জাফর সোহেল : হৃদয়ের একেবারে গহীনে যে জল জমে তা নাকি কখনো কখনো সত্যিকারের জল হয়ে গড়ায় না, চোখের মণি কোঠায় এসে থমকে থাকে, বাষ্প হয়ে ধীরে ধীরে বাতাসে মিশে যায়। লুকা মদরিচকে আলিঙ্গন করার সময় চকিতে একবার দেখা হয়ে গেল তার ছলছল দুটি চোখ- জল সেখানে আটকে আছে মুক্তোদানা হয়ে। ঝরে পড়ার জন্য জলের নিজের যেন শক্তি নেই! সর্বশক্তি দিয়ে জলকণা আটকে রেখেছেন তিনি। এই জল যদি ঝরেও নিশ্চিতভাবেই তা হবে অলক্ষ্যে, নিভৃতে, নীরবে। সাহস যুগিয়ে যিনি অভ্যস্ত তার তো ভেঙে পড়া মানায় না। তিনি হারলে যে সবাই হেরে যাবে, তিনি চান সবাই জিতুক, সবাই ভাবুক তাদের জয় হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট তিনি, তাতে কী, ফুটবল ভালোবাসতে তো আর প্রেসিডেন্ট হওয়া কোনো বাধা নয়। বাধা নেই গ্যালারিতে উদ্দাম উচ্ছ্বাসে, উদযাপনেও। কিন্তু হেরে যাওয়ার শোকে কাঁদতে মানা- এটা তিনি জানেন। তাই নিজের দল হেরে গেলেও হাসিমুখে মঞ্চে আসেন, করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান বিজয়ীদের, হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করেন শত্রু-মিত্র সবাইকে, এমনকি তার উষ্ণ আলিঙ্গন পান মাঠের বিচারক রেফারিরাও!
কার কথা বলছি? ওহ, আপনারা তো জানেনই, সবাই জানেন; বাংলাদেশ জানে, বিশ্ব জানে- তিনি কিতারোবিচ; পুরো নাম কলিন্দা গ্রাবার কিতারোবিচ। ইউরোপের বলকান অঞ্চলের ছোট্ট দেশ ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট তিনি। শারীরিক গঠন আর সৌন্দর্যের গুণে ইতিমধ্যে যিনি বিশ্বের সবচেয়ে আবেদনময়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি কুড়িয়েছেন। নাম শুনে অবশ্য অনেকে কিছুটা অনুমান করে নিতে পারবেন- ইনি ক্রোয়েশিয়ার কেউ হবেন। বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট রাকিটিচ, সুবাসিচ, মানজুকিচ, পেরিসিচ, মদরিচ গংদের নামের পিছে যেভাবে ‘চ’ বর্ণ লেগে আছে আর ধারাভাষ্যকারেরা এবার এত বেশি তাদের নাম উচ্চারণ করার সুযোগ পেয়েছেন যে, দর্শক হিসেবে সবারই মুখস্থ হয়ে যাওয়ার কথা। আর নামের শেষে ‘চ’ মানেই কাউকে ক্রোয়াট বলতে প্রথমে কারও দ্বিধাই থাকবে না! তা এই শেষ অক্ষর ‘চ’ওয়ালা এই প্রেসিডেন্টের দেশে মানুষের সংখ্যা এত কম যে, তা কবে কোটির ঘরে পৌঁছাবে- এ ব্যাপারে কারো কোনো নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী নেই! ৪৫ লাখ কতো দিনে ১০০ লাখ হবে? কবে কিতারোবিচের উত্তরসূরি কেউ কোটি মানুষের প্রেসিডেন্ট হবেন?
অবশ্য এ বিষয়ে অর্থাৎ নাগরিকের সংখ্যার দিক থেকে কমতিকে সে দেশের প্রেসিডেন্ট বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট অল্প মানুষের নেতা হয়েই খুশি। কে জানে, সম্ভবত এই মুহূর্তে এই স্বল্পসংখ্যক মানুষের হালকা বোঝা কাঁধে থাকার কারণেই এতটা নির্ভার তিনি। রাশিয়ার মাটিতে বিশ্বকাপ খেলছে ক্রোয়েশিয়া আর গ্যালারিতে নাচের মুদ্রা তুলছেন তাদের প্রেসিডেন্ট কিতারোবিচ- এ দৃশ্য একবার দুবার নয়, অনেকবার দেখেছে বিশ্ব। বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল ভক্ত বিস্ময় চোখে দেখেছে এক নারীকে, এক পেসিডেন্টকে, এক ফুটবলপ্রেমীকে।
কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক রাশিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল কিতারোবিচের দেশ। কিন্তু গ্যালারিতে তার উপস্থিতি এমন ছিল, মনে হচ্ছিল তার নিজের বাড়ির উঠোনে বুঝি খেলা হচ্ছে! কিতারোবিচ এমনি পাগুলে সমর্থক ফুটবলের। ভাগ্যিস, মহামতি ভ্লাদিমির পুতিন সেদিন নিজ দেশের খেলা দেখতে মাঠে যাননি, যদি যেতেন তাহলে কিতারোবিচের উদ্দাম নৃত্য দেখে গুরুগম্ভীর পুতিনের প্রতিক্রিয়া হতো বিশ্ববাসীর জন্য আরেক চমক। সেই ম্যাচটি জেতার পর কিতারোবিচ ড্রেসিংরুমে নাকি সব খেলোয়াড়কেই হাগ (আলিঙ্গন) করেছেন। এমনকি উদোম গায়ে থাকাদেরও বিশেষ এই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেননি! এমন প্রেসিডেন্ট কে কবে পেয়েছে এই ধরাধামে? সত্যিই গবেষণার বিষয় বটে!
বিশ্বকাপ ফাইনাল উপলক্ষে ‘জার’দের দেশে আসতে অনেক বিশ্ব নেতাকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রাশিয়ার নতুন যুগের ‘জার’ ভ্লাদিমির পুতিন। ফ্রান্সের ম্যাক্রো, যুক্তরাজ্যের থেরেসা মে আর ক্রোয়েশিয়ার কিতারোবিচসহ এসেছেন অনেকেই। সবাই এই সুযোগে পুতিনের সঙ্গে দেখা করে কূটনৈতিক কিছু হিসাব-নিকাশ চুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ক্রোয়াট প্রেসিডেন্টের কূটনীতি ছিল অন্য জায়গায়, অন্যরকম। দেশ ও রাজনীতির কোনো বিষয় নয়, তিনি ভ্লাদিমির পুতিন আর থেরেসা মে’কে কূটনীতির উপহার হিসেবে দিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার জাতীয় দলের দুটি জার্সি!
কোয়ার্টার ফাইনালের জয় নিয়ে দেশে যান প্রেসিডেন্ট, কিন্তু মন পড়ে থাকে রাশিয়ায়- রাকিটিচ, মদরিচদের কাছে। জরুরি কাজ থাকায় সেমিফাইনালে গ্যালারিতে যেতে পারেননি তিনি, তবে মদরিচরা তাকে নিরাশ করেননি। কে জানে, হয়ত নিজেদের প্রেসিডেন্টের জন্যেই ব্রিটিশদের হারিয়ে বিশ্বকাপের ইতিহাসে নিজেদের সেরা সাফল্য বাগিয়ে নিলেন পেরিসিচ, মানজুকিচরা। আর এতে সু্বিধে হলো এই- আরেকবার সুন্দরী প্রেসিডেন্টের আলিঙ্গন পাওয়ার উপলক্ষ হয়ে গেল। ফাইনালে হেরে গেলেও এই আলিঙ্গন থেকে বঞ্চিত হননি ক্রোয়াট ফুটবলাররা। তবে শেষবারের এই আলিঙ্গনে হৃদয়ের উষ্ণতা কতখানি ছিল, নাকি ব্যথাতুর হৃদয়ের যন্ত্রণা ভাগাভাগি করা- তা কিছুটা ভাববার বিষয় বটে!
তবু হারজিত দিয়েই তো আর সবকিছু মাপা যায় না। মানুষ ও তার কর্ম মাপতে হলে মাঝে মাঝে আবেগ-অনুভূতির মতো অন্য অনুঘটকগুলোকেও একটু গুরুত্ব দিতে হয়। সেইসব দিক থেকে হিসাব করলে এবারের বিশ্বকাপ চ্যম্পিয়ন ফ্রান্স হয়েছে বটে, তবে পৃথিবীর মানুষের হৃদয় জিতেছে ক্রোয়েশিয়া। আর এটা সবাই এক বাক্যে মানবেন যে, সোনার কাপ হাতে না পেলেও এই আসরে মাঠের বাইরের সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ক্রোয়াটদের সুন্দরী প্রেসিডেন্ট কিতারোবিচ। তাকে এবং তার ফুটবলীয় আবেগকে স্যালুট…।
লেখক: সাংবাদিক