রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৭:৪৪:৩৭

কে আমাকে এমনি করে বাসতে পারে ভালো

কে আমাকে এমনি করে বাসতে পারে ভালো

পাঠকই লেখক ডেস্ক: লেপের ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে তুলিকে দেখছি। মেয়েটা খুশিতে লাফাচ্ছে প্রায়। গতকাল রাত থেকেই এমন চলছে। সারা রাত ধরে দুনিয়ার সব খাবার রান্না করা চলছেই তার। এখন শাড়ি নিয়ে বাছাবাছি চলছে। কোন শাড়িতে মানাবে, কোনটা পড়বে এই নিয়ে বলে বলে আমার আর দিশার মাথা খাচ্ছে। যা ভাবছিলাম তাই... হঠাৎ করেই তুলি আমাকে ডেকে বললো, এই ইপ্সিতা, এই শাড়িটা কেমন ম্যারাম্যারা হয়ে গেল না? আমাকে মানাচ্ছে না এই রংটায় একদম' আরও নানান ধরনের কথা! লেপটা সরিয়ে মাথাটা তুলে বললাম 'দিশু, চল এক কাজ করি। আমরা তুলিকে বরং বেনারসি পড়িয়ে বিয়ে করতে পাঠিয়ে দেই। ওর আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে ও ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে না আজকেই বিয়ে করতে যাচ্ছে।'

তুলি চোখ গরম করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি ব্রাশ হাতে বাথরুমের দিকে গেলাম। বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাওয়া নিয়ে এতো আয়োজন করার কি আছে এটা আমার মাথায় আসে না। শাড়ি-টারি পড়ে ধুন্ধুমার অবস্থা! এতো কষ্ট করে রান্না করে বয়ফ্রেন্ডকে খাওয়ানোরই বা কি হলো? যত্তসব। এই শীতের মধ্যে ভোর ছয়টা থেকে সাজগোজ শুরু হয়েছে। পারেও বটে...।

আমার নিজের কয়েকদিন থেকে সরিষা ইলিশ খেতে ভয়ানক ইচ্ছে করছে। আমি রান্না-বান্না পারি না। রান্না করার চেয়ে আমি হলের অখাদ্য খাবার জোড় করে গলায় ঢুকিয়ে থেকে যাই, না খেয়ে থাকবো তাও রান্না আমাকে দিয়ে হবে না। আমার রুমমেট দুজন মাশাল্লাহ খুবই ভালো, তারা আমাকে মাঝে মাঝেই এটা-ওটা রান্না করে খাওয়ায়। আজ শুক্রবার। মোটামুটি হলের প্রায় সবাই ঘুরে-বেড়াতে চলে গেছে। আমার মত হাতেগোনা কয়েকজন রুমে বসে ঝিমাচ্ছে। ফোনের শব্দে আমার দ্বিতীয় দফা ঘুমের প্রস্ততি ছুটে গেল।

- কিরে? কি করিস?

- ঘুমানোর চিন্তা ভাবনা করছি। ক্যান?

- দুপুর বারোটায় ঘুমানোর চিন্তা ভাবনা মানে? বের হ রুম থেকে।

- তোর আবদার?

- না। মায়ের আবদার। মা আজকে কি সব রান্না করছে। সরিষা ইলিশও করছে। তুই না কাল বললি খেতে ইচ্ছা করছে তাই মা বলছে এসে খেয়ে যাইতে।

- আন্টিকে কে বলছে আমার সরিষা ইলিশ খাইতে মন চাইছে?

- কেউ বলে নাই। মা এমনি রাঁধছে। কাকতালীয় ব্যাপার পুরা। আমি তো দেখে অবাক। তখন তোর কথা মনে পড়ল তাই ভাবলাম তোকে বলি।

- ইমন! আমার সাথে গুল মারবি না একদম। কাকতালীয় ব্যাপার না? কে ইমনতালীয় ব্যাপার। খালি খালি আন্টিকে ক্যান জ্বালাস তুই? সরিষা ইলিশ না খাইলে আমি মরে যেতাম!

- প্যাচাল পরে পারিস। এখন না আসলে মা চিল্লাবে। রেডি হ। আমি নিতে আসতেছি।

- খবরদার নিতে আসবি না। আমি একা যেতে পারি, আমার চৌকিদার লাগবে না।

মাঝে মাঝে একা একা হাঁটতে অনেক ভালো লাগে,অনেক কিছু চিন্তা করতে করতে হাঁটা যায়। এই যেমন এখন আমি আকশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে হাঁটছি। ভাবতে ভাবতে একটা চশমা পড়া ছেলের মুখ মাথায় চলে আসছে বারবার। ছেলেটা আমার মত একটা মেয়ের জন্য এত ভালোবাসা কেন জমিয়ে রেখেছে? আমি ওকে কখনো রাত দশটার দিকে ফোন দিয়ে বলি না ও ঠিকমত খেয়েছে কি'না, বেশি রাত জাগলে বলি না কেন এত রাত জেগে আছে, সকালে নাশতা না করলে ধমক লাগিয়ে অধিকার নিয়ে কখনো বলি নি "না খেয়ে না খেয়ে পেটে আলসার বাধাবি? আমার সামনে বসে খা এখন।'

আমি কেন যেন এরকম। অথচ এই আমিই কাল রাতে ওর সাথে কথা বলতে বলতে হুট করে বলে ফেলেছিলাম 'জানিস, ইলিশ মাছ সর্ষে বাটা দিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে।' আর ও সেটা মনে রেখে দিয়েছে। আমার সব খুঁটিনাটি জিনিস ও খেয়াল রাখে, আমি বড় অগোছালো, এলোমেলো। ছেলেটা আমাকে গোছানোর দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। আমি জানি আমাকে হল থেকে ওর বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ও কতটা ব্যাকুল ছিল অথচ আমি ওকে না করার সময় দিব্যি মেনে নিয়েছে।

ওকে না করার পরে আমার মনে হল আমি তো বলতে চেয়েছিলাম 'তোর নাকি আমাকে হলুদ জামায় দেখতে অনেক ভাল্লাগে। পড়বো তোর পছন্দের জামাটা? তারপর তোর বাইকের পেছনে চড়িয়ে আমাকে নিয়ে যা। আজকে চুল খোলা রাখবো, তোর নাকি সারাক্ষণ আমার খোঁপাবাঁধা চুল দেখতে দেখতে আমার খোঁপার কাটা ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছা করে। তাই আজ চুল বাঁধবো না আমি।

গতবছর জন্মদিনে যে পায়েলটা আমাকে দিয়েছিলি সেটা এখনো তোকে পড়ে দেখাইনি। এ জন্য তোর অনেক মন খারাপ ছিল, আজ ওটা পড়ি, তুই দেখিস।' এসব না বলে আমি বলেছি 'আমার চৌকিদারের দরকার নেই।' এটা কোন কথা হল? নিজেকেই নিজের মারতে মন চাচ্ছে এখন। আমি এমন কেন?

- সোজা হলে যাবি?

- আয়, একটু হাঁটি।

- বাইক আনবো না?

- লাগবে না। আন্টির রান্না অনেক মজা। আন্টির কাছ থেকে রান্না শিখতে হবে।

- হা..হা..হা..।

- হাসছিস কেন? হাসার মত কিছু বললাম?

- তুই শিখবি রান্না? তাহলেই হয়েছে! বিয়ের পর আমিই না হয় তোকে রান্না করে খাওয়াবো।

- আমার উপর তোর অনেক রাগ লাগে না ইমন?

- রাগ কেন লাগবে?

- আমি তোকে সবসময় কেমন যেন দূরে দূরে ঠেলি সেইজন্য।

- দূরে ঠেলিস জন্যই আমি আরো কাছে আসি।

- এতো ভালোবাসিস না আমাকে। ভয় হয় আমার প্রতি তোর এই ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবে একসময়।

- এরকম কোনদিন হবে না ইপ্সিতা। তোকে আমি এতোই ভালোবাসি যে তা ফুরানোর নয়।

- ইমন তোকে আমি কখনো বলিনি। আজ খুব বলতে ইচ্ছে করছে। আমি তোকে অনেক...।

- থাম। থাম। থাক। তোর বলতে হবে না। আমি জানি।

- আমি বলি, তুই শোন। চুপ করে থাক। আজ আমি বলি। জানলেও শোন আজ। আমি জানি আমি অনেক এলোমেলো, মেয়েরা অনেক গোছানো হয়, আমি কোন কাজই ঠিকমত পারি না। তোকে অবহেলা করি এমন ভাব দেখাই। তোকে আসলে আমি অনেক ভালোবাসি। তুই আমাকে যতটা বাসিস তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। আমার মত একজনকে তুই কেন এত ভালোবাসিস সেটা আমি ভেবে পাই না।

তাই ভয় হয় যদি কখনো তোর মনে হয় ভুল করেছিস তাই আড়ালে থাকি। দ্যাখ, তোর দেওয়া পায়েলটা পড়েছি, চুলে খোঁপাও করিনি, কেমন লাগছে আমাকে? শাড়ি পড়তেও খুব ইচ্ছা করছিল, আমি শাড়ি একা পড়তে পারি না তুই জানিসই তো। দিশা-তুলি কেউ ছিল না যে পড়িয়ে দেবে তাই পড়িনি। অন্য কোন একদিন আমিও ভোর ছয়টা থেকে খুব সুন্দর করে সেজে তোর সাথে দেখা করতে আসব সাথে একবাটি নুডলস নিয়ে। আমি শুধু ওটাই পারি বানাতে তাই। আর হ্যাঁ, বিয়ের পর যদি আমাকে আসলেই রান্না করে না খাইয়েছিস তো তোর কপালে শনি আছে।

আমি ইমনের হাত ধরে হাঁটছি। ওর হাতের স্পর্শেই যেন ভালোবাসার ছোঁয়া পাচ্ছি, আমাকে সব কিছু থেকে বাঁচানোর শক্তি এই ছেলেটির আছে টের পাচ্ছি। একে ছেড়ে আর কোথায় যাবো? আমার সব কিছু একে ঘিরেই। ইমন মৃদু স্বরে আবৃত্তি করছে আর আমি কান পেতে শুনছি...।।

'কে আমাকে এমনি করে বাসতে পারে ভালো,
এমনি করে ভিতর-বাহির করতে পারে আলো !'

লেখিকা: প্রাঞ্জলিকা গোমেজ

 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে