পাঠকই লেখক ডেস্ক : আমার নাম হোসাইন মিয়া। আমি চট্টগ্রাম শহরে রিকশা চালাই। বস্তিতে পরিবারসহ থাকি। জীবনের বিশাল একটি অংশ গাফলতিতে কেটে গেছে। আমারই বস্তির আরেক রিকশাওয়ালা ভাইয়ের মেহনতে আমার জীবনের এই পরিবর্তন।
হজরত! আমাকে বোঝানোর জন্য কোনো আলিম আসেননি। কোনো আলিমের কাছে দ্বীন শেখার আমার সুযোগই হয়নি। আমার এই রিকশাওয়ালা ভাই আমাকে প্রায় অশুদ্ধ কয়েকটা সুরা শিখিয়েছে। এই সুরা দিয়েই আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। জামাতে প্রতিবার তিন দিন দিতে গেলে শুদ্ধ করার চেষ্টা করি। তাও আমারই মতো কোনোমতে পড়নেওয়ালা অন্য কোনো তাবলিগি ভাইয়ের কাছ থেকে।
ছোটবেলা থেকে আলিম-ওলামার সঙ্গে সম্পর্ক এই এতটুকু যে, কখনও পেটে ব্যথা শুরু হয়ে গেলে হুজুরের হাতে ১০ টাকা গুঁজে দিয়ে পানি পড়া নিয়েছি। ঘরে কখনও মুরগি জবাই করতে হলে হুজুরের হাতে ১০ টাকা গুঁজে দিয়ে জবাই করিয়েছি। ছোটবেলা মাসে ৫০ টাকা দিতে হবে বলে বাবা-মা মক্তবে দেননি।
একটা অশুদ্ধ কালিমাই আমার দাদির কাছে শেখা। কোনো হুজুর কখনও শুদ্ধ করে দিতে আসেননি। কত হুজুরকে রিকশা করে টেনে নিয়ে গেছি। কখনও মহব্বত করে নামাজ পড়ার কথাও বলেননি। ফলে দ্বীনের নিসবতে কোনো আলিমের সঙ্গে সম্পর্কও গড়ে ওঠেনি।
হজরত! আপনারা মনে কষ্ট নিবেন না। ঠিক কথাটি বলতে গেলে দ্বীন যতটুকু শিখেছি, তা আমার মতো জাহেল আওয়ামদের কাছেই শিখেছি। শুধু আমি না আমার মতো শত শত হোসেন মিয়া।
জানতামই না আলিম কী জিনিস? এই আওয়ামদের সঙ্গে তাবলিগে গিয়েই শিখেছি। যার মাঝে তিন প্রকারের ইকরাম নেই, সে রাসুলের উম্মতের অন্তর্ভুক্ত না- বড়কে সম্মান করা, ছোটকে স্নেহ করা, আলিম-ওলামাকে তাজিম করা।
হজরত, রাগ করবেন না। তাবলিগের একটি কাম ছিল বলেই আমার মতো শত শত হোসেন মিয়া দ্বীন পেয়েছে। আপনারা আলিম। আপনাদের দ্বীনের জন্য মহব্বত করি। মাদ্রাসায় দ্বীন শেখানো হয় বলে মাদ্রাসাকে মহব্বত করি। কিন্তু তাবলিগের এই কাজটাকে জানের চেয়ে বেশি মহব্বত করি। যেসব জাহেল আওয়ামরা হাতে-পায়ে ধরে তাবলিগে নিয়ে গেছে তাদেরও জানের চেয়ে বেশি মহব্বত করি।
মহব্বতের ক্ষেত্রে এভাবেই আমি এখনও জাহেলই রয়ে গেছি। হজরত! আমি সাদ সাহেবকে চিনি না। ওয়াসিফ সাহেবকে কিংবা যুবায়ের সাহেবকে চিনি না। আমার বস্তির জিম্মাদার শামশু মিয়াকে চিনি। শামশু মিয়া আমাকে ইজতিমায় নিয়ে গেছে। বয়ান-টয়ান কিছু বুঝি নি। কিন্তু এতগুলো মানুষ। এত বড় প্যান্ডেল। এতগুলো ল্যাট্রিন আর এতগুলো বাঁশের খুঁটি গুনে সুবহানাল্লাহ পড়ে চিল্লায় চলে গেছি। ঠিক একই অবস্থা আমার মতো শত শত হোসেন মিয়ার। চিল্লা দিয়ে দ্বীনের গুরুত্ব বুঝেছি, নামাজ-রোজা ধরেছি। আমার মতো মূর্খ মানুষ আর কি বুঝব? ইজতিমায় কারা বয়ান করে? কি বয়ান করে? বুঝি না। এতটুকু বুঝি, এরা আল্লাহ ও রাসুলের কথা বলছে। না বুঝলেও কথাগুলি শুনি আর এক লাফে চিল্লার জন্য দাঁড়াই।
আপনারা আলিম মানুষ। অনেক কিতাবপত্র লিখেন। আমরা মূর্খ মানুষ কিতাব পড়ি-টড়ি না। হয়তো আপনার কিতাবের ১০-১২ হাজার কপি ছাপা হয়। কিছু মানুষ পড়ে। আমরা মুর্খ মানুষদের এতে কোনো ফায়দা নেই। আমরা শামশু মিয়ার সাদাসিধে বয়ান শুনে কাঁদি আর দ্বীনের জন্য আগ্রহ পাই। ব্যস! আমাদের দ্বীন এতটুকু। আপনি আমার এই অবস্থা শুনে আমাকে মন্দ বললেও আমার কিছু করার নেই। আমাদের শেষ পর্যন্ত অবলম্বন এই শামশু মিয়াই। আমরা কাকরাইল চিনি। কাকরাইল থাকুক। এটি আমরা চাই। টঙ্গি ইজতিমা চিনি। ইজতিমায় আসতে চাই। আপনাদের লিফলেটের ভাষাও আমরা বুঝি না। দলিলও বুঝি না।
আমরা আম মানুষ। তাবলিগই আমাদের অবলম্বন। এ মেহনতের ক্ষতি আমরা কীভাবে বরদাশত করব? এই মেহনতের বদনাম আমরা কীভাবে সইব? আপনারা হয়তো অনেক কিছুর বিরুদ্ধে সরব। আমরা এতকিছু বুঝি না। আমরা কেবল এতটুকু চাই, আমাদের মুরুব্বিগন এক থাকুন। মারকাজে বসে আমাদের নিগরানি করুন।
আপনারা যাই করেন, আমার মতো হোসাইন মিয়াদের কথা মাথায় রাখিয়েন। কারণ আমরা জানি, আমাদের কাছে এই জাহেল তাবলিগওয়ালারা ছাড়া আর কেউ আসবে না।
আপনারা তাবলিগের কল্যাণ চান। ভালো কথা। কল্যাণ কামনা দেখাতে গিয়ে মেহনতটা যেন বরবাদ না হয়। আপনার হেকমত ও কৌশলের কারণে যদি আমরা হোসাইন মিয়ারা বঞ্চিত হই, কিয়ামতের ময়দানে কিন্তু আপনাদের দেখে নেব। আল্লাহর দরবারে আপনাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানাব। বলব- হে আল্লাহ! এরা আমাদের শিখায়ওনি, উল্টো আমাদের হেদায়েতের ময়দানটাকে সমালোচনার বাণে নষ্ট করেছে।
আপনি দ্বীনের কল্যাণ কামনা করুন, কিন্তু হোসাইন মিয়াদের কথা একটু মনে রাখিয়েন। নইলে আপনার ইসলাহ প্রচেষ্টায় বাতিলই খুশি হবে, ইহুদি-নাসারা খুশিতে নাচবে। আর ইসলাম এক কোনায় বসে চোখের জল ফেলবে।
ইতি
হোসাইন মিয়া
এক মূর্খ তাবলিগওয়ালা
(বি:দ্র: সম্পাদক দায়ী নয়)
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস