আজাদ আবুল কালাম: তিন দিন ধরে আমার স্ত্রী আমাকে বলছে এতো শত গল্প লিখ আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে পার না ? আমি চিন্তা করি তোমাকে নিয়ে গল্প লেখা মানে তো আমাদের গল্প লেখা ।
সাংসারিক জীবনে অনেক গোপন বিষয়ই থাকে কিন্তু সেই বিষয় গুলো পাঠক কিভাবে নিবে আমি ঠিক জানি না তবুও এই সামান্য প্রয়াস
গল্প: "আমাদের স্মৃতি কথা"
আমাদের বিয়েটা হয়েছিলো খুব ধুমধাম করে যদিও বা আমি খুব অল্প বয়সে বিয়ে করি । তখন আমার বয়স মাত্র একুশ এবং আমার স্ত্রীর ষোলো । মায়ের অসুখ ছিল তাই কিছুই করার ছিল না । আমি তখন অবশ্য বেকার ছিলাম না ।
ভালো একটা ব্যবসা করতাম । ব্যবসাটি স্বর্ণের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল । এই ব্যবসার খাতিরে আমি বাংলাদেশের প্রায় পঞ্চাশটা জেলায় ঘুরেছি । সেই কাহিনি না হয় আরেকদিন বলবো ।
বিয়ের মাত্র ছয়মাস পরে আমি বেকার হয়ে যাই কিন্তু বিগত দিন গুলো আমাদের সুখেই কাটছিল । বিভিন্ন জেলায় যাই দুই তিন দিন পর পর বাড়ি আসি, আমার সোনা বউটা আমার জন্য অপেক্ষা করে ।
সে এক অন্য রকম অনুভূতি । হঠাৎ করে স্বর্ণের দাম বেড়ে গিয়েছিলো যার জন্য আমি ব্যবসায় প্রচুর লস খাচ্ছিলাম । বাধ্য হয়ে ব্যবসাটা ছেড়ে দিলাম, হয়ে গেলাম সম্পূর্ণ বেকার ।
বেকারদের নাকি ঘরের উঠানও দেখতে পারেনা আবার তার উপরে নতুন বিয়ে করেছি । সংসারে যাচ্চে তাই অবস্থা । আসতে যেতে বাবা মায়ের কথা শুনতে হচ্ছে ।
একদিন বাবার সাথে ঝগড়া করে এক কাপড়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলাম । উঠলাম আমার পরিচিত শহর পশ্চিম জুড়াইনে যেখানে আমার শৈশব কৈশর কেটেছে ।
আমার শ্রদ্ধা ভাজন হানিফ স্যারের সহযোগিতায় একটা এক রুমের বাসা নিলাম । লোকটা যদিও বা এখন আর বেঁচে নেই, খুব অল্প বয়সে হার্ট স্টক করে মারা গেছেন তিনি । আমার বিপদের দিনে এই লোকটা যে কি পরিমাণ সাহায্য সহযোগিতা করেছে তার কোন হিসাব নেই ।
আমার কাছে কোন নগদ টাকা ছিল না, বাধ্য হয়ে স্ত্রীর গলার চেইন বিক্রি করতে হলো । সেই টাকা থেকে একটি কম দামের খাট কিছু সাংসারিক জিনিস পত্র আর একটা পুরাতন বাই সাইকেল কিনলাম ।
খুব ভোরে সেই বাই সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে গেলাম । কি করেছি জানেন ? বিশ্বাস হবে তো ! চক বাজার থেকে মনিহারি নানান রঙের জিনিস কিনলাম । শহরের অলিতে গলিতে বিক্রি করতে লাগলাম ।
এখন যে আমি ঢাকা শহরে এক নতুন ফেরিওয়ালা । ক্ষুধা যখন নিত্য সঙ্গী লাজ শরম তখন তুচ্ছ । যে আমি কখনো দশ কেজি ওজনের কিছু হাতে নিয়ে দেখিনি সেই আমি রোদের খরতাপে মাইলের পর মাইল সাইকেলের পেডেল মেরে চলেছি ।
এই ভাবে আমাদের দিন গুলো চলে যাচ্ছিল । কাজ শেষে বাসায় ফিরে দেখতাম আমার লক্ষ্মী বউ আমার গোসলেন জন্য পানি তুলে রেখেছে । লাইনের কলের সাথে টিউবওয়েল লাগানো । পানি তুলতে খুব কষ্ট হতো ।
সেই কষ্টের কাজটা খুব আনন্দ নিয়েই করতো আমার স্ত্রী । মাঝে মাঝে সাইকেল চালিয়ে পায়ে খুব ব্যথা হতো । আমার মুখ দেখেই বউ বুঝে যেত মনের কথা । আমি না করতাম তারপরও গভীর রাত পর্যন্ত আমার পা টিপে দিত ।
মনিহারি জিনিস বিক্রি করে খুব বেশি যে লাভ হতো ঠিক তা নয় । সামান্য পরিমাণ যা আয় হতো তা দিয়েই সংসার চলছিল খুব কষ্টে ক্লেশে । এরই মাঝে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার স্ত্রী কনসিভ করে বসে ।
তারপরেও আমার খুব আনন্দ হয়েছিলো মনে হয়েছিলো আমার মতো সুখী পৃথিবীতে আর কেউ নেই অথচ আমার দিন গুলো কাটে সাইকেলের পেডেল মেরে ঘামের সাগর পাড়ি দিয়ে ।
দিন দিন আমার স্ত্রী গর্ভের সন্তান বড় হতে লাগলো, এখন অবশ্য আমি আমার জন্য পানি তুলতে না করেছি বরঞ্চ কাজে যাওয়ার আগে আমি আরো দুই বালতি পানি তুলে দিয়ে যাই ওর জন্য ।
সন্তান গর্ভে নিয়ে কাজ করতে ওর খুব কষ্ট হতো সেটা আমি বুঝতাম কিন্তু কাজের বুয়া রেখে দেওয়ার সমর্থ আমার নেই সেটা বুঝতেই পারছেন ।
আমি যখন বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়ে আসি তখন আমার শাশুড়ি আমার স্ত্রীকে বলেছিলো, "তুই ঢাকা শহরে ভাড়াটিয়া বাড়িতে এতো কষ্ট করতে পারবি না ।
তুই বাড়িতে চলে আয় জামাইয়ের যখন চাকরি বাকরি কিছু একটা হবে তখন তুই তার কাছে চলে যাস" কিন্তু আমার স্ত্রী তার মায়ের কথা শুনেনি ভালোবেসে আমার কাছেই পরে ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আমার কাছে থাকতে পারলো না যখন আমার স্ত্রী সাত মাসের গর্ভবতী তখন আমার শ্বশুর এসে তাকে নিয়ে গেলেন তাদের বাড়িতে ।
আমি একা হয়ে গেলাম । যাওয়ার সময় খুব কান্না করছিলো সে । বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল আর বলছিলো, তুমিও আমার সাথে চলো । আচ্ছা এটা কি কখনো হয়, স্বামী স্ত্রী শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে পরে থাকলাম !
যদিও বা আমার শ্বশুর বাড়ির অবস্থা আমাদের থেকে অনেক ভালো । কিন্তু সেটা তো হয় না । স্ত্রী কে অশ্রু সিক্ত নয়নে বিদায় দিলাম ।
স্ত্রী কে বিদায় দেওয়ার পর আমি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লাম । কাজ কর্ম কিছুই ভালো লাগতো না । এক দিন কাজে যাই তো দুই দিন কাজে যাই না । নিজেকে খুব একা একা মনে হতো ।
বাসায় ফিরলেই কষ্ট গুলো চেপে ধরতো । নিজের ব্যবসার মূলধন যা ছিল তা বসে বসে খেতে লাগলাম । এভাবে চলে গেল প্রায় দুই মাস । হাত একদম খালি নিজের খাওয়ার টাকা পর্যন্ত নেই ।
মাঝে মাঝে হানিফ স্যারের বাসায় গিয়ে খাই কিন্তু এই ভাবে তো দিন চলে না । হঠাৎ চোখে পড়লো তাকের উপরে রাখা একটি মাটির ব্যাংক আমি জানতাম এই মাটির ব্যাংকে আমার স্ত্রী টাকা জমায় ।
কোন উপায় অন্ত না পেয়ে সেখান থেকে খুব কৌশলে কাঠি দিয়ে টাকা বের করতাম আর খেতাম । এক সময় সেই ব্যাংকের টাকাও ফুরিয়ে গেল । এরই মাঝে খবর পেলাম সন্তান জন্ম নেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে ।
আমি এক হতভাগা স্বামী খালি হাতেই অসুস্থ স্ত্রী কে দেখতে গেলাম । তার দুই দিন পরেই আমাদের প্রথম সন্তান সুমাইয়া তার গরিব বাবার ঘরে জন্ম গ্রহণ করে । হাসপাতালে স্বাভাবিক ডেলিভারি হয়েছিলো কিন্তু আমি হাসপাতালের বিলের এক টাকাও দিতে পারি নাই এটাও আমার জন্য বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় ।
.
তার ঠিক এক মাস পর ছোট্ট বাবুকে নিয়ে আমরা আমাদের ভাড়া বাসাতে ফিরে আসলাম । যখন আমার স্ত্রী জানতে পারলো আমার অলসতায় ব্যবসা লাটে উঠেছে তখন কিছু বকা খেলাম কিন্তু ওতো জানে না ওর শূন্যতায় আমার শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো ।
টাকা তো নাই ব্যবসা করবো কি দিয়ে । হঠাৎ করে তাকের উপর থেকে মাটির ব্যাংকটা নামিয়ে আনলো আমার স্ত্রী । তার ইচ্ছা ব্যাংকে জমানো টাকা গুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিবে ব্যাবসার জন্য কিন্তু মাটিতে আছাড় দিয়ে ব্যাংক ভাঙতেই তার চোখ চরকগাছ ।
ব্যাংক শূন্য, তাতে কিচ্ছু নেই । সেদিন অনেক কেঁদেছিল আমার স্ত্রী । আমি সেদিন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষা খুঁজে পাইনি । নিজেকে বড়ই অপরাধী মনে হচ্ছিলো ।
এখন হয়তো অনেক টাকাই তাকে দেওয়া হয় কিন্তু সেদিনের তার ব্যাংকে জমানো সামান্য টাকার কাছে আমার বিশাল অংকের টাকাও খুব সামান্য মনে হয় । জানিনা সেই টাকার ঋণ আমি আদৌ শোধ করতে পেরেছি কিনা ।
আবারও হানিফ স্যার থেকে কিছু টাকা ঋন নিয়ে সেই মনিহারি ব্যবসা শুরু করলাম তবে আমাকে আর বেশি দিন সাইকেলের পেডেল মারতে হয়নি ।
আমার সাথে রাগ করে হয়তো আমার বাবা মা আমার কাছে আসেনি কিন্তু নতুন অতিথির খবর শুনে তার আর রাগ ধরে রাখতে পারেনি আর তাই তো একদিন কাজ শেষে এসে দেখলাম আমার বাবা মা বাসায় এসে হাজির ।
না সেদিন আর আমি রাগ করে থাকতে পারিনি । আমার সমস্ত দেনা পাওনা পরিশোধ করে দিয়ে জোর করে আবার আমাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের পূবাইলের বাড়িতে ।
এই যে এক বছরের,ভালোবাসা, রাগ অভিমান, কষ্ট এটা আমি কখনোই ভুলবো না । ভুলবো না আমি আমার স্ত্রীর অবদান । শুধু এটাই কেন । দুই দুইবার আমি আমার স্ত্রীর গহনা বিক্রি করেছি জমি কেনার বিষয়ে ।
প্রথমবার বিক্রি করেছিলাম বিয়েতে আমার দেওয়া গহনা গুলো । বলা বাহুল্য এই গহনা গুলো আমি ঢাকাতে নিয়ে যাইনি । দ্বিতীয় বার বিক্রি করলাম এই তো সেদিন । এই গহনা গুলো আমার দেওয়া নয় । সংসার থেকে পাই পাই করে পয়সা বাঁচিয়ে গহনা গুলো গড়েছিল আমার স্ত্রী ।
গহনা বিক্রির দিন অনেক কেঁদেছিল সে, কিন্তু আসলে কোন উপায় ছিল না । অনেক গুলো টাকা ওর ভাই বোনদের কাছ থেকে জোগাড় করে দিয়েও যখন আমার টাকা মিলিয়ে জমির সমস্ত টাকা পরিশোধ হচ্ছিল না তখন কি বা করার ছিল আমাদের ।
যদিও বা আমি গহনা বিক্রিতে রাজি ছিলাম না কিন্তু আমার স্ত্রী চরম মহত্ব দেখিয়ে ওর গহনা গুলো বিক্রি করে দিয়েছে শুধুমাত্র জমি টুকু ক্রয় করার জন্য । আমি জানি না ওর গহনা গুলো কবে নাগাদ ফেরত দিতে পারবো । তবে আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে আমার ।
আমার স্ত্রী তথাকথিত আধুনিকা কোন মেয়ে নয় । খুব স্বাভাবিক সরল সহজ একটি মেয়ে । আমাকে খুবই ভালোবাসে । আমি যেদিন অন্তত দুই বার ফোন না দেই সেদিন আমার আর রক্ষা থাকে না । কিন্তু আমি যেন কেমন, তার ভালোবাসার সঠিক মূল্যায়ন হয়তো করতে পারিনা তারপরও অনেক অনেক ভালোবাসি তাকে, অনেক অনেক :)
.Azad Abul Kalam
এমটিনিউজ২৪ডটকম/জয়নাল/এম,জে