পাঠকই লেখক: প্রতিবার চাকরির ছুটিতে বাসায় আসলে মা আমার বিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়ো শুরু করেন। কিন্তু গত এক বছরে নয়টা মেয়ে দেখার পরও আমার বিয়ে হয়নি। হয়তবা আমার বিয়ের ফুল ছাগলে খেয়ে ফেলছে। তাই সেটা ফোঁটার আর সম্ভাবনা নেই এবং আমার বিয়ে হওয়ারও সম্ভাবনা নেই।
এবারও মায়ের অনুরোধে জীবনের শেষ চিকিৎসার মত শেষ মেয়েটাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে দেখতে গেলাম। মেয়েটা অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে। বাবা মা তাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। কারণ তাদের গ্রামে নাকি মেয়ে-ছেলে পালানোর হিড়িক পড়ে গেছে। বাবা মায়ের মুখে চুনকালি মাখানোর আগে তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছেন তারা। যদিও আমি যাকে দেখতে গিয়েছি সে কোন সম্পর্ক করেনা। কিন্তু খারাপ মানুষের কর্মের ফলাফল মানুষের মনে অনেক সময় ভাল মানুষের প্রতি সন্দেহের সৃষ্টি করে। তাই খারাপ কিছু করার আগেই তাদের মেয়ের বিয়ে দেওয়া চাই।
মেয়ে দেখতে গেলাম। মেয়ে দেখলাম, মাশাল্লাহ, অনেক সুন্দর চেহারা। যদিও আমি সুন্দর চেহারায় বিশ্বাসী না, সুন্দর মনে বিশ্বাসী। কারণ একটা সময় চেহারার সুন্দরের জৌলুস হারিয়ে যাবে। মনের সৌন্দর্যটা সারাজীবন থাকবে। আর সংসার করার জন্য চেহারার সৌন্দর্যের চেয়ে মনের সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তাহলে সংসার জীবনে সুখ পাওয়া যায়। এখানে সব কিছুই ঠিকঠাক হল কিন্তু সাধ বাধলো আমার পেশা নিয়ে। মেয়ের বাবা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের সহকারি শিক্ষক, তার বড় ভাই সেনাবাহিনীতে চাকরি করে। পরিবারের প্রায় সবাই সরকারি চাকরি করে। কিন্তু আমিতো প্রাইভেট চাকরি করি। স্যালারি অবশ্য ভালই দেয়, প্রায় পঁয়চল্লিশ হাজারের কাছাকাছি। কিন্তু সেটা দিয়ে কী হবে? মেয়ের বাবা মা মনে করেন প্রাইভেট চাকরিতে কোন সিকিউরিট নেই, যখন তখন চলে যেতে পারে। আর চাকরিচ্যুত হলে তার মেয়েকে কিভাবে ভরণপোষণ করবে তার জামাই।
তাই মেয়ে আমার পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও মেয়ের বাবা মা না করে দিলেন সরকারি চাকরি না থাকার কারণে। এই নিয়ে এগারো বারের মত হৃদয়ের ছোট ছোট স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে গেল আমার। ভাবছি আর কোন মেয়েই দেখবনা বিয়েও করবনা।
প্রথমবার হৃদয়টা ভেঙেছে আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড। আমরা তিন বছরের মত সম্পর্ক করেছিলাম। সম্পর্কের শুরুতে সে একটা কথা বলছিল আমায়, ‘তুমি যদি বিসিএস ক্যাডার না হতে পারো তবে আমার বাবা মা তোমায় মেনে নেবেনা। ‘ঠিক তাই হল। তার বাবা আমাকে মেনে নিলেননা, এক্সের বিয়ে হয়ে গেল কোন এক এডমিন ক্যাডারের সঙ্গে। তারপর যেটুকু ইচ্ছে ছিল সরকারি চাকরি করার সেটাও হারিয়ে ফেলছি। যার জন্য সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছি সেইতো নেই। তো পড়াশোনা করে কি হবে আর? খুব রাগ করে নিজের যত চাকরির বই আছে সবগুলো হলের এক ছোট ভাইকে দিয়েছি। অবশ্য সে এখন ভাল চাকরি করছে। মাঝে মাঝে ফোন দেয় আমাকে, খোঁজখবর নেয় আমার।
দশমবারের মত যখন বিয়ে করতে ব্যর্থ হলাম তখন আমি বেসরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিলাম। দুই বছর চাকরি করে অনেক টাকা পরিবারকে দিয়েছি। পরিবারে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরে আসছে। এখন এক বছর বসে বসে চাকরির প্রস্তুতি নেব।
উল্লেখ্য, তখনও সার্টিফিকেট অনুযায়ী আমার পঁচিশ বছর পূরণ হয়নি। আরো পাঁচ বছর দুই মাস আছে সরকারি চাকরিতে আবেদন করার। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি সাবজেক্টে মাষ্টার্সে ভর্তি হলাম। সুপারভাইজারের সাথে অনেক ভাল সম্পর্ক ছিল আমার। তাই বেশি চাপ দেননি। হলে থাকি আর চাকরির জন্য দিনরাত পড়ছি। আমার টেবিলের সামনে ওয়ালপেপারে বড় করে লেখা ছিল “একটা ভাল মেয়েকে, ভাল ঘরে বিয়ে ও ভাল সামাজিক অবস্থান তৈরি করার জন্য হলেও একটা সরকারি চাকরি প্রয়োজন। হোক সেটা ফার্স্ট ক্লাস কিংবা থার্ড ক্লাস। ” এইটা দেখি আর ফুয়েল গ্রহণ করে জ্বলে উঠি।
কেটে গেল ছয়টা মাস। বিসিএসের প্রিলিতে কোয়ালিফাই করলাম। লিখিত পরীক্ষার জন্যে পড়াশোনা করছি। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক অংশটা আমার কাছে সহজই মনে হচ্ছে। হয়ত এই দুই অংশে লিখিত পরীক্ষায় বেশি মার্কস পাব। কারণ আমি ছোট বেলা থেকেই পত্রিকা পড়তে ভালবাসি। একদিন পত্রিকা না পড়লে অস্বস্তি লাগে আমার। রিটার্ন এক্সাম দিলাম। ম্যাথটা একটু খারাপ হল। রেজাল্ট দিল আড়াইমাস পর। কোয়ালিফাই করলাম। আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে উঠে গেছে আমার। এখন আর পিছনে ফিরে তাকাইনা। ভাইভার জন্য পূর্ণোদ্যমে চলছে আমার পড়াশোনা। তারপর আসলো সেই মহাপরীক্ষা। যে পরীক্ষার উপর আমার একটা ভাল ঘরের ভাল একটা মেয়েকে বিয়ে করা নির্ভর করছে। অবশেষে ভাইভাতে কোয়ালিফাই করে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিলাম। মেয়েদের বাবা-মা ও মেয়ের রিজেকশনগুলো আমার মাঝে জিদের সৃষ্টি করছে। আর সেই জিদের থেকেই আজকের এই পজিশনে আসা আমার।
শেষবার যে মেয়েটাকে দেখতে গিয়েছিলাম তার বিষয়ে খোঁজ নিলাম একটু, বিয়ে হয়ে গেছে কি না। শুনলাম বিয়ে হয়ে গেছে। কোন এক সরকারি চাকরিজীবীর সাথে তবে সেটা থার্ডক্লাশ চাকরি। এইচএসসি পাশ করেই ওই চাকরিতে আবেদন করা যায়। অথচ আমি যখন ওই মেয়েটাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম তখন আমার শুধু একটা সরকারি চাকরি ছিলনা, তাছাড়া আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা, আর্থিক অবস্থা মেয়েটার বর্তমান জামাইয়ের চেয়ে অনেক বেশিই ছিল। শুধুমাত্র সরকারি চাকরি নেই বলেই আমার এক্স জিএফসহ ছয়টা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা থেকেও হয়নি।
এটা অবশ্য মেয়েদের কিংবা তাদের অভিভাবকের দোষ না। কারণ এদেশের প্রেক্ষাপটে বেসরকারি চাকরির কোন গ্যারান্টি নেই, সোশ্যাল ভ্যালু নেই। একজন মাস্টার্স পাশ বেসরকারি চাকীরজীবী সমাজের কাছে যতটা না সম্মান পায় তার চেয়ে বেশি সম্মান পায় এসএসসি পাশ করে সেনাবাহিনীতে জয়েন করা একজন সৈনিক। বিয়ের বাজারে এই সৈনিকের মূল্য অনেক বেশি। কারণ সে একজন সরকারী চাকুরীজীবী, ভাবা যায়!!
শুনলাম মা আবার একটা মেয়ের সন্ধান পেয়েছে। মেয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, থার্ড ইয়ারে। হয়তবা এবার আর বিয়েটা ভাঙবে না, হয়েই যাবে। কারণ বিয়ের ফুল ফোটানোর জন্য সার হিসেবে সরকারি চাকরিটাকে ছিটিয়ে দিয়েছি গাছের গোড়ায়। দীর্ঘদিনের ব্যাচেলর লাইফ শেষে হয়ত ম্যারিড লাইফে খুব শীঘ্রই পদার্পণ করব। আর তাতেই স্বেচ্ছায় নিজের স্বাধীনতা নষ্ট করে পরাধীনতাকে বরণ করে নেব। জানিনা এই পরাধীনতা আমায় কতটুকু শান্তি দেবে। লেখক : মাসুদ রানা
এমটিনিউজ২৪.কম/হাবিব/এইচআর