দেবব্রত মুখোপাধ্যায়: সক্কাল বেলায় একটা পত্রিকায় দেখলাম খবরটা-দিনের পর দিন কোনো কাজ না থাকায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের কোচ সারোয়ার ইমরান।
বলেছেন, কাজ না করে মাসে মাসে বেতন নিতে তার ভালো লাগে না।
ইমরান ভাইয়ের দৃঢ়তা, প্রবল ব্যক্তিত্ব সবসময়ই শ্রদ্ধা তৈরী করে। এই কাজটায় তার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গিয়েছে। এখনও কিছু মানুষ আছেন, যারা টাকার জন্য আপোষ করেন না।
বিকেল হতে হতে শ্রদ্ধাটা একটু রাগে পরিণত হলো। বিসিবির ওপর রাগ নয়। তাদের ওপর রাগ করে লাভ নেই। তারা সারোয়ার ইমরানের মতো মানুষকে কাজে লাগাতে পারছে না, এতে আমি অবাক হই না। অবাক হলাম, প্রিমিয়ার লিগের ১২টি দলের কেউই ইমরান ভাইকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না!
আমরা কী এতোটাই স্মৃতিভ্রষ্ট, অকৃতজ্ঞ যে কপাল থেকে পিতা-পিতামহের নাম মুছে ফেলতে চাচ্ছি!
সারোয়ার ইমরান এখনও প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। গত বিপিএলেও বিদেশী সব নামকরা কোচের সাথে টক্কর দিয়েছেন রাজশাহী দলকে নিয়ে।
আমি এই প্রাসঙ্গিকতার বাইরে বের হয়ে একটু দেখতে চাই।
সারোয়ার ইমরানরা কেনো বাংলাদেশে এই একটা ক্লাবের চাকরি, কাজ পাওয়া বা না পাওয়ার মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাববেন? কেনো তারা এখন দেশের ক্রিকেটের নীতিনির্ধারক থাকবেন না? দেশের ক্রিকেট চেয়ারম্যান বা এই জাতীয় পদ কেনো থাকবে না ইমরান ভাইদের জন্য? যেখানে বসে তারা কেবলই ঠিক করবেন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পথে চলার ম্যাপ।
ইমরান ভাইকে নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন এক সতীর্থ সাংবাদিক।
সেখানে দেখলাম প্রবল অভিমান ভরে একটা মন্তব্য করেছেন আরেক প্রবীন কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম। তিনি বলেছেন, কেনো তাদের এই বুড়োদের নিয়ে টানাটানি! কী লাভ!
ফাহিম ভাই, আমরা কিছু লোক এখনও বাবার নাম ভুলে যেতে পারিনি যে।
জালাল আহমেদ চৌধুরী, সারোয়ার ইমরান, নাজমুল আবেদীন ফাহিমরা এই দেশের ক্রিকেটের পিতা; সেটা আমরা ভুলে যেতে পারছি না। টাই পরা কোনো কর্মকর্তার হাত ধরে, এসি রুমের কোনো ই-মেইলে চড়ে এই দেশে ক্রিকেট আসেনি। এই দেশে ক্রিকেট এসেছে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো এই মানুষগুলোর হাত ধরে।
ক্রিকেট কর্মকর্তাদের কী দোষ দেবো?
তারা তো কেউ পারিবারিক কারণে, কেউ রাজনৈতিক কারণে, কেউ চাকরির পরিচয়ে এখন কর্মকর্তা হয়েছেন। এখন তো আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববির মতো মাঠ থেকে ধুলো মেখে উঠে আসা সংগঠকও খুজে পাওয়া যায় না। তাই এ কালের টাই পরা, ধোপদুরস্ত পোশাকের কর্মকর্তাদের কাছে ইমরান, ফাহিম, জালাল নামগুলোর বিশেষ কোনো অর্থ নেই।
কিন্তু আমরা দর্শকরা? আমরাও তো নিজেদেরকে আকাশ থেকে পড়া সমর্থক বলে প্রমাণ করছি।
কথাবার্তা শুনলে মনে হয় এই মাশরাফি-সাকিবদের হাত ধরে একদিন আকাশ থেকে হঠাৎ ক্রিকেট নেমে এসেছে এই দেশে। এই মুস্তাফিজরা একদিন গাছে ধরেছিলো। বিদেশী কোচরা এসে আকশি দিয়ে পেড়ে এনেছে। আমাদের কোনো ঐতিহ্য নেই, আমাদের কোনো ইতিহাস নেই; আমাদের কোনো বাবার নাম নেই।
সেদিন দেখলাম বেশ বয়ষ্ক একজন মানুষ ফেসবুকে লিখেছেন, মাশরাফির আগে এই দেশে ফাস্ট বোলার ছিলো না।
আহা রে! আহা রে!
জিএম নওশের প্রিন্স, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশারা এই দিন আসার আগে মরে গেলেন না কেনো!
আপনারা মরে যান। এই অকৃজ্ঞ এবং বাবার নাম জানতে না চাওয়া জাতির জন্য পূর্বপুরুষের কোনো দরকার নেই। একবারও আমাদের মনে হয় না যে, কোত্থেকে এলো ক্রিকেটটা। একবারও আমরা ভাবতে রাজী নই, কে ছিলো এর আগে? প্রশ্নই করি না; কৌতুহলই হয় না।
বলে, ‘আমি তো দেখিনি।’
আমিও তো দেখিনি। আমি আমার ঠাকুরদাকে দেখিনি। অনেকেই তার বাবাকে দেখেনি। তাই বলে বাবা-ঠাকুরদা কি ছিলো না? গছে ধরেছেন আপনারা? গাছে ধরেছে এই দেশের ক্রিকেট?
এই দেশের ক্রিকেটের শত বছরের ইতিহাস আছে। একটু একটু করে প্রবল অবহেলা আর ঘরের টাকা ব্যয় করে এই মানুষগুলো ক্রিকেটকে দাড় করিয়েছেন। প্রথমে খেলেছেন, তারপর খেলা শিখিয়েছেন। তৈরী করেছেন একটার পর একটা ক্রিকেটার।
আমরা রিচার্ড ম্যাকিন্সকে পেয়ে এদের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করেছি কপাল থেকে। আর এখন তো পারলে চিহ্নটাও মুছে ফেলি।
অবশ্য ঠিকেই আছে।
আমরা তো এমনই। আমরা নিজেদের জাতির পিতাকে বাড়িতে ঢুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে ফেলতে পারি। আমরা মুছে ফেলতে পারি এই দেশটির কান্ডারির নাম। সেখানে সাবেক ক্রিকেটার, নাম করা কোচ তো কোন ছার!
আমরা তো ঐতিহ্যগতভাবেই পিতৃপুরুষের হন্তারক।
তবে আজ একটা কথা বলি, বুকের ভেতর থেকে বলি-এই মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাস যদি একবার লেগে যায়, এই দেশের ক্রিকেট হাজারটা সাকিব-মুস্তাফিজদের দিয়েও এগোতে পারবেন না। পূর্বপুরুষের আশীর্বাদ, অভিশাপ; দুটোই অব্যর্থ।
নোট
এই লেখায় কোথাও সারোয়ার ইমরানদের কৃতিত্বের কোনো রেফারেন্স ইচ্ছে করে দেইনি। কারণ, একজন লোকও লেখাটা পড়ে জানার আগ্রহ বোধ করলে নিজে নিশ্চয়ই খবর নেবেন। হাজার হাজার ফেসবুক ভক্তের দরকার নেই। তৈরী হোক সেই একজন সত্যিকারের ভক্ত; যে বাবার নাম জানতে চায়।
১০ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/টিটি/পিএস