মেহেরিনা কামাল মুন: আমি শুধু এক নজরে ছবির দিকে তাকালাম..এরপর আর কোনো বোধ কাজ করেনি। আমি শুধু এক নজরে ছবির দিকে তাকালাম..এরপর আর কোনো বোধ কাজ করেনি। সময়টা ২০০১।
তখন বাড়িতে থাকি, যেখানে দৈনিক পত্রিকা যেতে যেতে রাত হয়ে যেত প্রায় দিনই। সারাদিন ক্লাস, ঘোরাঘুরি, মাঝে মাঝে ফ্রেন্ডদের সাথে কলেজ মাঠে ক্রিকেট খেলা এভাবেই কেটে যেত দিনগুলো। দৈনিক পত্রিকা দেখাই হয়না, পড়াতো দূরের কথা।
তারিখটা সম্ভবত ১৪ই বা ১৫ই ডিসেম্বর। কি কাজে আমি পত্রিকা উল্টাচ্ছি, হঠাৎ খেলার পাতায় আটকে গেলো চোখ। একটা ট্রলি ব্যাগের সাথে এলিয়ে দাঁড়ানো হাস্যোজ্জল একটা ছেলে। ছবির নিচের লিখাটি পড়তে যেনো ভুলেই গেলাম। কতক্ষন চোখ আটকে ছিলো সেই ছবিতে জানিনা, কিছুক্ষন পড়ে নিচে পড়লাম ” বিশ্বের দ্রুততম বোলার হতে চান মাশরাফি বিন মর্তুজা” সেই থেকে আজও, মাশরাফি নামেই আমার ঘোর লাগা..!
দেশের বাইরে সেটি ছিল তাঁর প্রথম সিরিজ, নিউজিল্যান্ডে। সেই ছবিটি আজও আছে আমার কাছে। শুরু হলো মাশরাফিকে নিয়ে আমার পাগলামি। কতজনের কাছে গিয়েছি মাশরাফির ফোন নাম্বার পাওয়ার জন্য! যেখানেই শুনেছি কারো কাছে নাম্বার পাওয়া যেতে পরে, সেখানেই ছুটে গিয়েছি। অবশেষে এক ক্লাসমেটের কাছ থেকে ওর এক বড় ভাইয়ের কাছে পেলাম নম্বর। যেন স্বপ্নের নাগাল পাওয়া! এরপর দুরু দুরু বুকে একদিন ফোন দেওয়া।
রোমাঞ্চ–খুশি–উচ্ছ্বাস–ভাল লাগার তীব্রতায় এমন একটা দলা পাকানো অনুভূতি ছিল যে, “কেমন আছেন”– এর বেশী কিছু বলতে পারিনি। প্রতিদিনই ফোন দিতাম, তাঁর কণ্ঠ শুনেই রেখে দিতাম। পেপারে বা অন্য কোথাও যেখানে যত ছবি পেতাম, সব সংগ্রহ করেছি। কোনো ছবিই আমার স্পর্শের বাইরে থাকতে পারত না।
আমার রুমের দুই পাশের দেয়াল ঢাকা মাশরাফির অসংখ্য ছবিতে। আম্মু প্রথম প্রথম খুব বকা দিত। কিন্তু আমার পাগলামির কাছে হার মেনে উনিও এখন হাল ছেড়ে দিয়ে শুধু উপভোগ করেন। এখনও মনে আছে, ২০০৩ এর পহেলা বৈশাখ রাতে ফোন করেছিলাম শুভেচ্ছা জানাতে। সেদিন অনেক কথা হয়েছিলো, মজা করেছিলো অনেক। আসতে আসতে এমন অবস্থা দাড়ালো, আত্মীয় স্বজনরা কেউ মাশরাফিকে ভাগনী জামাই, বা আবার কেউ দুলাভাই ডাকা শুরু করলো! দিন যায়, পেপার কাটিংয়ে আমার রুম ভরে যায়।
তাঁর প্রতি ভালোবাসা, আবেগ, শ্রদ্ধা বাড়তে থাকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। মাশরাফি ভালো খেললে আমার মাথা উঁচু হয়ে যেতো, সেদিন আমাকে পায় কে! খারাপ খেললে এমনিতেই মন খারাপ থাকত। কেউ কিছু বললে শুরু হয়ে যেতো আমার চিল্লাচিল্লি। ২০০৬ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর দিনটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে। হোস্টেলের রুমে শুয়ে আছি, এক রুমমেট পেপার নিয়ে এসে আমাকে ডেকে বললো “দেখ দেখ.. তোর মাশরাফি তো বিয়ে করে ফেলছে” !
আমি শুধু এক নজরে ছবির দিকে তাকালাম..এরপর আর কোনো বোধ কাজ করেনি। পরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিই। টানা দুইদিন কিছু খাইনি। পরে ওই রুমমেট ভাত মাখিয়ে জোর করে খাইয়ে দিয়েছিল। খুব কেঁদেছিলাম। তবে তাঁর প্রতি আকর্ষণ কমেনি এতটুকু। দিনে দিনে আরও বেড়েছে, বাড়ছে। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর, রূমের দেয়াল ভরছে আজও। জীবনের একটা বড় স্বপ্ন ছিল মাশরাফির সাথে একদিন হলেও দেখা করা।
একাদশ শ্রেনীতে পড়ি, ক্লাস, কোচিং শেষ করে স্ট্যাম্প আর বল নিয়ে বাসার সামনের মাঠে যেতাম প্রাক্টিসে, শুধু তার মতো বোলিং শিখবো বলে। এবং গর্ব করে বলতে পারি অনেকটাই পেরেছিলাম। তবে ২০১৪ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে সেই স্বপ্ন পূরণ করে দেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আরিফুল ইসলাম রনি ভাইয়াকে। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা শেষ হবেনা কোন কিছু দিয়ে। তিনি আমাকে প্রথমবার মাশরাফির সাথে দেখা করিয়ে দিলেন। এবং দ্বিতীয় বারও তার সুবাদেই প্রায় আড়াই ঘন্টা মাশরাফির সাথে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।
ম্যাশ এর জন্য পাগলামির আরো কিছু কাহিনী শেয়ার করি,একদিন মাশরাফির পড়নে দেখলাম লাল একটা হুডি। মাথায় ঢুকলো এরকম একটা আমার চাই–ই চাই। খুজে খুজে ঢাকা না পেয়ে বরিশালে পেয়েছি। মনে হয়েছিল, আকাশের চাঁদ পেয়েছি। ফেসবুকের কল্যাণে পরিচয় হয়েছে তার ছোট ভাই মোর্সালিনের সাথে। ২০১৪ সালের জন্মদিনে ওর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেলাম মাশরাফির জার্সি! জন্মদিনে পেলাম মাশরাফির দেওয়া ভিডিও উইশ। সত্যি সত্যিই কেঁদে দিয়েছিলাম উইশটা পেয়ে। মনে আছে প্রতিটা বার ইঞ্জুরিতে পরায় কতো কেঁদেছি, মুখ ভার করে বসে থেকেছি একা একা। মনে হয়েছে কি যেনো নেই, কেমন ফাকা ফাকা সব।
২০১১ বিশ্বকাপ খেলতে না পারায় তার সাথে কেঁদেছি কতবার। ২০০৯ সালে অধিনায়কত্ব হারানোর পরে তার কান্না এখনো যেন কানে বাজতে থাকে। তবে ২০১৪তে এসে আবারো তার কাঁধে অধিনায়কের দায়িত্ব আসার পরে অনেকটা খুশির সাথে অনেকটা দুশ্চিন্তা গ্রাশ করেছিল। পারবে তো নিজের ইঞ্জুরি সামলে দল সামলাতে? কিন্তু আমাকে তিনি নিরাশ করেননি, করেছেন গর্বিত। দলকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য পর্যায়ে। দলের প্রতিটা হয়ে , প্রতিটা পরাজয়ে দলের সামনে শক্ত ঢাল হয়ে থাকেন এই অধিনায়ক। কখনো সতীর্থকে একটু বকে দিয়ে বাঁ কখনো বুকে আগলে সবাইকে এক করে রাখছেন তিনি।
মাঠে ও মাঠের বাইরে খুব একটা মিল পাওয়া যায়না তার। মাঠে যেমন সম্মুখ যোদ্ধা মাঠের বাইরে তেমনি উচ্ছ্বল কিশোরের মতো। দলের দায়িত্ব নিয়ে পার করে দিয়েছেন দুটি বছর। সফলতার অনুভূতি পাশে সরিয়ে পরাজয়গুলো থেকে শিক্ষা নিতেই ব্যস্ত থাকেন তিনি। শুভ হোক এই দায়িত্বশীল পথ চলা।
এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস