পাঠকই লেখক ডেস্ক : সামার ২০১৫ সেমিস্টারের বিবিএ ২২তম এ ব্যাচের সমাপনী ক্লাসের শেষের দিকে দুইজন শিক্ষার্থীকে সামনে ডাকলাম। এদের একজন আড়াই বছরের কন্যা সন্তানের মা জান্নাতুল ফেরদাউস এবং অপরজন ব্যাচের সর্বোচ্চ সিজিপিএধারী লামিসা।
দু'জনকে দু'টি মার্কার হাতে দিয়ে বোর্ডে তাদের প্রিয় দশ জন মানুষের নাম লিখতে বললাম। ওরা বোর্ডে গিয়ে দশ জন মানুষের নাম লিখল।
এবার – এরা কারা? তাদের পরিচয় ডান পাশে লিখতে বললাম।
ওরা এদের পরিচয় লিখল। লামিসার তালিকায় মা, বাবা, ভাই-বোন, খালা, কাজিন, ২ মামা, নানু ও একজন বান্ধবীর নাম স্থান পেল।
জান্নাতুল ফেরদাউসের তালিকায় বাবা, মা, স্বামী, কন্যা, পরিবারের ৩ সদস্য ও ৩ জন বান্ধবীর নাম জায়গা পেল।
ক্লাসের সবার শতভাগ নজর দু'জনের প্রিয়জনদের তালিকার দিকে।
লামিসা ও জান্নাতুল ফেরদাউসকে ১০ জনের তালিকা থেকে তিন জনের নাম মুছে দিতে বললাম। লক্ষ্য করলাম দু'জনই বেশ ভাবনায় পড়ে গেল।
লামিসা ১ বান্ধবী ও ২ কাজিনের নাম মুছে দিল। অন্যদিকে জান্নাতুল ফেরদাউস ৩ বান্ধবীর নাম মুছে দিল।
এবার অবশিষ্ট ৭ জনের তালিকা থেকে আরো ৩ জনের নাম মুছে দিতে বলায় ওদের মধ্যে ভাবনাটা আরো বেড়ে গেল। ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীরাও আরো কৌতুহলী হয়ে উঠল।
লামিসা খালা ও ২ মামার নাম মুছে দিল। অন্যদিকে জান্নাতুল ফেরদাউস বাবা, মা, স্বামী ও কন্যাকে রেখে বাকীদের নাম মুছে দিল।
এবার অবশিষ্ট ৪ জন থেকে আরো ২ জনের নাম মুছে দিতে বললাম।
ততক্ষণে দু'জনের হাত কাঁপছে। লামিসা ধীরে ধীরে তার ভাই-বোনের নাম মুছে দিল। থাকলো তার মা ও বাবা। ৪ জন থেকে লামিসা ২ জনের নাম মুছে দিতে পারলেও জান্নাতুল ফেরদাউসের হাত মোটেই চলছিল না। বাবা, মা, স্বামী ও কন্যা ৪ জন থেকে আসলে কোন ২ জনকে বাদ দিবে?? মনে হচ্ছে নীরবে সে কাঁদছে। ওদেরকে বারবার বলছিলাম- এটা সত্যিকার জীবন বা মন থেকে বাদ দিতে হচ্ছে না, শুধুমাত্র বোর্ডে লেখা তালিকা থেকে ডাস্টার দিয়ে মুছে দেওয়ার জন্য বলছি।
যে মজা, আনন্দ আর কৌতুহল দিয়ে ক্লাসটা শুরু হয়েছিলো, সেটা আর নেই। ক্লাসের অন্যদের মাঝেও বেশ টেনশনের ছাপ।
জান্নাতুল ফেরদাউস বাবা ও মায়ের নাম মুছে দিল। তার তালিকায় আর বাকী থাকল দুইজন। স্বামী আর সন্তান। অন্যদিকে লামিসার তালিকায় মা আর বাবা।
এবার আরো একজনের নাম মুছে দিতে বললাম। কিন্তু দু'জনেই অনেকটা স্থির হয়ে গেল। ওরা কারো নাম মুছতে আর পারছেনা। বললাম এটাতো মন থেকে বাদ দিতে হচ্ছে না, শুধুমাত্র বোর্ড থেকে মুছতে বলেছি। জাস্ট প্রিয় মানুষদের নাম মুছে দিতে বলেছি, মেরে ফেলতে তো বলিনি!!!
লামিসা বাবার নামটি মুছে মাকে রেখে দিলেও জান্নাতুল ফেরদাউস তখনও রীতিমতো কাঁপছিল। মেয়েটা কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে কন্যার নামটা মুছে দিল।
পকেট থেকে ২টা গিফ্ট বের করে ২ জনকে দিয়ে বললাম– তোমাদের মনের উপর দিয়ে যে ঝড়টা গেল তার জন্য আমি দুঃখিত।
সময়ের অভাবে ওদের কাছ থেকে জানা হয়নি কেন এবং কোন বিবেচনায় ওরা অন্য নামগুলো মুছে দিচ্ছিল। হয়তো প্রথমে বন্ধু আর আত্মীয়দের নাম মুছে দিয়েছিল, কারন তবু তাদের কাছে পরিবারের সবাই রইল। লামিসার বাবাকে মুছে দিলে অন্তত মা রইল।
কিন্তু জান্নাতুল ফেরদাউসকে মা-বাবাকেও মুছে দিতে হলো, হয়তো এই ভাবনায়- বাবা মা তো আর চিরদিন থাকবে না। তার কাছে তার কন্যা আর তার বাবাই বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু সবার শেষে এই দুইজন থেকে কন্যাকে মুছে ফেলার কারন- হয়তো, কন্যাতো বড় হয়ে একদিন তাকে ছেড়ে চলে গেলেও যেতে পারে। কিন্তু কন্যার বাবাতো কোন দিনও ছেড়ে যাবে না।
এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস