মনিরুল ইসলাম মনি (শিশু সাহিত্যিক): ছবিটি প্রতীকী নয়, ফটোশপের কারসাজিও নয়, আবার সাজিয়ে তোলাও নয়। একেবারেই সত্যি। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কালীবাড়ির মিডিয়া জোনের সামনে থেকে ১৮ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরে ছবিটি তুলেছিলেন চারণ সাংবাদিক দ্বীপু মালিক। তার এই ছবির হনুমানটি প্রিয়জনকে হারিয়ে নীরব শোক প্রকাশ করছে, সঙ্গে প্রতিবাদও!
বলছিলাম কুমারখালীর হনুমানের মৃত্যু নিয়ে। প্রতি বছরই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বর্ষার মাঝামাঝি সময়ে অসংখ্য হনুমান বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। তার পর যাযাবর বেশে বিচরণ করে বাংলাদেশের লোকালয়ের বিভিন্ন প্রান্তে। মানুষকে বিনোদন দেয়, গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। মানুষও তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখায়। তাদের কলা, বিস্কুট, বাদামসহ বিভিন্ন রকমের ফল খেতে দেয়।
যাযাবর দলের এমন একটি হনুমান কুমারখালীর শিল্পকলার সামনে পিডিবির বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে স্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেও অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয় তাকে। এর কিছুক্ষণ পরেই হনুমানটির সহযোগী একটি কাপড়ে পেঁচিয়ে কুমারখালীর মিডিয়া জোনের সামনে বসে নীরব শোক প্রকাশ করে! কথা বলার ক্ষমতা থাকলে হয়তো বিচার চাইত বাংলাদেশের বিদ্যুৎ অফিসের খামখেয়ালিপনার বিরুদ্ধে।
এ ঘটনার দুদিন আগে মঙ্গলবার একই জেলার দৌলতপুরে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির খামখেয়ালিপনায় বিদ্যুৎ আলী নামের এক শ্রমিক মারা যান। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ওই শ্রমিক আসলে বিদ্যুতের কাজের জন্য যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন না। তাকে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস ভাড়া করে এনে কাজ করাচ্ছিল। ভাড়া করে আনা অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে যদি বিদ্যুৎ লাইনের কাজ করানো লাগে তাহলে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও লাইনম্যানরা কী করে? তাদের কাজই বা কী? শ্রমিক তো অভাবের তাড়নায় কাজ করতে চাইবেই। তাই বলে বিদ্যুৎ অফিস কি যাকে তাকে দিয়েই কাজ করাবে? বাংলাদেশে কী দক্ষ জনশক্তির এতই অভাব?
এবার হনুমানকে নিয়ে আর একটি সত্য ঘটনা বলি। একই জেলার কুমারখালীর পাশের উপজেলা খোকসার হিজলাবট গ্রামের ঘটনা। হিজলাবট গ্রামে গড়াই নদী ঘেঁষে দেড়শ বছরেরও অধিক বয়সী দুটি লাল তেঁতুলগাছ রয়েছে। ২০০৭ সালের বর্ষায় একপাল দলছুট হনুমান ওই তেঁতুলগাছটিতে খেলা করত। এর মধ্যে ওই গ্রামের দুজন লোক একটি হনুমানকে মেরে ফেলে দলের অন্যগুলোকে তাড়িয়ে দেয়। হনুমানগুলো তাদের বন্ধুর মরদেহ নিয়ে নদী পার হয়ে সরাসরি খোকসা থানার ওসির কাছে এসে বিচার দেয় ইশারার মাধ্যমে। ওসি প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে এলাকার মানুষের কাছে খোঁজখবর নিয়ে অভিযোগ থাকা দুজনকে আটক করে মামলা ঠুকে দেয়। এ ঘটনাটির একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম আমি। শুধু আমি না, আমার মতো অনেকেই ভিড় জমিয়েছিলেন থানায় এসে হনুমানের বিচার প্রার্থনার বিষয়টি স্বচক্ষে দেখার জন্য।
হনুমানকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবতা মানেন। মহাকাব্য মহাভারতেও হনুমানের বীরত্ব ইতিহাসে রয়েছে। পবনের পুত্র ও ভীমের ভাই হনুমান। অনেকেই আবার হনুমানকে মানুষের সঙ্গে তুলনা করে ফেলে; ওরা নাকি আগে মানুষই ছিল! অভিশাপে এসব হয়েছে আর কি! কিন্তু এসব কথা আসলে কাল্পনিক উপকথা, কোনো সত্যতা কিংবা ভিত্তি নেই। আসলে ওরা মানুষের থেকেও অনেক ভালো বোধের অধিকারী। সুতরাং মানুষের সাথে ওদের তুলনা করলে ওরা লজ্জাই পাবে। স্বজাতিকে হত্যা করে; এমন প্রাণি পৃথিবীতে খুব কমই আছে। কিন্তু মানুষ মানুষকে হত্যা করে। এ সভ্য সমাজেও মানুষ আজও একতাবদ্ধ হতে পারেনি, মেনে নিতে শেখেনি অন্যজনের সাফল্য। বোনকে মেরে ফেললে কিংবা ধর্ষণ করলেও প্রকাশ্যে বিচার চাওয়ার মতো সাহস নেই।
দেশজুড়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অবস্থা খুবই ভয়াবহ। যথেষ্ট মেধা, জনশক্তি থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগেও বিদ্যুতের তার থাকে অরক্ষিত অবস্থায় যত্রতত্র। দেশজুড়ে লোডশেডিং! এত সব অনিয়মের প্রতিবাদ করার সৎ সাহস আমাদের মতো মানুষের নেই। কিন্তু সে সাহসটি দেখিয়েছে হনুমান নামের অবলা বন্যপশুটি!
তবে মানুষের মধ্যেও মানুষ নামে এখনও অনেকেই আছেন। এ জন্যই কুমারখালীর এক রিকশাচালক উপস্থিত কয়েকজনের কাছ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা তুলে হনুমানটির সঙ্গীকে সৎকারের ব্যবস্থা করেন।
আসুন আমরা হনুমানটির কাছ থেকে কিছু শিখি। অন্যায়কে অন্যায়, ন্যায়কে ন্যায়, সত্যকে সত্য কিংবা মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শিখি। নিজের দেশ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই সামনের দিকে।
[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। এমটিনিউজ২৪.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে এমটিনিউজ২৪.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস