রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৭, ১০:৩৯:৩৩

হতভাগ্য মানুষের কথা বলছি

হতভাগ্য মানুষের কথা বলছি

শান্তা মারিয়া: ভূপেন হাজারিকার গানটির কথা মনে পড়ছে কদিন ধরেই। মেঘ থম থম করে। হ্যাঁ ঘনিয়ে এসেছে দুর্যোগ।

বৈশাখে এসেছে অকাল বর্ষা। একদিন যদি রোদ ওঠে তো আবার দেখা দেয় মেঘ। আবার বৃষ্টি। প্রকৃতির রুদ্র রোষ আর কর্তৃপক্ষের অবহেলা। হাওরবাসী দাঁড়াবে কোথায়? পায়ের নিচে সত্যিই মাটি নেই তাদের। পানি আর পানি। এই রাক্ষুসে পানিতে তলিয়ে গেছে বোরো ফসল। মরেছে মাছ। শেষ ভরসা হাঁসও শেষের পথে। বাধ্য হযে এই অসহায় মানুষগুলো জলের দরেই ছেড়ে দিচ্ছে তাদের শেষ সম্বল সন্তানসম গবাদি পশু।

হাওর অঞ্চলের হতভাগ্য মানুষগুলোর কথা বলছি। ওদের কি নেই বেঁচে থাকার অধিকার? অসময়ের বৃষ্টিতে আর বাঁধভাঙা বানে তাদের এই অবস্থা হয়েছে। কি খেয়ে বাঁচবে এখন এই দরিদ্র মানুষগুলো? হাওর অঞ্চলে শিশু, কিশোর,বৃদ্ধ, গর্ভবতী ও প্রসূতি নারীর দুর্দশা যেন ভাসছে চোখের সামনে।

চৈত্র-বৈশাখে আমাদের দেশে বর্ষার সময় নয়। এই সময় যে এই অবস্থা হবে তা কারও জানা ছিল না কথাটি সত্যি। প্রকৃতির উপর হাত না থাকলেও মানুষের অবহেলা কিন্তু এত সহজে ক্ষমা করা যায় না। প্রকৃতির বৈরিতার পাশাপাশি  কর্তৃপক্ষের চিরন্তন গাফিলতি ও দুর্নীতিও কম দায়ী নয় হাওরের বর্তমান দুর্দশার জন্য।  ফসলরক্ষা বাঁধ মেরামত করা হয়নি ঠিক সময়ে। দুর্নীতি হয়েছে। অসময়ের বর্ষণ আর বানে তলিয়ে গেছে ধান। সেই ধানের বিষাক্ত কীটনাশক খেয়ে মরেছে মাছও।

পচা মাছ আর পচা ধানের বিষাক্ত পানিতে পুরো এলাকার অবস্থা অতি অসহনীয়। সেই সঙ্গে খাদ্য শৃঙ্খলের অনিবার্য ধারায় মরে গেছে হাঁসও। পরবর্তী ধাপেই রয়েছে মানুষের পালা। তাদের ঘরে এমনিতেই খাদ্য নেই। ফলে ব্যাপক ত্রাণ না পেলে তাদেরও মৃত্যু অনিবার্য। হাওরবাসীর এই দুর্যোগের সময়ও আমাদের মধ্যে অনেকেই নিশ্চিন্তে বসে আছেন। টিভি সিরিয়াল দেখা চলছে। আর তরুণ প্রজন্মের অনেকের সেলফিরও বিরাম নেই।

মনে পড়ছে আমার তরুণ বয়সের কথা। সে সময় বন্যা বা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা রিলিফ টিম গঠন করে দুর্গত এলাকায় চলে যেতাম। একালের তারুণ্য কি ফেসবুকেই তাদের মানবিকতা আটকে ফেলেছে?

হাওর এলাকার দুর্গত মানুষের পাশে এখন দাঁড়াতে হবে পুরো দেশের মানুষকে। আর সর্বোচ্চ সরকারি উদ্যোগ তো অতি জরুরি। বেসরকারি সংস্থাগুলোরও জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ কাজ পরিচালনা করা দরকার হাওর এলাকায়। দুর্গত এলাকায় উপযুক্ত পরিমাণে খাদ্য, জলপরিশোধনকারী ট্যাবলেট, পেটের পীড়া রোধের ওষুধ, খাবার স্যালাইন পাঠানো দরকার জরুরি ভিত্তিতে। ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল খোলা দরকার এখনি। গবাদি পশুর খাদ্যেরও ব্যবস্থা করা দরকার। না খেয়ে মরছে সেগুলোও।

আর কৃষক বাঁচাতে এখন সরকারি পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী কৃষিঋণ আর বীজধান বিতরণ দরকার। দরকার স্থানীয় মহাজনদের হাত থেকে দরিদ্রমানুষকে বাঁচানো। এনজিওগুলোরও এখন বাধ্যতামূলকভাবে ঋণ মওকুফ করতে হবে।

এই দুর্যোগে শিশুদের পড়ালেখা যেন বন্ধ না হয়ে থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আর যেসব দুর্নীতিবাজের কারণে আর ফাঁকিবাজের অবহেলায় হাওরবাসীর এই সীমাহীন দুর্ভোগ তাদের কথা ভুলে গেলেও চলবে না।  দরকার এদের গাফিলতি ও দুর্নীতির কড়া শাস্তি। আর পুরো এলাকার পানিশোধনের ব্যবস্থা করা দরকার।

এদেশের মাছের বাজারের একটা বড় অংশ আসে হাওর থেকে। সেখানে মাছের বংশ তো ধ্বংস হয়ে গেছে। নতুন করে মাছ চাষ শুরু করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে জরুরিভিত্তিতে। দরকার সবক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ।

সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে, সাংগঠনিক পর্যায়ে। দেশবাসীর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন থাকা দরকার হাওরবাসীর দুর্ভোগ। হাওর অঞ্চলকে জাতীয়ভাবে দুর্গত অঞ্চল বলে ঘোষণা করে সেখানে পাঠানো দরকার দরকারী সব জরুরি সাহায্য।

এখন ব্যক্তিগত ভোগবিলাস কিছুটা কমিয়ে হলেও আমরা সকলে যদি ত্রাণ নিয়ে হাওরবাসীর পাশে দাঁড়াই তাহলে নিজেদের মানুষ বলে দাবি করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবো।আকাশ কালো করে বারে বারেই আসছে বৃষ্টি। এই অবস্থা চলতে থাকলে হাওরবাসীর দুর্ভোগ আরও বাড়বে। মহামারী ও দুর্ভিক্ষের অশুভ আভাস মিলেছে যেন।

ঢাকা শহরের রোশনাই দুদিন একটু কম করলেও কোনো ক্ষতি নেই। হাওরের দুর্গত মানুষদের বাঁচাতে হবে। তৈলাধার পাত্র না পাত্রাধার তৈল বিতর্ক পরেও করা যাবে। বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগে সবচেয়ে যেটা জরুরি সেটি হলো জাতীয় ঐক্য। এই জাতীয় ঐক্য ধরে রেখে সকল দেশপ্রেমিক মানুষ এক হয়েই দাঁড়াতে হবে দুর্গত হাওরবাসীর পাশে।

চলুন এই দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াই। ত্রাণ দিয়ে এদের বর্তমানটাকে আগে বাঁচাই। তার পাশাপাশি তাদের ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করার জন্য যাবতীয় উদ্যোগ নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সম্মিলিতভাবে তাগিদ দেই।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/এম.জে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে