি দিলে না হাসা, চরম সাধনার ফল। কেননা সুড়সুড়ি দিলে হাসা তার মজ্জাগত বিষয়। একজন সৈনিককে অনেক সাধনা করতে হয় সৈনিক হওয়ার জন্য। তা সৈনিক মাত্রই জানে, বুঝে। তাকে সাধারণ মানুষ থেকে সৈনিক বানানো হয়। সকল পেশার ক্ষেত্রে এখন তাই হচ্ছে। প্রচেষ্টা চালানো হয় মানবিক গুণাবলীর উর্ধে উঠানোর। মানবিকতা নয়, সবাই পেশাদারিত্ব চায়। যার কারণে ভুলকে ভুল, এবং অন্যায়কে অন্যায় বলা যায়না। যদি কেউ বলেও ফেলে, সেটি পেশাদারিত্বহীনতা হিসেবে বিবেচিত হয়। যার ফলে আজ মানুষ নয়, পেশাদার পাওয়া যায়।
জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন সমূহ থেকে শুরু করে একে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে গঠিত, মুসলিম জাতির সর্ববৃহৎ সংস্থা অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশান (ওআইসি) পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। তেমনিভাবে, মুসলিম জাতি, আরব জাতি ও নির্যাতিত মানুষদের প্রতিবেশী যারা তারাও ব্যর্থ হয়েছে।
অপরদিকে যারা শিকারি, তারাও তাদের অতীত ভুলে গিয়েছে। তারাও এই জনপদে মুসলিমদের সাথে রক্তগঙ্গায় ভেসেছিল। তারাও সেদিন মুসলিমদের মত দেশপ্রেমিক ও ধার্মিক ছিল। ক্রুসেড ঘোষিত হলে তারাও এই জনপদে সমানভাবে মার খেয়েছিল। আজ তাদের ভিন্ন চরিত্র। যালিম মাযলুম হওয়ার চেয়ে মাযলুম যালিম হওয়াটা বেশি ক্ষতিকর। এ ক্ষতিটা উভয়ের জন্য।
ফলশ্রুতিতে, সম্মান, গৌরব ও ঐতিহ্যের এ জায়গা সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। বিশ্ব পরিবারের সদস্য হিসেবে আমরা মর্মাহত। যারা মাতৃভূমি হারিয়েছে, তাদের কষ্ট আমাদের চেয়ে হাজার গুন বেশী। এক কালের দানকারী, আজ দানের আশায় দিন অতিবাহিত করে। রাজপ্রাসাদের মালিক আজ ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। এ পরিস্থিতি কত বিভীষিকাময়! যারা এ জনপদের রূপ লাবন্য দেখে বিমোহিত হোতো, তারা আজ অ্যাপাচি ও কামানের শব্দে বিচলিত। যেসব শিশুরা পিতামাতার আহ্লাদে ঘুম থেকে জাগার কথা, তারা আজ কামানের শব্দে কিংবা পিতামাতার ফিসফিসানির শব্দে খাটের নিচে লুকায়।
সেখানে শিল্প সাহিত্য চর্চার পরিবর্তে টানেল নির্মাণ শিল্প বেশ চর্চিত। কবিদের লেখা আনন্দ মিশ্রিত না হয়ে বেদনা মিশ্রিত। এ থেকে বাদ যায়নি ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ ও সিরীয় কবি কাব্বানিও। কাব্বানির ভাষায়-
Oh Jerusalem, the city of sorrow
A big tear wandering in the eye
Who will halt the aggression?
On you, the pearl of religions?
Who will wash your bloody walls?
Who will safeguard the Bible?
Who will rescue the Quran?
Who will save Christ,
From those who have killed Christ?
Who will save man?
يا قدسُ، يا مدينةَ الأحزان
يا دمعةً كبيرةً تجولُ في الأجفان
من يوقفُ العدوان؟
عليكِ، يا لؤلؤةَ الأديان
من يغسل الدماءَ عن حجارةِ الجدران؟
من ينقذُ الإنجيل؟
من ينقذُ القرآن؟
من ينقذُ المسيحَ ممن قتلوا المسيح؟
من ينقذُ الإنسان؟
এক কালের মিত্র, আজকের প্রবল আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে শুন্য হাতে লড়াই চালিয়ে যাওয়া ঈমানী দৃঢ়তা, বিস্ময় বা দেশপ্রেম হলেও তাদের প্রতিটা মুহূর্ত সংগ্রামমুখর ও অনিশ্চিত। এ অনিশ্চিত পরিস্থিতিকে নিশ্চিত করেই তাদের পথচলা। আজো তারা স্বপ্ন দেখে স্বাধীন জন্মভূমির। এ ভূমি তাদেরই। তারাই পারে সকল জাতিকে, ধর্মকে এবং গোষ্ঠীকে বুকের মাঝে আগলে রাখতে। সকল ঐশী ধর্মকে তারাই স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের ঐশীবানী, নবীদের মর্যাদায় তারতম্য করতে নিষেধ করেছে। বিজিত দেশে পরাজিতদের মর্যাদা ও অধিকার তারাই দিয়েছে। তাদের এ স্বপ্ন নিকট ভবিষ্যতে না হলেও হারিয়ে যায়নি। নতুন কিছু উদ্যোগ আশানুরূপ বা কার্যকর না হলেও আশাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। দু একটি রাষ্ট্র ব্যতীত কেউই তাদের পাশে দাড়ায়নি। এর চেতনাকে ধারণকারী ও আই সির আচরণ খুবই হতাশাজনক। এর রুপ আছে, দেহ আছে প্রাণ নেই।
তাদের অনৈক্য অগ্রযাত্রাকে বিলম্বিত করছে। এ অনৈক্য আবার সৃষ্টি করা। অর্থাৎ, কর্তার ইচ্ছায় কর্মের ন্যায়। মোড়লদের এ পলিসি শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়, তা আজ সমগ্র অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিটি সবল দুর্বলের উপর এ নীতি প্রয়োগ করছে। এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘আল কুদুস’ দিবস ঘোষিত হোলেও শিয়া – সুন্নির দ্বন্দ্বে তা আজ বিস্মৃত। এটি অনেকটা দেশী প্রবাদের ন্যায়। বউ ভালো হলে স্বামীর লাভ। আবার বউ খারাপ হলে দেশের লাভ। স্বামী সংসার ছেড়ে দার্শনিক হতে পারে। এ ব্যপারে ইমাম খোমেনীর একটি কথা খুবই ভালো লেগেছে। তিনি বলেছেন, যারা শিয়া- সুন্নির দ্বন্দ্ব করে, তারা শিয়াও নয় সুন্নিও নয়। বরং তারা সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল।
কথাটি ভাবুকগণ ভাবতে পারেন। তবে খিলাফাতের চেতনা ধারণকারী, সচেতন মুসলিমদের বীর নায়ক, নব্য সালাহুদ্দিন আইয়্যুবী এরদগান কিছুটা আশা জাগালেও তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেছেন, তিনি শিয়াও নন, সুন্নিও নন। বরং তিনি মুসলিম। আঞ্চলিকতার দ্বন্দ্বে উভয়ই কোরআনের শেখানো পরিচয় ভুলে গিয়েছে।
এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য যা করা দরকার তার দিকে শুধু কিছু ব্যক্তির নজর রয়েছে। মোড়লদের অধিকাংশই চায়না এ অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন। পৃথিবীর গতিধারায় এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবেই। তবে সেটি এখনো অনেকদূরে। কবি নজরুলের ভাষায় ‘চির দিন কাহারো সমান নাহি যায়’। অর্থাৎ, একটি সভ্যতা ধংশের পরই আরেকটি সভ্যতার শুরু।
লেখক : গবেষক
১৬ অক্টোবর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম