শুক্রবার, ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০৮:১৬:১১

পেঁয়াজের কেজি ১২০, চাল ৬৫; জীবন চলছে তো?

পেঁয়াজের কেজি ১২০, চাল ৬৫; জীবন চলছে তো?

জুবায়ের আল মাহমুদ : গতকাল সকালে পেশাগত কাজে সচিবালয় যাওয়ার পথে সহকর্মী হাসান পারভেসের সাথে কথা হচ্ছিল বর্তমান অস্বাভাবিক বাজার পরিস্থিতি নিয়ে। গাড়িতে আমরা দুইজন রিপোর্টার ছাড়াও ছিল দুইজন ক্যামেরাপার্সন ও ড্রাইভার। আলোচনার এক পর্যায়ে হঠাৎ ড্রাইভার জসিম জানালো সে পেঁয়াজ কেনা ছেড়ে দিয়েছে। কেন ছেড়ে দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি জানান, দোকানদার নাকি তার কাছ থেকে ছয়টি পেঁয়াজের দাম চেয়েছে ৫০ টাকা। জসিমের পরিবার পেঁয়াজের অস্থিতিশীল বাজারের কাছে হেরে গেছে। জানিনা আরও কতশত পরিবারের অবস্থা এমন হয়েছে।
 
ঈদুল আযহার আগে যে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩৫ টাকা, সেই পেঁয়াজই এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। এমন কি মাস খানেক আগেও দেশী পেঁয়াজের কেজি ছিল ৮০ টাকা।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, গত দুই মাসে বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ৯৫ ভাগ। টিসিবির তথ্য বলছে, গেল বছর এই সময় বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ২৫ থেকে ৪০ টাকা। অর্থ্যাৎ গত এক বছরে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি হার ২০৭. ৬৯%। এক বছর আগে একটি মাঝারি পরিবার পেঁয়াজের পেছনে যে টাকা খরচ করতো এখন সেই পরিবারকে তার চেয়ে সাতগুণ টাকা বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। যে কারণে জসিমের মতো হয়তো অনেকেই এখন পেঁয়াজ কেনাই ছেড়ে দিয়েছেন।

বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি করে ভারত থেকে। অথচ বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম চড়া হলেও ভারতের চিত্র কিন্তু একেবারেই উল্টো। ভারতীয় পত্রিকা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর তথ্য বলছে, দেশটিতে বর্তমানে বাজারভেদে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪৫ রুপিতে।   

পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির এই হার অব্যহত থাকবে এটা যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে।  হবেই’বা না কেন? কারণ গেল ২রা নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে নাগরিক মন্তব্যে ‘পেঁয়াজ রাজনীতির সাদামাটা অংক’ শিরোনামের লেখায় কিভাবে পেঁয়াজ নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে এবং কিভাবে চোখের সামনে দাম বেড়েই চলেছে তা তুলে ধরেছি। সেখানে আমি যে পরিসংখ্যান স্পষ্ট তুলে ধরেছি কিভাবে মন্ত্রণালয়ের উদাসিনতার কারণে বাজার দিনদিন অস্থিতিশিল হয়ে পড়ছে। কিন্তু সেই পরিসংখ্যানের প্রেক্ষিতে আজ পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোন সদোত্তর জাতির সামনে তুলে ধরা হয়নি-এমনকি কোন ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। তাই লেখার প্রয়োজনে আবারো সেই অংকটি তুলে ধরছি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশে বছরে প্রায় ২০ থেকে ২২ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে।  অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এই চাহিদার বিপরীতে দেশে এবার পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৯ লাখ মেট্রিকটন। সে হিসাবে ২ লাখ টন ঘাটতি থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ১৭ই অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ৭ লাখ ৭০ হাজার ৮৮৫ মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ আমাদের ২২ লাখ মেট্রিকটন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৯ লাখ মে.টন ও আমদানি করা হয়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার মে.টন। তার মানে দেশের বাজারে পেঁয়াজ পরিমাণ ছিল প্রায় ২৬ লাখ ৭০ হাজার মে.টন। অথচ আমাদের চাহিদা মাত্র ২২ লাখ মে.টন। সেই হিসাবে এখন দেশের বাজারে ৪ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত থাকার কথা। উদ্বিৃত্ত এই পেঁয়াজের হিসাব কে দেবে? অস্থিতিশীল পেঁয়াজের বাজার। অথচ এ ব্যাপারে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোন কথা বলতে রাজি নয়। কিন্তু কেন?

চলুন এবার চালের হিসাবটা জেনে নেই। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, প্রতি কেজি সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৬৫ টাকা, নাজির শাইল/মিনিকেট চাল (সাধারণ) বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫৬ থেকে ৬০ টাকা, মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৫৪ টাকা, পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৪ টাকা কেজি দরে। তবে বাজার ভেদে মোটা চাল অনেক সময় ৬০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হতে আমরা দেখেছি। অথচ যা এক বছর আগেও ছিল ৩৬ টাকা। দামবৃদ্ধির এই হার অব্যাহত থাকলে চালের দাম কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা মুশকিল।

শুধু কি চাল! নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি জিনিসের দামই আকাশ ছোঁয়া। এখানে টিসিবির তালিকা থেকে কয়েকটি নিত্যপন্যর দাম তুলে ধরলাম।  বর্তমানে বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়, মশুর ডালের কেজি ১২০ থেকে ১২৫ টাকা, রসুনের কেজি ১০০ থেকে ১১০ টাকা, প্রতি কেজি শুকনো মরিচের দাম ২০০ টাকা, হলুদের কেজিও ২০০ টাকা, জিরা ৪৫০ টাকা, রুই মাছের কেজি ৩০০ টাকা, ইলিশের ১ হাজার টাকা, গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০০ টাকা, খাসীর মাংস ৭৫০ টাকা, দেশী মুরগী ৩৮০ টাকা, লবণের কেজি ৪০ এবং প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ২৮ টাকা।

বাজারের এমন ভয়াবহ অবস্থায় আসলেই আমরা ভালো আছি তো? জসিম তো নিজের অবস্থা মুখ ফুটে বলতে পেরেছেন, কিন্তু যারা মধ্যবিত্ত! তারা তো নিজেদের কষ্টের কথা বলতেও পারে না। তবুও যেন সবাই ভালো থাকার অভিনয় করেই যাচ্ছে! হয়তো এটাই জীবন। সাধারণ মানুষের এই জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলেও রাষ্ট্রের যেন কিছুই করার নেই! রাষ্ট্রও কি অভিনয় করছে, নাকি ঘুমিয়ে আছে? আচ্ছা সন্তানদের কষ্টে রেখে কোন মা’কি ঘুমিয়ে থাকতে পারে?

লেখক: জুবায়ের আল মাহমুদ সাংবাদিক, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে