মোস্তফা কামাল: রনি। এই মুহূর্তে দেশে বহুল আলোচিত-সমালোচিত একটি নাম।
তাঁর পুরো নাম নূরুল আজম। চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। হালে সাবেক হয়েছেন। হয়তো চাপে পড়ে পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। গোপনে আবার দলে ফিরেছেন কি না জানি না।
তবে তার আগে ক্ষমতার দম্ভে তিনি শুধু তড়পাচ্ছিলেন। তাঁর সেই তড়পানি দেখলাম আমরা ফেসবুকে। রনির সেই মারধরের দৃশ্য প্রথমে ফেসবুকে ভাইরাল হয়। তারপর গণমাধ্যমে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ পায়। ভিডিওটি দেখলে দুর্বলের প্রতি সবলের নিষ্ঠুর আচরণের চিত্রই ফুটে ওঠে। প্রশ্ন জাগে, কেন এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ? আর রনিই বা কত বড় ক্ষমতার অধিকারী?
কথায় বলে, সেরের ওপর সোয়া সের আছে! সব কিছুরই তো একটা সীমা থাকে। সীমা লঙ্ঘনকারীকে সৃষ্টিকর্তাও ক্ষমা করেন না। এর পরও আমরা দেখি, অনেকেই ধরাকে সরাজ্ঞান করেন। কিন্তু ক্ষমতা যে খুবই ক্ষণস্থায়ী, এটা কেউ ভাবতে চায় না। ক্ষমতা পেলেই সে আর স্বাভাবিক থাকে না। অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। মাটিতে তার পা পড়ে না। কখনো কখনো দৈত্য-দানবের মতো আচরণ করে।
আমরা ভিডিওচিত্রে দেখলাম, চট্টগ্রামে ইউনিভার্সিটি অ্যাডমিশন কোচিং সেন্টারের পরিচালক রাশেদ মিয়ার রুমে মাস্তানের মতো ঢুকলেন রনি। ঢুকতে ঢুকতে কী যেন বলছিলেন। তারপর তাঁর টেবিলের সামনের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। এক কথা দুই কথার পর শুরু হলো চড়-থাপ্পড়, চুল ধরে টানাটানি। বিদ্যুতের গতিতে চলছিল তাঁর হাত।
একপর্যায়ে ব্যবসায়ী রাশেদ মিয়াকে দেখলাম, হাত জোড় করে ক্ষমা চাচ্ছেন। সে দৃশ্য যিনিই দেখবেন তিনিই হতবিহ্বল হবেন। এটা কি কোনো মানুষের কাজ হতে পারে। রাশেদ মিয়ার অপরাধ কী? হাজারো মানুষের মনে এই প্রশ্ন ছিল।
পরে জানা গেল, রাশেদ মিয়ার কাছে নাকি রনি ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন। চাঁদা দিতে না পারায় তাঁকে দেখিয়ে দিতে যান রনি। তিনি ব্যবসায়ী রাশেদ মিয়াকে একহাত নয়, দুই হাত দেখিয়েছেন। রাশেদ মিয়ার হাত রনির মতো লম্বা নয়। ক্ষমতা বলতে তাঁর কিছুই নেই। তাই তিনি নীরবে অন্যায় সহ্য করেছেন।
অনেকক্ষণ ধরে মার খেয়েছেন। কিন্তু বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেননি। ক্ষমতার দম্ভের কাছে, উত্তাপের কাছে তিনি পরাস্ত হয়েছেন। তাঁর অসহায়ত্ব দেখলে যেকোনো মানুষ মর্মযাতনায় ভুগবেন। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই তা উপলব্ধি করতে পারছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক সমস্যা আছে তা অস্বীকার করি না, তবে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারছি। সামাজিক অনেক নিষ্ঠুরতা, অন্যায়, অত্যাচারের খবর মুহূর্তের মধ্যেই মানুষ জানতে পারছে। ফেসবুক না থাকলে হয়তো এসব অপরাধের খবর কোনো দিনও কেউ জানতে পারত না।
আমরা এ-ও জানতে পারছি, ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি ও মারধরের জন্য রাশেদ মিয়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। কিন্তু পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আসলে নিতে পারেনি। রনি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিপুল ক্ষমতার অধিকারী, ‘অসীম সাহসী’ রনিকে ধরার সাধ্য কার!
রনি ইস্যুতে ফেসবুক এখনো বেশ সরগরম। কেউ তাঁর পক্ষে; আবার কেউ বিপক্ষে নানা রকম মন্তব্য করছে। নারী কোটার এক সংসদ সদস্য তো বলে বসেছেন, এ রকম ‘সাহসী’ ছেলেকে আমরা হারাতে চাই না। হারাতে পারিও না। রনি, তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে পারো না! লক্ষ্মী সোনা, রাগ কোরো না! ফিরে এসো ভাই; ফিরে এসো!
কেউ কেউ আহ্লাদ করে বলেন, রনি এত দুষ্ট কেন? ওকে একটু বকে দিলে হয়! তা না হলে ছাত্রলীগের বদনাম হয়ে যাবে! আবার কেউ বলছেন, ছাত্রলীগে এ রকম দু-একজন রনি থাকলেই যথেষ্ট। আগামী নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য আর কিছুর দরকার হবে না। এ বিষয়টি কি ছাত্রলীগ নেতৃত্ব মগজে ঢুকিয়েছেন!
রনিকে ‘সাহসী’ আখ্যা দেওয়ার কারণ কী বুঝতে পারলাম না। একজন নিরীহ ব্যবসায়ীকে নিপীড়ন করায় তিনি এই উপাধিতে ভূষিত হলেন! হায় রে দিনদুনিয়া! কোথায় রনির বিচার চাইবে তা না উল্টো তিনি উপাধি পেয়ে গেলেন! তাহলে সারা দেশের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রনির মতো আচরণ শুরু করে দেবে।
এমন উপাধি কে না চায়? আর এখন তো নানা রকম উপাধি পাওয়ার জমানাই চলছে।
আমরা হয়তো এ-ও দেখব, রনির জন্য ‘সাহসী পদক’ প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে বাংলা একাডেমি চত্বরে। সেখানে আমাদের বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিকরা উপস্থিত থেকে পদক প্রদান করবেন। রনির প্রশংসায় মশগুল হয়ে উঠবেন! তাঁরা সবাই এক সুরে বলবেন, বাংলার ঘরে ঘরে রনির মতো সাহসী ছেলে আমরা চাই! আমরা সেই দিনটির অপেক্ষায় রইলাম।
হে মহান সৃষ্টিকর্তা! আমাদের রক্ষা করুন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস