হাসানুজ্জামান সাকী: বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক নম্বর নায়ক শাকিব খান। কিছুদিন আগ পর্যন্ত এক নম্বর নায়িকা ছিলেন অপু বিশ্বাস। যদিও কেউ কেউ মনে করেন, অপু বিশ্বাস এক নম্বর নন, বরঞ্চ দেশের আলোচিত ও ব্যস্ততম নায়িকা তিনি। শাবনূর, মৌসুমী, পপি ও পূর্ণিমার পর বাংলা চলচ্চিত্রে এক নম্বর স্থানটি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। অবশ্য সন্তান হওয়ার কারণে ক্যারিয়ারে দুই বছরের মতো একটি গ্যাপ তৈরি না হলে অপু হয়তো এতদিনে এক নম্বর স্থানটি পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হতেন।
তো, এই দুই শীর্ষ নায়ক-নায়িকার বিয়ে ও সন্তানের বিষয়টি যখন প্রকাশ্যে আসে তখন তা নিয়ে আলোচনা সঙ্গত কারণেই হয়ে ওঠে ‘টক অব দ্য টাউন।’ আর নায়িকা যখন নায়কের কাছে স্ত্রী ও তার সন্তানের স্বীকৃতির দাবি তোলেন তখন সেটি ‘বোমা’ ফাটানোর মতোই ঘটনা। তবে শাকিব-অপুর বিষয়টি যে সবার কাছে একেবারেই অজানা ছিল তাও কিন্তু নয়।
গত এক বছর ধরে পত্রপত্রিকায় শাকিব-অপুর বিয়ে-সন্তান নিয়ে আলোচনা চলে আসছিল। অপু বিশ্বাস যে শাকিব খানের সন্তান ধারণ করেছেন এবং তা গোপন রাখতে তিনি বিদেশে চলে গেছেন এবং সর্বশেষ কলকাতায় অপুর সন্তান হয়েছে এমন খবর মিডিয়ায় এসেছে। তবে খবরের সূত্র নির্ভরযোগ্য না হওয়ায় তা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে ছিল।
আমাদের মিডিয়ায় এ ধরনের গসিপ-খবর একেবারে নতুন নয়। সারা দুনিয়াতেই তা হচ্ছে। হলিউড-বলিউডেও গসিপের খবর ‘স্পাইস’ তো হরহামেশাই হচ্ছে। হলিউড-বলিউডের প্রসঙ্গে পরে আসছি। এখন আরেকটু ঢালিউড নিয়ে বলি। আশির দশকের কথা যাদের মনে আছে, তারা জানেন, বাংলাদেশের কিংবদন্তি নায়িকা ববিতা অনেকটা হুট করেই লন্ডন প্রবাসী ব্যবসায়ী ইফতেখার চৌধুরীকে বিয়ে করে বিরাট আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন।
ববিতার সাথে প্রেমের গুঞ্জন ছিল চিত্রনায়ক জাফর ইকবালের। একবার ভীষণভাবে রটেছিল নায়িকা পপি নাকি নায়ক শাকিল খানকে বিয়ে করেছেন। এ ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। বেশ কয়েক বছর আগে নায়ক রিয়াজ ও নায়িকা পূর্ণিমার প্রেমের খবর শোনা গিয়েছিল। পরবর্তীতে এসব ঘটনা কোনটা ধামাচাপা পড়ে গেছে, কোনটার তথ্য প্রমাণ মেলেনি।
হালের এক অভিনেতার দশ বছর ধরে বিয়ে ও সন্তান গোপন রাখার বিষয়টি বেশ আলোচিত। অভিনেত্রী মাহীর বিয়ে নিয়েও সম্প্রতি পানি কম ঘোলা হয়নি। নব্বই দশকে জনপ্রিয় নায়ক জাফর ইকবাল ও ২০০৮ সালে নায়ক মান্নার হঠাৎ মৃত্যু অনেক বেশি নাড়া দিয়ে যায় চলচ্চিত্রকে। তবে নব্বই দশকের মাঝামাঝি নায়ক সালমান শাহর রহস্যজনক মৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। সালমান শাহ’র মৃত্যু নিয়ে মামলা এখনও আদালতে বিচারাধীন। ২০ বছরের বেশি সময় পরেও বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা সম্ভাবনাময় নায়কের অকাল মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটিত হয়নি।
শাকিব-অপুর বিষয়টি নিয়ে কেন এত হৈ চৈ? যেকোন বিষয়ে নিঃসন্দেহে ‘পরিবেশনা’ একটি বড় কারণ। দীর্ঘদিন পর সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে অপুর প্রকাশ্যে আবির্ভাব নি:সন্দেহে একটি দারুণ পরিবেশন। আমাদের সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত নারী, যিনি আবার বড়মাপের সেলিব্রেটি, তিনি যদি দেশের অপর সেলিব্রিটি একজন শীর্ষ নায়কের বিরুদ্ধে স্ত্রী হিসেবে নিজের ও তার সন্তানের স্বীকৃতি না পাওয়ার অভিযোগ তোলেন, টিভি পর্দায় হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন, তখন তাকে কোনভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
সাইবার যুগে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিটি মানুষের কাছে এ ঘটনা দ্রুত পৌঁছে যাবে, এটা জানা কথা। শাকিব-অপুর বিষয়টি তাই স্বাভাবিকভাবেই এত বেশি প্রচারিত ও আলোচিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপু বিশ্বাস তার সন্তানকে নিয়ে টিভি চ্যানেলে হাজির হওয়ায় অনেকেই সহানুভূতি নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। এর ব্যতিক্রমও কিন্তু কম নয়। সামাজিক মাধ্যমে শাকিব-অপুর কাহিনী নিয়ে হাস্যরসে মেতেছেন অনেকে। কেউ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে জড়িয়ে লিখেছেন, এখন তার স্ত্রী শিশিরের কি হবে! কেউ বলেছেন, ফেসবুকে শাকিব-অপুকে নিয়ে এত আলোচনা, তাই আজ রাতে তিনি নিশ্চিত তাদের স্বপ্নে দেখবেন। তার এই স্ট্যাটাসে কমেন্ট করতে গিয়ে মজা নিয়েছেন আরো অনেকে।
এই তালিকায় মিডিয়ার নারী সেলিব্রেটি, সচেতন নারী প্রতিনিধি যেমন রয়েছেন তেমনি পুরুষেরাও আছেন। একজন লিখেছেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তিনি অপু বিশ্বাসকে বিয়ে করতে রাজী আছেন। যদিও স্ট্যাটাসদাতা জানেন না যে অপু বিশ্বাস শাকিব খানকে বিয়ে করার জন্য অনেক আগেই ধর্মান্তরিত হয়েছেন। তার এই মন্তব্যে মজা লুটছেন আরো অনেকে। বিষয়টি এমন যেন সেলিব্রেটিদের তো এটা হবেই। এ নিয়ে এত সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই।
সেলিব্রেটিরা কেন প্রেম-বিয়ের বিষয়টি লুকিয়ে রাখেন? আলোচনাটা সেখানেই। শুধু সেলিব্রেটিরাই নন, সাধারণ মানুষও প্রেম গোপন রাখেন। প্রেম যেমন শ্বাশত তেমনি তা গোপন রাখাটাও মানুষের স্বভাবজাত। এটি হলিউড এবং বলিউডেও রয়েছে। উদাহরণ আছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গণের অনেক বড় বড় তারকা খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রেও। কিন্তু বিয়ে? এটি আর এখন কেউ গোপন রাখেন না। হলিউডে তো নয়ই, বলিউডেও এখন বিষয়টি অস্বীকার করেন না কেউ। তাহলে ঢালিউডে অর্থাৎ বাংলাদেশে কেন এটি হচ্ছে?
এর সাধারণ উত্তর: পুরো বিষয়টি বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা, দর্শকের পছন্দ-অপছন্দ, মানুষের মানসিকতা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। প্রচলিত ধারণা, একজন সেলিব্রেটি যখন বিয়ে করেন তখন তার বাজার দর কমে যায়। ভক্তরা অবিবাহিত নায়ক-নায়িকার ছবি যতটা হৃদয়ে রাখেন, বিবাহিত হয়ে গেলে সেই তাদের ছবিই তখন আর ঘরেও টাঙিয়ে রাখতে চান না। প্রশ্ন হচ্ছে, এই মানসিকতার কী পরিবর্তন হবে না।
হলিউড তো বটেই, প্রতিবেশি দেশে, যেখানকার কৃষ্টি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ আমাদের মতোই, সেই ভারতের চলচ্চিত্র শিল্প বলিউড-টালিউডেও এখন বিয়ের বিষয়টি কেউ গোপন রাখছেন না।
মার্কিন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, জুলিয়া রবার্টস, কেট উইন্সলেট, মেগান ফক্স, নাতালিয়া পোর্টম্যান, জেনিফার অ্যানিস্টন, স্কারলেট জোহানসন, চার্লিজ থেরন, অলিভিয়া উইলডি, জেসিকা অ্যালবা, মিলা কুনিস এদের মধ্যে কেউ বিবাহিত, কেউ একাধিক বিয়ে করেছেন, কেউবা ডিভোর্সি ও একাধিক সন্তানের জননী।
বলিউডে আমির খান, শাহরুখ খান, অক্ষয় কুমার, অভিষেক বচ্চন, ঋত্মিক রোশন, কাজল, কারিনা, ঐশ্বরিয়া রাই বিবাহিত হয়েও অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন দাপটের সাথে।
এমনকি ঢাকার প্রতিবেশী কলকাতায়ও প্রসেনজিৎ, জিৎ, সোহাম, যিশু, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তা, কোয়েল মল্লিক, শ্রাবন্তী, স্বস্তিকা, পাওলি দামের মতো জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাদের ক্যারিয়ার যখন তুঙ্গে তখন তারা বিয়ে করেছেন কিংবা প্রকাশ্যে প্রেমের কথা স্বীকার করেছেন।
তাদের জনপ্রিয়তায় কিন্তু তাতে ভাটা পড়েনি। তাহলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটটি ভিন্ন হবে কেন?
আমরা বাংলাদেশের দর্শকদের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে আরো কিছু অদ্ভূত ঘটনার কথা বলে থাকি। তেমনই একটি প্রচলিত ধারণা যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলে চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা পাওয়া কঠিন। এ কারণে বর্তমান সময়ের একজন চলচ্চিত্র নায়ক নিজের ধর্ম কী তা কাউকে বুঝতে না দিয়ে নামের শেষে চৌধুরী যোগ করেছেন। বাংলাদেশের দর্শকেরা আসলেই কি এতটা সাম্প্রদায়িক? অপু বিশ্বাস কিংবা বিদ্যা সিনহা মিম কি তাহলে নিজ পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন! প্রতিষ্ঠা পেতে তো সমস্যা হয়নি অঞ্জু ঘোষের!
ফিরে আসি শাকিব-অপুর বিয়ে ও সন্তান প্রসঙ্গে। অপু বিশ্বাসের সাথে শাকিব খান বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এমন ঘটনায় অনেকেই ক্ষুব্ধ। কেউ আইনগতভাবে বিচার চাইছেন, কেউ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। আমি বলবো, এ নিয়ে মামলা মোকাদ্দমা হলে, বিচারে শাকিব খান দোষী সাব্যস্ত হলেও তার হয়তো তেমন কিছুই হবে না। বাংলাদেশের জাতীয় দলের পেসার রুবেল কিংবা আরাফাত সানির কী কিছু হয়েছে?
শাকিব খান হয়তো বড়জোর দু’চারদিন জেল খাটবেন। প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করলে শাকিব হয়তো অপু বিশ্বাসকে ঘরে তুলে নেবেন। কিন্তু তাদের দাম্পত্য-সম্পর্ক কতটুকু স্বাভাবিক হবে তা যে কেউ অনুমান করতে পারেন।
এ লেখা যখন শেষ করে এনেছি তখন দেশের একটি টিভি টকশো’তে অতিথি হয়ে শাকিব খান অপু বিশ্বাসকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। আমরা জানি না, একদিন আগের কঠোর অবস্থান থেকে কেন সরে এলেন শাকিব? কেন তার মত পাল্টালেন? কারণ যাই হোক না কেন, এটা অবশ্যই ভালো খবর। আমাদের আলোচনার বিষয় প্রেম, বিয়ে এমন কি সন্তান হয়ে গেলেও সে খবর গোপন রাখার এই প্রচলনটা কেন? কিসের ভয়ে?
শাকিব খান আজ অপুকে স্বীকার করে নেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে শুধু ক্যারিয়ার ধ্বংসের ভয়ে কোনো সেলিব্রেটিকে যেন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয় এটাই সবার কাম্য। এজন্য দরকার বাংলাদেশের দর্শক তথা মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন। সেলিব্রেটিরা বিবাহিত নাকি অবিবাহিত সেটা বিবেচ্য না হয়ে প্রধান্য দেয়া উচিত তাদের অভিনয়শৈলীর।
তাই এ ধরনের কোন পরিস্থিতিতে বিচারের প্রকৃত ভার দেশের মানুষের ওপর, বিশেষ দর্শকদের ওপরই থাকলো। কেননা, এই দর্শকরাই শাকিব খানকে দেশের এক নম্বর নায়ক বানিয়েছেন। অপু বিশ্বাসকে বানিয়েছেন ব্যস্ততম নায়িকা। এই ঘটনার পর শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস যদি শীর্ষ নায়ক-নায়িকার আসনটি ধরে রাখতে পারেন তাহলে বুঝতে হবে দর্শকদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে।
তাহলে আর কোন নায়ক-নায়িকা ক্যারিয়ার ধ্বংসের কথা বলে দর্শকের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে এহেন অমানবিক কাণ্ড ঘটানোর মানসিকতা থেকে হয়তো বেরিয়ে আসতে পারবেন। আব্রাহাম খান জয়ের মতো শিশুরা পাবে সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ।
বাংলাদেশের দর্শকদের মানসিকতায় সেই জাগরণ ঘটুক, সেলিব্রেটিদের মানসিকতার পরিবর্তন হোক।-চ্যানেল আই
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। এমটিনিউজ২৪.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)
১২ এপ্রিল ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস