রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭, ১০:১৭:৪০

পোশাক হলো মানুষের আভিজাত্য, রুচি, ব্যক্তিত্ব ও সংস্কৃতির পরিচয়

পোশাক হলো মানুষের আভিজাত্য, রুচি, ব্যক্তিত্ব ও সংস্কৃতির পরিচয়

খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): পোশাক হচ্ছে মানুষের ব্যক্তি সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ। অনেক সময় পোশাকও কথা বলে, পোশাকই বলে দেয় তাঁর শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচিবোধ আর সামাজিক অবস্থান। তবে অন্য সবকিছুর মত সময়ের সাথে পোশাকও সদা পরিবর্তনশীল। দেশে বিদেশে ফ্যাশন নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। রাজনীতিবিদ থেকে লেখক শোবিজ জগতের তারকা বুদ্ধিজীবি সবার পোশাক সমাজকে প্রভাবিত করে। তরুণ প্রজন্মসহ মানুষ অনুসরণ করে আদর্শ মনে করে।

ফ্যাশনে আভিজাত্য রুচি ব্যক্তিত্বের পায়। যুগে যুগে পশ্চিমা থেকে ফ্যাশন এসেছে।এখন আকাশ সংস্কৃতি শিক্ষার অগ্রগতি মিলিয়ে বেড়েছে। কথা হচ্ছে বয়স পেশা মিলিয়ে যাকে যে পোশাকে মানায় সেটিই পরতে হবে সময় স্থান কাল পাত্র ভেদে। এ নিয়ে বিতর্ক নয়। নতুন ও সময়ের হাল সেশনে সমাগত জানানোই জরুরি। সময়ের দাবি সময়ের সাথে পা মেলানো।

উন্নত দেশ গুলোতে নামী-দামী ব্যক্তিদের নিজস্ব ফ্যাশন ডিজাইনার থাকে। তাঁরাই মূলত কোথায় কোন পোশাক পরবে ঠিক করে দেয়। কারণ শোবিজ অঙ্গন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ ব্র্যান্ডিং দেখতে পছন্দ করে। তাঁর অন্যান্য গুণাবলীর সাথে পোশাকও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন কাতান এবং জামদানি শাড়িতে মহিমান্বিত ঠিক একইভাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া লেস এবং ফ্রেন্স শিফনে সমুজ্জ্বল। পাকিস্তানের বেনজির ভুট্ট্রো অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা অবস্থায় যতই ওয়েস্টার্ন ড্রেস কিংবা মিনি স্কার্ট পরুন প্রাইম মিনিস্টার হবার পর লম্বা সালোয়ার-কামিজের উপর চওড়া ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা তুলেছেন এটাই তাঁর নিজস্ব স্টাইল। পোশাক প্রতিটি মানুষের সম্ভ্রম, ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্যের প্রকাশ। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পোশাকের ভূমিকা তাই অনস্বীকার্য।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কালো মুজিবকোর্ট, সাদা পাঞ্জাবি, মোটা পায়ের পায়জামা ও স্যান্ডেল সুতেই নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। মোটা ফ্রেমের চশমা আর পাইপকেই দুনিয়ার বুকে নিজের ব্যক্তিত্বের সাথে মানিয়েছিলেন। তাকে দলের সবাই অনুসরণ করেছেন। মহাত্মা গান্ধীকে আমরা কেবল একটি সাদা ধূতি পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। নেহেরু সাদা টুপি কটি যা পরে নেহেরু কোট ধুতি পাম্প সু তার ফ্যাশন। এছাড়া শেরওয়ানী চুসত পায়জামা টুপি পাম্প সুতেই রাজনৈতিক জীবনে কেতাদুরস্ত আইডল হয়েছেন। উপমহাদেশের রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের নেহেরু পোশাক প্রভাব ফেললেও গান্ধী নিজে চরকায় তৈরি ধুতি গায়ে পেচিয়ে আইকন। তাঁতের শাড়িতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হতো, বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি এক রঙা তাঁতির শাড়ীতেই স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন।

আফগানিস্তানের হামিদ কারজাই মাথায় টুপি গায়ে আচকান লাগিয়ে নিজেকে সেশনে আলাদা করেছেন! বিল ক্লিনটন প্রথম টাইয়ের সাথে হাতগুটিয়ে নিতে শিখলেন। বৃটেনের রাণী কেপ কতো কারুকার্যে বিশ্বননদিত।

গান্ধীকে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ন্যাংটা ফকির বলেছেন তার পোশাক নিয়ে। বাম রাজনীতিবিদ পীর হাবিবুর রহমানকে লুঙ্গি পরে সংসদে ঢুকতে বাধা দেন এরশাদ। তারা দমেননি।সেটিই তাদের আইকন করেছেন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূস গ্রামীণ চেকের ফতুয়াতেই নিজেকে সবার থেকে আলাদা করেছেন।  মাওলানা ভাসানী পায়জামা, লুঙ্গি, বেতের টুপিই বেশি পরেছেন। তাদের সেটিই মানিয়েছে। তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক লুঙ্গি পরে ক্লাস নিতে গেলে সেটি হবে বেমানান অসভ্যতা অরুচিকর।

কে কিভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবে এটা তাঁর ক্ষমতা এবং অভিরুচি। প্রতিনিয়তই ফ্যাশন এবং ড্রেস নিয়ে নিত্য নতুন গবেষণা আর আবিষ্কার, ইস্ট আর ওয়েস্ট এর ফিউশন করে করে এক্সপেরিমেন্ট। ফ্যাশনের নতুন থিয়োরি বা মাত্রা হচ্ছে ইজি বা কাজ বান্ধব পরিচ্ছদ। শাড়ি বা গাউন পড়ে যেমন মোটরসাইকেল চালানো যায় না একই ভাবে আবার ফর্মাল কোন বাঙালি অনুষ্ঠানে বা বিয়ের পার্টিতে জিন্স বা ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরাটা অসুন্দরই নয় বেমানানও। বিদ্যাপীঠে অতিরিক্ত সাজসজ্জা যেমন দৃষ্টি কটু তেমনই বিয়ে বাড়িতে সাজসজ্জা দৃষ্টি নন্দন। নান্দনিকতা স্থান কাল পাত্র ভেদে পৃথক সময়ে পৃথক হওয়াটাই স্বাভাবিক।

সাম্প্রতিক সময়ে বেগম সুফিয়া কামাল হলে মেয়েদের সালোয়ারের উপর গেঞ্জি পরা নিষেধ নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে অনেক বাকবিতণ্ডা হচ্ছে । টিশার্ট নিঃসন্দেহে একটি আরামদায়ক পোশাক কিন্তু পোশাক পরারও একটি গ্রামার আছে। টিশার্টের সাথে লুজ পায়জামা, ডিভাইডার জাতীয় ঢোলা কিছু পরলে অসুন্দর এবং অশালীন লাগার প্রশ্নই আসে না। দিন শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত মেয়েরা ঢিলে ঢালা পোশাকে বিশ্রাম নেবে স্বাভাবিক কিন্তু কেবল অফিসে যদি ফর্মাল পোষাকে যেতে বলা হয় ক্ষতি কি?

কানাডায় ৪ বছর আগে যখন নিজের ছেলেকে টরেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে রেখে আসতে গিয়েছি ওখানে বিল্ডিংয়ের একপাশে ছাত্র অন্য পাশে ছাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা। সবার হাতেই কার্ড সদৃশ চাবি কিন্তু কোন দারোয়ান বা গার্ড নেই। মেয়েরা দেখি এই শীতের ভিতরেও লম্বা পা বের করে শর্টস পরে আছে উপড়ে টিশার্ট। অনভ্যস্ত আমার চোখে দৃষ্টি কটু লাগলেও ওদের কাছে স্বাভাবিক। কারণ ওরা অভ্যস্ত। কিন্তু আমরা মুসলমান, নারীদের জন্য শরীর ঢাকাটা অাবশ্যক। কিন্তু একটু পর খেয়াল করলাম এখন আর আগের মত খারাপ লাগছে না, সময় অভ্যস্ত করে তুলেছে।
বাঙালিরা মূলত শঙ্কর জাতি। দীর্ঘ সময় ভারত উপমহাদেশের অংশ হিসেবে থাকার কারণে আমাদের সংস্কৃতিতে সনাতনী প্রভাব রয়ে গেছে এখনো। শাড়ি মূলত কলকাতার আভিজাত্য পরিবারের প্রচলন। আবার ৪৭ পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় রীতিতে দেশ ভাগে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তানের সাথে থাকার কারণে সালোয়ার কামিজই আমাদের জাতিও ড্রেস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে একটা সময়ে। যদিও অন্যান্য মুসলিম দেশে এই ড্রেসের প্রচলনই নেই।

দুই বার হজ্বে যাওয়ার সুবাদে সৌদি পরিবারের অভ্যন্তরে প্রবেশাধিকার মিলেছে বেশ কয়েকবার। আমি অবাক হয়ে ভেবেছি বোরকা এবং হিজাব ছাড়াও আমরা মূলত অনেক বেশি পোশাক পরিধানে অভ্যস্ত। কারণ বাসায় ওরা পাশ্চাত্যের অনুকরণে খুবই সংক্ষিপ্ত পোশাক পড়তে অভ্যস্ত। সন্ধ্যায় কিংবা রাতের পার্টিতে নাইট গাউন, যার উপরিভাগ একদমই খোলা থাকে। আমার বিস্ময়ে হতবাক হওয়া দেখে ওরা আমায় নিশ্চিত করলো পার্টি গুলোতে পুরুষ আর নারীরা আলাদা থাকে। কিন্তু তবুও তাই বলে এতোটাই সংক্ষিপ্ত পোশাক! ওদের পোশাক দেখার জন্য অন্য কারো ঘরেও ঢুকতে হয় না মার্কেট গুলোতে গেলেই দেখতে পাওয়া যায়।

দুবাই, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ছাড়াও মধ্য প্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে ড্রেস নিয়ে এতো মাথা ব্যথা নেই শার্ট-প্যান্ট কিংবা যে কোন লং ড্রেসের উপড়ে বড়জোর স্কার্ফ, উড়না বা হিজাব। আমেরিকা, ইউরোপ, কানাডার মাল্টি কালচার সোসাইটিতে পোশাক নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা না থাকলেও চাকরি ক্ষেত্রে এমনকি যে কোন প্রোগ্রামে ওদের ফর্মাল পোশাকই এডভান্টেজ পায়, হিসেব কষে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী হওয়ার কারণে আমারও হল এবং হলের ভিতরে মেয়েদের পরিহিত পোশাক সম্বন্ধে ধারণা আছে। যদিও সময় পাল্টেছে এখনকার মেয়েরা আরো মেধাবী এবং আধুনিক হওয়ারই কথা। তবুও অতীত অভিজ্ঞতা মনের মধ্যে বার বার এসে দোল দিচ্ছে। ধরে নেই বেশীর ভাগ মেয়েই সচেতন কিন্তু কিছুটা ব্যতিক্রম সবখানেই থাকে। ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। একদিন হল গেটে ঢুকার মুখে কি যেন দৃষ্টিতে বাঁধলো, একটু খেয়াল করে দেখলাম আমাদের একজন সিনিয়র সুন্দরী আপা কাঁধে চিকন ফিতার নাইটি পরে একজন ছেলের পাশে বসে চা খাচ্ছে। ভাবলাম সময় পায়নি হয়তো, না হলে রাতের ড্রেস পরে বাইরে বের হবে কেন! কিন্তু আরেকটু বড় হওয়ার পর বুঝেছিলাম এবং জেনেছিলাম ইচ্ছাকৃত।

বর্তমান সময়ে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা ফ্যাশনের চেয়েও সময়ের দাবি। কারণ আর কিছু নয় সহজ এবং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা। তাছাড়া বিশ্বায়নের যুগে অবাধ তথ্য প্রবাহের কারণে বর্তমান সময়ে তারুণ্যে ভরপুর মেয়েরা উচিত আর অনুচিত তফাৎ করতে পারে না। তাঁর কারণ ওরা নিজেদের পুরো বিশ্বের পরিমণ্ডলে ভাবতে অভ্যস্ত আমাদের মত গণ্ডী বদ্ধতায় ভাবতে রাজি নয়। তা ছাড়া অন্য ড্রেস যদি সহজ হয় অসুবিধা কি! কারণ সালোয়ার কামিজে ওড়না মেইনটেইন করা খানিকটা অস্বস্তিকর। আমাদের সময়ে মেয়েরা টাইট সালোয়ার কামিজের উপর টেনে টুনে সারাক্ষণ ওড়না ঠিক করতো কিন্তু বর্তমান সময়ে এভাবে করাটা অসম্মান জনক আত্মসম্মান হানীকর। ওরা পুরুষদের কু দৃষ্টিকে এতো বেশী পরোয়া করে না কিংবা উল্টোটাও হতে পারে পুরুষদের অতোটা খারাপ ভাবতে রাজী নয়।

আমি আমাদের জাতিও ড্রেস শাড়ির বিপক্ষে যাচ্ছি না কারণ শাড়ি পৃথিবীর সুন্দরতম পোশাকগুলোর একটি, আমার কাছে অন্যতম। যে পরবে তাঁর ভাব-ভঙ্গী এবং মানসিকতার উপর নির্ভর করে অনেক সময় ওয়েস্টার্ন ড্রেসও শালীনতা বজায় রেখে পরা যায় আবার সালোয়ার কামিজও যৌন উত্তেজক বা অশালীন পোশাক মনে হতে পারে। যে পোশাক ই পরুক একজন নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রীর পোশাক যৌন উত্তেজক হতে পারে না কিছুতেই কারণ জাতি তাঁর কাছে অনেক বেশি কিছু আশা করে। একজন প্রতিশ্রুতিশীল বিবেকবান মানুষ হিসেবে তারুণ্য থেকে নিজেকে গড়ার দায়িত্ব নিজের উপড়েই বর্তায়। মনে রাখতে হবে আজকের তরুণ তরুণীরাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিশেষ করে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের উপর জাতি তাকিয়ে রয় ভালো কিছুর অপেক্ষা করে। কারণ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি বাঁকে তাঁদের অবদান ছড়িয়ে আছে।

হিজাব পরিহিত নারী মানেই ভদ্র সুশীল সম্ভ্রান্ত আর অন্য সবাই অভদ্র অশালীন ভাবার কোন কারণ দেখি না। কারণ হিজাব পরেও অন্যায় কাজ করা যায়। শালীনতা যতটা নিজেকে প্রকাশ করাতে পোশাকে ঠিক অতোটা নয় বলে মনে করি। পোশাক মানুষের আব্রু, প্রতিটি মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই যা প্রযোজ্য। শালীনতা কেবল পোশাকে নয়, কথাবার্তা, চিন্তা চেতনাতেও হতে হবে কারণ সভ্যতা আমাদের শালীন হতে শিক্ষা দেয়। অশালীন অসভ্য মানুষ যত ধনী বা ক্ষমতাবানই হোক কখনোই কারো প্রিয় হতে পারে না, শ্রদ্ধা ভালবাসা পাওয়া তো দুরূহ ব্যাপার। আজকে যারা তরুণ প্রজন্ম তাঁরাই আগামীর ভবিষ্যত। অতএব নিজের আচার- আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ প্রতিটি ক্ষেত্রে সচেতন এবং সংযত হওয়ার এখনই সময়।

লেখক: সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে