রোকেয়া লিটা: বছর দুয়েক আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টার পার হয়ে অপেক্ষা করছিলাম বোর্ডিং এর জন্য। এমন সময় বেশ স্মার্ট, সুশ্রী একটি মেয়ে আমার পাশে এসে বসল।
আমি যাচ্ছিলাম সিঙ্গাপুরে আমার বরের কাছে আর মেয়েটি যাচ্ছিল আমেরিকায় তার শ্বশুরবাড়িতে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মেয়েটির সাথে আমার আলাপ জমে গেল। আলাপচারিতায় উঠে এলো আমাদের বিবাহিত জীবন।
অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, খুব অল্প সময়ের পরিচয়েই মেয়েটি তার দাম্পত্য জীবনের অশান্তিগুলো আমার সাথে শেয়ার করতে দ্বিধা করল না।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়া অবস্থাতেই বিয়ে হয় মেয়েটির। সে সচ্ছল পরিবারের মেয়ে, কিন্তু ওই যে অ্যামেরকিান পাত্র! সেই পাত্র হাত ছাড়া করতে চায়নি মেয়েটির পরিবার।
তবে, পাত্রপক্ষের সাথে কথা হয়েছিল যে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার পর তারা মেয়েটিকে লেখাপড়া করাবে। কিন্তু বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সব কথা উল্টে গেল। লেখাপড়া তো দূরের কথা, মেয়েটির শ্বশুরবাড়ির লোকজন চায় মেয়েটি আমেরিকায় অড জব করুক, সন্তানের মা হোক।
কথা বলতে বলতেই হঠাৎ বোর্ডিং এর জন্য ডাক পড়লো। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আর তার মলিন মুখটা আমার চোখে ভাসছিল।
এরই মধ্যে আমরা ফেসবুকে নিজেদের পরিচয় শেয়ার করেছি। সিঙ্গাপুরে পোঁছানোর দিন দুয়েক পরেই আমি তার কাছ থেকে বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ পেলাম। এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস।
স্বাবলম্বী হবার আগেই অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে হলে পরবর্তী জীবনে অনেক দুর্ভোগের আশঙ্কা থাকে।
তার সাংসারিক অশান্তি কমেনি একটুও, সে অড জব করতো। কিছুদিন আগে দেখলাম সে পুত্র সন্তানের মা হয়েছে। দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল। মেয়েটির আর লেখাপড়া হলো না।
তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন যা চেয়েছে, ঠিক তাই হয়েছে। নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো স্বাধীনতা নেই মেয়েটির । মেয়েটির জীবনের সব সিদ্ধান্ত নেয় এখন তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
নিশ্চয়ই ভাবছেন, মেয়েটির শ্বশুরবাড়ির লোকজনের উপর আমি ভীষণ বিরক্ত, মোটেই তা নয়। সত্যি বলতে কী, আমার পরিবারের মেয়েদের এবং বান্ধবীদের শ্বশুরবাড়ির গল্প শুনতে শুনতে শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে আমার এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, এর চেয়ে ভালো কিছু আমি খুব একটা ভাবতে পারি না।
শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে যে দু/একটি ভালো গল্প শুনি সেগুলো আমার কাছে ব্যতিক্রম। কাজেই মেয়েদের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের প্রতি আমার প্রত্যাশা কম।
শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কোনো মেয়ে খুব আদরে থাকবে, তার সব চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ হবে, আমি এমনটি আশা করি না। বরং বিমানবন্দরে পরিচয় হওয়া ওই মেয়েটির সাথে যা ঘটছে, সেটাই অনেক স্বাভাবিক মনে হয়।
আর সে কারণেই আমার সমস্ত রাগ মেয়েটির বাবা-মায়ের ওপর। কেন তারা মেয়েটিকে স্নাতক পাশও করতে দিলো না, তার আগেই বিয়ে দিয়ে দিলো!
এটি ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষিত পরিবারের চিত্র। শিক্ষিত বাবা-মায়েরাই যদি মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে স্বনির্ভর না করে বিয়ে দিয়ে দেয়, তাহলে অশিক্ষিত বাবা-মায়েদের দোষ দিয়ে আর কী হবে?
ক্রিকেটের মাঠে একদল স্কুলছাত্রী: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজন বাবা-মা সহযোগিতা।
আমার কৈশোরের একটা বড় সময় কেটেছে মফস্বল শহরে। আমরা চার বোন একসাথে বড় হয়েছি। পরিবারের ওপর চাপটা ছিল বেশ ভালোই। তারপরও আমার বাবা আমাদের চার বোনকেই লেখাপড়া করিয়েছেন।
আমাদের জীবনে তেমন কোনো বিলাসিতা ছিল না। পাশের বাড়ির বান্ধবীদের দেখতাম, ক্লাস সিক্স-সেভেনে উঠতে না উঠতেই তাদের জন্য গহনা বানিয়ে রাখছে তাদের বাবা-মা। ওদের বিয়ের জন্য টাকা জমানো হচ্ছিল ব্যাংকে।
অথচ, আমার বাবা-মায়ের যেন সেসব নিয়ে কোনো চিন্তাই ছিল না। না ছিল আমাদের কোনো গহনা, না ছিল আমাদের নামে জমানো কোনো টাকা। আমাদের শুধু ছিল শিক্ষা।
আজ আমরা সবাই স্বাবলম্বী। কিন্তু আমার পাশের বাড়ির বান্ধবীদের অবস্থা বেশ নাজুক! একেকজনের বিয়েতে দুই-তিন লাখ টাকা করে যৌতুক ও গয়নাগাটি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের নিজেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো অধিকার তাদের নেই।
কারণ, প্রথমত তারা শিক্ষিত নয়, দ্বিতীয়ত তারা স্বাবলম্বী নয়। তারা তাদের স্বামীর উপরে নির্ভরশীল।
এই মেয়েগুলো সংসারে আছে অনেকটা পুতুলের মতো। স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন যেখানে থাকতে বলছে, সেখানেই তারা থাকতে বাধ্য। সংসারে রান্না করা আর ঘর-গোছানো ছাড়া তাদের আর কোনো ভূমিকা নেই।
আমার শাশুড়ি মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলেন, শ্বশুরবাড়িতে কাজ করতে করতেই তাঁর নাকি দিন কেটে গেছে। আমার বুঝতে সমস্যা হয় না, কেন তিনি এসব কথা বলেন। তিনি হয়তো চান তার ছেলের বউরাও তার মতো করে সংসারের ঘানি টানুক। কিন্তু বাস্তবতা তো একেবারেই ভিন্ন।
আমার শাশুড়ির বিয়ে হয়েছিল মাত্র তের বছর বয়সে। তাঁর বাবা-মা তাঁকে লেখাপড়া করাননি। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে ইচ্ছে মতো খাটিয়ে নিয়েছে, তাঁর প্রতিবাদ করার কোনো উপায় ছিল না। কারণ, তিনি আত্মনির্ভরশীল নন।
কিন্তু আমার হাতে তো অনেক অপশন রয়েছে। আমি উপার্জন করতে পারি। সংসারের কাজগুলো নিজের ঘাড়ে না নিয়ে গৃহপরিচারিকা রাখতে পারি।
শুনতে খারাপ লাগলেও, এটাই সত্যি যে এখনও অনেক পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠানো হয় কেবল ভালো একটা পাত্রের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য, মেয়েকে স্বাবলম্বী করার কথা ভাবে না বাবা-মায়েরা।
যেন একটা মেয়ের ভালো থাকা, মন্দ থাকা, বর্তমান-ভবিষ্যৎ, সবকিছুই নির্ভর করে ভালো একটা ছেলের সাথে বিয়ের ওপর। ক্ষেত্র বিশেষে ভালো ছেলেও খোঁজার ধৈর্য থাকে না মেয়ের বাবা-মায়ের। কোনো মতো একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারলেই যেন বেঁচে যায় মেয়ের পরিবার।
কাজেই, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মেয়েদের যে ভোগান্তি তার দায় যদি অনেকটাই মেয়ের বাবা-মায়ের ওপর গিয়ে বর্তায় তাহলে কি খুব অযৌক্তিক হয়ে যায় বিষয়টা? মোটেই না।
বিয়ে কোনোভাবেই একটা মেয়ের জীবনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না। কারণ, বিয়েটা আজ খুব মধুর থাকলেও কাল সেটি আর মধুর নাও থাকতে পারে। এমনকি দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদও ঘটতে পারে।
তাই, একটা মেয়ের ভালো থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে কেবল তার শিক্ষা এবং আত্মনির্ভরশীলতা। আর সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে হবে বাবার বাড়িতেই।
লেখক: সাংবাদিক, সিঙ্গাপুর
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস