মুসা আল হাফিজ : রাত একটা, দশ। বালিশে মাথা। সেখান থেকে রোদন আর মানবতার কাতর কান্না শুনতে পাচ্ছি। নিদ্রা পলাতক। বিবেক বার বার প্রশ্ন করছে- তুমি কি মানুষ? তোমরা কি মুসলমান? না, আমি মিথ্যামুসলমান, আমরা মিথ্যামানুষ। আমাদের অস্তিত্ব মিথ্যা, বেঁচে থাকা মিথ্যা, আত্মপরিচয় মিথ্যা। কে বলে আমরা মানুষ? আমরা ঘাতক। আমরা রোহিঙ্গাদের ঘাতক। মানবতার খুনি।
আরাকানে মানবেতিহাসের সবচে’ ভয়াবহ জাতিগত গণহত্যা চলছে। যারা গণহত্যার শিকার, তারা মুসলমান না হলে কেউ ওদের মারার সাহস করতে পারতো না। কিন্তু এ হত্যায় লিপ্ত আছি মুসলিম নামের আমি, আমরাও! কারণ আমরা তাদেরকে হত্যা করছি না। কিন্তু কাওকে হত্যা করতে দিচ্ছি। কেউ খুন করে, কেউ খুন করতে দেয়, এভাবেই ঘটে সকল হত্যাকাণ্ড। আরাকানে গোটা এক জাতিকে খুন করায় এভাবেই ভূমিকা রাখছি, সকলেই। ভূমিকা রাখছি হেফাজত, জমিয়ত, চরমোনাই, খেলাফত, জামায়াত, তাবলিগ সহ সকলেই। এই ইমাম-মুয়াজ্জিন, এই ওয়ায়েজ-শ্রুতা, এই নেতা-কর্মী, এই পীর- মুরিদ, এই লেখক-পাঠক সকলেই।
হে ইসলামী দলসব! আরাকানে মুসলিম হত্যায় সহযোগিতা বন্ধ করুন। যতদিন আপনারা মিথ্যা বিবৃতি দিয়ে দায়সারার মধ্যে থাকছেন, ততদিন আপনারা সেই গণহত্যার অংশীদার থাকছেন।
ইউরোপে যদি সিরিয়ার আশ্রয়প্রার্থীদের স্থান দেয়ার জন্য আন্দোলন হয়, তাহলে বাংলাদেশে প্রাণ বাঁচাতে আগত প্রতিবেশি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য আন্দোলন হতেই পারে। কিন্তু এ জন্য আন্দোলন করতে হবে কেন, মাননীয় সরকার? এদেশে যখন বাঙালীদের উপর আর্য নিপীড়ন চলছিলো, তখন কি আরাকানে আশ্রয় পায়নি বাঙালীরা? এ দেশের কবি আলাওল থেকে নিয়ে অসংখ্য আশ্রয়প্রার্থীর জন্য রোহিঙ্গারা কি দুয়ার খুলে দেয়নি? কোরেশী মাগন ঠাকুর থেকে নিয়ে অসংখ্য বাঙালীর জন্য তারা কি উন্মুক্ত করে দেয়নি নিজেদের রাজসভা? আজ যে দুঃসময় তারা পাড়ি দিচ্ছেন, এমন এক দুঃসময় ছিলো বাঙালীদের জন্য সেন শাসনামল। তখন কি প্রাণ নিয়ে পালানো বাঙালীদের তারা গ্রহণ করেনি প্রাণজ মমতায়?
রোহিঙ্গাদের অপরাধ তারা মুসলমান। তাদেরকে খেদানো হচ্ছে। কারণ তারা বাংলাভাষী। সমভাষী, সমধর্মী, সমসংস্কৃতি ও সমঐতিহ্যের প্রতিবেশি মানুষ আশ্রয় চাইতে এসেছে ‘মানুষের’ দ্বারে, সেখানে তাদেরকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে তুলে দেয়া সেই নির্মমতার সমগোত্রীয়, যা বৌদ্ধ ঘাতকদের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে।
কিছু বুদ্ধিজীবি বলছেন, এদেশে জায়গা কম, আশ্রয় দেয়ার স্পেস কোথায়? হায়রে মিথ্যামানুষ! জায়গা যদি নাই থাকে, তাহলে আমাকে খুন করুন, একজন রোহিঙ্গাকে জায়গা দিন। যে চেতনা থেকে কথাটি বললাম, বাংলাদেশে আরেকজন মানুষ যদি সেই চেতনা লালন করেন, তিনিও তার জায়গা থেকে প্রবল আওয়াজে এই মানবিক প্রত্যয়কে আন্দোলনে পরিণত করুন। লেখক : কবি ও চিন্তক
২৩ নভেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম